প্রাচীন বাংলা ভাষা যখন অপভ্রংশের জঠর থেকে জন্মগ্রহণ করেছে সেই সময় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্নে ২৪ জন কবির কণ্ঠে আমরা শুনেছি, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনতত্ত্বের গান—’চর্যাপদ’ – বাংলা কাব্য সৃষ্টি প্রচেষ্টার যা প্রাচীনতম নিদর্শন।
চর্যাগীতি নামরূপ : ‘চর্যা’ কথাটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; যেমন তিব্বতী ভাষায় ‘চর্যা’ কথাটি সংস্কৃত ‘আচার’ (অর্থাৎ আচরণ) শব্দের সমার্থক; যেমন অসঙ্গের ‘যোগাচারভূমি’। ‘চর্যা’ কথাটি ‘Study’ –‘পাঠ’ বা ‘অধ্যয়ন’ অর্থে ব্যবহার করেছিলেন ম্যাক্সমুলার ‘প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয়সূত্র’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদে; আবার ‘হেবজ্রতন্ত্রে’ ‘চর্যা’ অর্থে যথাক্রমে যোগীর আচার-ব্যবহার (‘চর্যাপটল’ অধ্যায়) এবং তন্ত্রে পাঁচটি ভাগের একটি অংশের নামরূপে স্বীকৃত হয়েছে। ‘মানসোল্লাস’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থে ‘চর্যা-প্রবন্ধ’ নামে একটি অংশ স্থান পেয়েছে। এছাড়া, Cordier-এর ক্যাটালগে এবং ‘বোধিসত্ত্বভূমি’ গ্রন্থেও ‘চর্যা’ কথাটি পাওয়া গেছে।
চর্যাগীতি আবিষ্কার : ভারততত্ত্ববিদ্ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগার থেকে আরও তিনটি পুঁথির (সরহপাদের ‘দোহাকোষ’, কাহ্নপাদের ‘দোহাকোষ’ এবং ‘ডাকার্ণব’) সঙ্গে চর্যার পুঁথিটি উদ্ধার করেন। তারপরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্ থেকে ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দে) ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর প্রবোধচন্দ্র বাগচী, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপালে গিয়ে আরও পদের সন্ধান পান। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বিধুশেখর শাস্ত্রী, সুকুমার সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতেরা এই গ্রন্থের নাম, রচনাকাল, ভাষা সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করেন। অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী ভাষার সঙ্গে গভীর সাদৃশ্যবশত ঐ ভাষার পণ্ডিতেরাও এই গ্রন্থ তাঁদের নিজস্ব বলে দাবি করেন। শেষে শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL (‘The Origin and Development of Bengali Language’) 4 ‘Languages and Literatures of Modern India’ ইত্যাদি গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন— “There cannot be any question that we have genuine specimens of old Bengali here. Old Assamese and old Oriya, particularly the former, were certainly very like the language of the Caryas and this is all that can be admitted”— (‘Modern India, 1963, p. 169) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘Les Chants Mostique de Saraha et de Kanha’ গ্রন্থে এই অভিমত সমর্থন করেছেন।
গ্রন্থটির বিশেষত্ব হল, এর মধ্যে আছে বাংলায় লেখা ‘পদ’ (চর্যা) বা গান এবং পদের নীচে সংস্কৃত ভাষায় লেখা টীকা, নাম ‘নির্মলগিরা’, টীকাকার—মুনিদত্ত। এছাড়া আছে, ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ (Cordier-এর ‘তাঞ্জুর’ তালিকায় প্রদত্ত) টীকা। পরবর্তীকালে গবেষক তারাপদ মুখোপাধ্যায় Bstan Hgyur সংগ্রহের ‘Catalogue De Fonds Tibetain de la Bibliotheque Nationale, Paris 1909-15´ থেকে তথ্য পেয়ে উল্লেখ করেছেন, আরও চারটি টীকা-গ্রন্থের কথা (১) আর্যদেবের ‘চর্য্যামেলায়ন প্রদীপ’ (২) দীপঙ্করের ‘চর্যাগীতিবৃত্তি’ (৩) শাক্যমিত্রের ‘চর্য্যামেলায়নপ্রদীপ নাম টীকা’ (৪) শ্রদ্ধাকর বর্মনের ‘চর্য্যামেলায়ন প্রদীপ’। সংস্কৃতের পাশাপাশি তিব্বতী অনুবাদক বা টীকাকারও ছিলেন। নামকীর্তিচন্দ্ৰ মহাপণ্ডিত।
চর্যার গানের সংখ্যা ৫০ (মতান্তর ৫১)। এর মধ্যে তিনটি পদ সম্পূর্ণ এবং একটি অংশতঃ লুপ্ত হওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা ৪৬। পদগুলির দৈর্ঘ্য সাধারণতঃ দশ লাইন, তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। পদগুলি তাল-লয় এবং রাগ-রাগিণী যুক্ত। ভণিতায় কবিদের নামগুলি পদবী-বহির্ভূত; যথা লুইপাদ, চাটিলপাদ, ভুসুকুপাদ, সরহপাদ, গুস্তরী, বিরুবা, মহীধর, শবরপাদ, ডোম্বীপাদ, তাণ্ডিগা, কুক্করীপাদ, কাহ্নপাদ, ভিল্লকপা, ঢেন্টনপাদ প্রমুখ। ‘পা’ বা ‘পাদ’ হল, সম্মানজনক বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকগোষ্ঠীর ব্যবহৃত টোটেম। সংকলনে মহিলা পদকর্তাও ছিলেন। কোন কোন সমালোচক কবিদের নামগ্রহণের মধ্যে জাতিবাচক ভাবনার সন্ধান পেয়েছেন; যেমন ডোম্বীপাদ জাতিবাচক নাম, শবরপাদ ছিলেন জাতিতে শবর, তিল্লকপাদ ছিলেন জাতিতে তিলি। ঢেন্টনপাদ নাকি ঢাক বাজিয়ে ভিক্ষায় বেরোতেন ইত্যাদি। কবিদের জন্ম অষ্টাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। অনেকেই ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ভারতের পূর্বপ্রান্তে অর্থাৎ বাংলা, উড়িষ্যা, মিথিলা এবং কামরূপ অঞ্চলে এঁদের কারো কারোর জন্ম হয়।
পৃথিবীর সব দেশে কাব্যের প্রাথমিক আত্মস্ফূরণে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করছে ধর্মচেতনা। ঋগ্বেদ, উপনিষদ্, গ্রীসের ব্যাকাস সঙ্গীত Old Testament, জালালুদ্দীন রুমির রুবাইৎ, সুফী সম্প্রদায়ের ভজনগীতি শুধু ধর্মের গণ্ডীতেই আবদ্ধ থাকেনি, তা সাহিত্যপদবাচ্যও হয়ে উঠেছে। বস্তুত, আধ্যাত্মিকতা, দেবতা ও দৈবকথা যতক্ষণ মন্ত্র ও প্রার্থনায় আত্মনিবেদিত, ততক্ষণ তারা ধর্মের এলাকাধীন। কিন্তু যখনই তারা সাহিত্যসঙ্গী হয় তখনই তার বাসাবদল ও রূপবদল ঘটতে থাকে। কারণ সাহিত্য তার স্বকীয় আঙ্গিকের সাহায্যে ধর্ম ও দেবতাকে অবলম্বন করে শিল্পরূপ দান করে। ফলে যা ছিল ‘ধর্মতত্ত্ব’ (Theology), পরে তা পর্যবসিত হয় ‘কথা’ বা ‘সাহিত্যে’। এইভাবে দেখা যায়, ‘চর্যাপদ’ও যেন ধর্মের জয়তিলক ললাটে এঁকে সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেছে। তত্ত্বের ধূসর ঊষর মরুভূমিতে চর্যার কবি প্রবাহিত করেছেন “সকল রসের ধারা”।
চর্যাগীতি ধর্মতত্ত্ব: চর্যার টীকাকার মুনিদত্ত চর্যার মধ্যে যে দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন, তাকে বৌদ্ধ সহজিয়া মত অনুযায়ী শূন্যবাদ বলা যায়। শূন্যতাই একমাত্র সত্য। এর মধ্যেই সুখ-দুঃখ অবস্থার লোপ হয়। মানুষের অস্তিত্ব এর মধ্যেই নিহিত। এটি জীবের অদ্বয় ও সহজ অবস্থা। একমাত্র গুরুর উপদেশের দ্বারাই মহাসুখময় নির্বাণ লাভ করা যায়। এর জন্য কঠোর যোগ সাধনাদির প্রয়োজন নেই। মহাযানী মতে, নির্বাণ তত্ত্বমাত্র, যুক্তি দ্বারা এর স্বরূপ ব্যাখ্যাত হয়। কিন্তু সহজিয়ারা এর অনুভূতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে আগ্রহী। তাদের বিচারে সহজতত্ত্ব ‘বাক্পথাতীত’। এর গূঢ় তত্ত্ব শুধু গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জানা যেতে পারে—’গুরু পুচ্ছিা জান’। সহজবাদী ব্যতীত অপরের কাছে তা বোধগম্য হতে পারে না।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী একদিকে আছে বস্তুবিশ্বের অস্তিত্বে অনাস্থা প্রকাশ। যার পরিপূর্ণ ধারণা থেকে বৌদ্ধ সহজিয়ারা শূন্যতাবাদের তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন; যেমন একটি চর্যায় আছে—
“মরুমরীচি গন্ধবর্ণঅরী দাপণ পড়িবিম্বুজইসা।
বাতাবস্তে সো দিঢ় ভইআ অপে পাথর জইসা ॥
বান্ধিসুআ জিম কেলি করই খেলই বহুবিধ খেলা।
বালুআ তেলে সসরসিংগে আকাশ-ফুলিলা ॥”
অর্থাৎ, ‘(পৃথিবীটা) মরুমরীচিকা, গন্ধর্বের নগর, দর্পণের প্রতিবিম্ব যেমন (ভ্রাপ্ত), বাতাবর্তে যেমন পাথরের মত দৃঢ় হয়, বন্ধ্যাসু যেমন কেলি করে, বহুবিধ খেলা করে অথবা বালুর তেল, শশকের শৃঙ্গ কিংবা আকাশকুসুম (অপ্রাকৃত অলীক জগত্ত তেমনি)।’ এই শূন্যতা বোধে পূর্ণ অদ্বয় অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য জপ-তপ নয়, দেহসাধনার প্রয়োজন আছে। তাই ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন : “The Sahajia Cult, as an offshoot of Tantric Buddhism lays the highest stress on the practical method for realising the Sahajia nature of all the self and of all Dharmas.” (Obscure Religious Cults of Bengal as background to the study of Bengali literature, 2nd edition, 1962).
মহাযানী মতে, নির্বাণ তত্ত্বমাত্র, যুক্তিদ্বারা এর স্বরূপ ব্যাখ্যাত হয়। কিন্তু সহজিয়ারা এর অনুভূতির স্বরূপ সম্বন্ধেই প্রধানতঃ আগ্রহী। তাঁদের মতে, এ তত্ত্ব ‘বাক্পথাতীত।’ এখানে অর্ধনারীশ্বরের দ্বৈত তত্ত্বকে মনে রেখে বাম দিকে প্রজ্ঞা চন্দ্র আলি ধমন শূন্যতা এবং দক্ষিণে উপায় সূর্য যমুনা কালি চমন করুণা প্রভৃতি প্রতীক নাম বর্ণিত হয়েছে। চর্যায় সহজানন্দ রূপিণী নৈরাত্মাদেবী—ডোম্বী-চণ্ডালী-শবরী ইত্যাদি নামেও পরিচিতা। ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা স্পর্শনীয়া নন বলেই ইনি বাস করেন ‘নগরের বাইরে”। হরিণী শবরীরূপে মহাবদ্ধ জীবকে কখনো নিজে সন্ধান বলে দেন, কখনো বা তার সঙ্গে মিলিত হয়ে সহজানন্দ সৃষ্টি করেন। বদ্ধ ও মুক্ত দুই শ্রেণীর জীবকে নিয়েই তিনি খেলা করেন। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যায় চর্যাকারেরা চর্যার নিরাভরণ দেহে পরিয়ে দিয়েছেন দীপ্তিময় অলঙ্কার। অসংখ্য রূপক-উপমা যেন তাদের হাত হতে নিক্ষিপ্ত লক্ষ্যভেদী বাণ। প্রথম চর্যায় কায়াকে তুলনা করা হয়েছে তরুবরের সঙ্গে, দ্বিতীয় চর্যায় ‘নৈরাত্মা’ সাধকবধূ রূপে কল্পিতা। পঞ্চম চর্যায় পার্থিব জীবন চলমান নদীর সঙ্গে উপমিত হয়েছে।
চর্যাগীতি কাব্যমূল্য: ধর্মমতের ভেতরে আছে চিন্তা ও অনুভূতি। দুই-ই অমূর্ত। এই অমূর্তকে মূর্ত করতে না পারলে কাব্য হয় না। তার জন্য প্রয়োজন বাক্বৈভব বা অলঙ্কারের। তাই চর্যাকার সহজ-দর্শনের জটিলতম এবং সাধনার সূক্ষ্মতম অনুভূতিগুলিকে প্রকাশ করেছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাষায়। কাব্যের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে সমালোচকেরা কেউ “কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ” (বামন), কেউ বা “ধ্বনিরাত্মাকাব্যস্য” (আনন্দবর্ধন) বলে কাব্যের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন। চর্যাপদে এই দুইয়েরই পরিচয় সহজলভ্য। যেমন বিরোধ অলঙ্কারের একটি দৃষ্টান্ত—“জো সো চৌর সোই সাধি” (‘যে চোর সেই সাধু)। আবার সাঙ্গ রূপকের সুন্দর উদাহরণ—
“মন তরু পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা।
আসা বহুল পাত ফলবাহা ॥”
চর্যাগীতি ভাষানামঃ চর্যাগুলি ‘সন্ধা’ ভাষায় (অর্থাৎ যা ধ্যান করে পাওয়া যায়) রচিত। মতান্তরে এ ভাষা ‘সন্ধ্যা’ ভাষা বা সন্ধিক্ষণের (অর্থাৎ যা অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়) ভাষা—যার অন্য নাম ‘আভিপ্রায়িক’ ভাষা–চর্যাকারদের রহস্যময় প্রকাশমাধ্যম। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতর একটা অন্যভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নহে”। অন্যদিকে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সন্ধা নামক দেশের ভাষাঃ “প্রাচীন আর্য্যাবর্ত্ত ও আসন বঙ্গদেশ এই উভয়ের মধ্যবর্ত্তী প্রদেশের নাম সন্ধাদেশ, এই সন্ধাদেশের ভাষা সন্ধাভাষা”।
আবার বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে, এর নাম হবে সন্ধাভাষা, সং অভিসন্ধায় (লক্ষণাভিসন্ধি করে), অভিপ্রেত্য, উদ্দিশ্য>সন্ধায়>সন্ধা; অর্থাৎ আভিপ্রায়িকী ভাষা বা আভিপ্রায়িক বচন। বিপরীত দৃষ্টিতে ম্যাক্সমুলারের মতে, দুর্বিজ্ঞেয় ভাষা; প্রচ্ছন্ন উক্তি। এ ভাষা যেমন প্রতীকঘনিষ্ঠ তেমনি অলঙ্কারের সুন্দর আশ্রয়। যেমন, কাহ্নপাদ একটি পদে দাবা খেলার রূপকে বলেছেন—
“করুণা পিহাড়ী খেলহুঁ ন-অবল।
সদ্গুরু বোঁহে জিতেল ভব বল !!”
অর্থাৎ করুণার ছক বানিয়ে দাবা খেললাম। সদগুরুর জ্ঞানের দ্বারা সংসারে শক্তিকে জয় করলাম।
ধ্বনিবাদে বাচ্য অপেক্ষা বাচ্যাতীতের প্রাধান্য স্বীকৃত। চর্যায় এই বিশেষত্ব সর্বত্র।
“টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেষী।
হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ।”
এ শুধু বুভুক্ষু মানুষের চিরন্তন আর্তি নয়, এখানে ‘পড়িবেষী’, ‘হাঁড়ী’, ‘ভাত’ প্রভৃতি শব্দে বাচ্যাতীতের ইঙ্গিত পরিস্ফুট।
অনুরূপভাবে, “বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্” সংজ্ঞানুসারেও চর্যাপদকে উৎকৃষ্ট কাব্য বলা যেতে পারে। রসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আদিরস–চর্যায় দেখা যায় এরই প্রাধান্য। যেমন, “রাতি ভইলে কামরু জাঅ” প্রভৃতি পংক্তি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। আবার প্রেম-কামনার পরিচায়ক—“জোইনি তঁই বিনু খনহি ন জীবমি। তো মুহু চুম্বি কমলরস পীবমি”। অথবা শবর-শবরীর মিলনচিত্র–“নাআ তরুবর মৌলিল রে…” ইত্যাদি পদ অনবদ্য।
প্রাচীনতম বাংলা কাব্যের দৃষ্টান্ত রূপে চর্যাগুলি লেখা হয়েছে বিবিধ ছন্দে; যেমন, অড়িল্লা, পঙ্খড়ি (পয়ারের পূর্বরূপ ত্রিপদী, উল্লালা, পাদাকুলক ছন্দ প্রভৃতি। অড়িল্লা ছন্দের দৃষ্টান্ত :
“করুণা পিহাড়ী খেলহুঁ ন-অবল।
সদ্গুরু বোঁহে জিতেল ভব বল ৷৷”
Leave a comment