অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের মধ্যে মনসা মঙ্গল সাহিত্যের আভাময় ঊষাভাস যাঁর লেখনীর স্পর্শে প্রথম প্রস্ফুটিত, তিনি ময়মনসিংহের বোরগ্রামের অধিবাসী কবি নারায়ণদেব। তার আবির্ভাব কাল নির্ণয় আজও সমালোচক শ্রেণীর বিতর্কের বিষয়। নারায়ণদেবের যে বংশতালিকা পাওয়া গেছে সেখানে দেখা যায় নারায়ণ দেবের থেকে বর্তমানে অষ্টাদশ পুরুষ চলছে। চারপুরুষে যদি এক শতাব্দী ধরা যায় তাহলে তাঁর আবির্ভাবকাল খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কবির ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্যে এইভাবে আত্মপরিচয় উদ্ঘাটিত—
“নারায়ণ দেবে কয় জন্ম মুগধি।
মিশ্র-পণ্ডিত নহে ভট্ট বিশারদ ৷৷
পিতামহ উদ্ধব, নরসিংহ মোর পিতা।
মাতামহ প্রভাকর, রুক্মিণী মোর মাতা ।
পূর্বপুরুষ মোর অতি শুদ্ধ মতি।
রাঢ় ত্যাজিয়া মোর বোরগ্রাম বসতি !!”
তার কাব্যের পূর্ণাঙ্গ পুঁথি অবলুপ্ত। কাব্যটি সংক্ষিপ্ত, বিভিন্ন গায়েনের হস্তক্ষেপে তার অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর কাব্যে কাহিনীর সংক্ষিপ্ততা ও বর্ণনাভঙ্গীর আঙ্গিকগত অসংলগ্নতা থাকলেও ভাবকল্পনার দৃঢ়নিবদ্ধ সংহতি সুস্পষ্ট। নারায়ণদেব মনসামঙ্গল কাব্যের “কবি সার্বভৌম” রূপে স্বীকৃত। তার কারণ—
- (১) যে যুগে ধর্মের মনের উপর একাধিপত্য ছিল, সেই যুগে তিনি ধর্মের ভেতর থেকে চিরত্তন মানবাত্মার সুখদুঃখের সন্ধান করেছেন।
- (২) অত্যাচারিত অপরাজিত বীর্যের সুস্পষ্ট ছবি একমাত্র তাঁর কাব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে।
কাব্যের অস্তিম স্তবকে অন্যান্য কবিরা যেখানে মনসাভক্তির বেদীমূলে নমনীত পূজারী চন্দ্রধরের চিত্রাঙ্কনে মুগ্ধবিবশ, সেখানে একমাত্র এই সত্যসন্ধ কবি নারায়ণদেবই তার জ্বলন্ত পৌরুষের ছবি আঁকায় ব্যাপৃত। চরিত্র সৃষ্টিতেও কবি উত্তমর্ণের মহিমা-স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। তাঁর চন্দ্রধর চরিত্রে যে প্রধান রাগটি ভাবমূৰ্চ্ছনায় সঙ্গীতায়িত তা হলো মানবের আদিম পৌরুষ। দৈবশক্তির অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদকল্পে প্রতিহিংসালিপ্সু মানবের চিরক্তন পৌরুষের প্রতীকরূপে তার চন্দ্রধর চরিত্র “মুহূর্তের দীপে শাশ্বত শিখায়” উদ্ভাসিত হয়েছে—
“ডাল মূল গেল মোর মৈদ্ধ হৈল সার।
এখন কানির সনে চাপিয়া করো বাদ ॥
জাদি কানির লাইগ পাম একবার।
কাটিয়া সুজিব আমি মরা পুত্রের ধার ।।”
মহাকাব্যের নায়কের মতো সে শোকে উন্মাদ, প্রতিহিংসায় ভয়ঙ্কর, স্বার্থে সঙ্কীর্ণচিত্ত, কিন্তু সর্বত্রই আত্মগোপনে অক্ষম। স্বপ্রকাশ-মানবতার মহিমায় ভাস্বর তার মনোবেদনা—
“চান্দো বলে এক দুঃখ মৈল সাত বেটা।
তাহা হইতে অধিক দুঃখে কলা জাইব কাটা।”
শুধু চাদসদাগর নয়, বেহুলার চরিত্রাঙ্কনেও তার পরিচয় সমুজ্জ্বল। শুধু গৃহাঙ্গনা নয়, সংকল্প ও আত্মপ্রত্যয়ের পরিচয়ে তিনি অদ্বিতীয়া। তাই “সাথীহারার গোপন ব্যথায়” তার অন্তলোক বেদনামথিত হলেও তার অস্তরে যে সংকল্পের সঙ্গীত সুধ্বনিত তা পাঠকচিত্তে স্পন্দিত হয়—
“জাদি বেউলা হম সতি সাহসে জীয়াব পতি।
জেন জম ঘোষয়ে সংসারে ।।
জাইব দেবের পুরি রজ্ঞায়িব বিষহরি।
আমি জাইয়া জিনিব মনসারে ॥”
বেলা এখানে চিরন্তন নারীর প্রতিনিধিরূপে রেখায়িত মনসা, লখিন্দর ও অন্যান্য চরিত্রও অনুপেক্ষণীয়। মনসামঙ্গল কাব্য মানুষের বেদনাময় অনুভূতির কাব্যসম্মত রূপায়ণ। সেই বেদনা-বিহ্বল সাহানা সঙ্গীতের মূৰ্চ্ছনা নারায়ণদেবের কাব্যেই অধিকমাত্রায় অভিব্যক্ত; যেমন বেহুলার মর্মস্পর্শী বিলাপ স্মরণীয়—
“জাগ প্রভু কালিঙ্গী নিশাচরে।
ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগৱে ৷৷
তুমিত আমার প্রভু আমি যে তোমার।
মড়া প্রভু নহ রে তুমি গলার হার ॥ ”
অন্যান্য কবিদের কাব্যে চাদসদাগরের অবিশ্বাস্য হৃদয়হীনতার জন্য যা অবরুদ্ধ, নারায়ণদেবের কাব্যে সেই বেদনা শতধারায় উচ্ছ্বসিত। একদিকে সংকল্প-বিচ্যুতির হাহাকার, অপরদিকে স্বজনহারানোর সর্বহারা অস্তরের নিঃস্ব আকুতি—এই উভয়ের মাঝে চাঁদসদাগর বারিধৌত বনস্পতির মতই দণ্ডায়মান। তার সাজানো বাগান ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। তার সাধের সংসার বিষাদপুরীতে পরিণত হলো। চারিদিকব্যাপী মহাশূন্যতার মধ্যে একটি বৃহৎ বনস্পতি তার পত্রহীন শাখাপ্রশাখাগুলি রৌদ্রজ্জ্বালাময় আকাশের দিকে প্রসারিত করে তার ভগ্ন হৃদয়ের যে নীরব আর্তি জানিয়ে যাচ্ছে তা যেন অনস্তকালের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে কৌতুকরসের প্রকাশও নারায়ণদেবের কাব্যে দেখা যায়, যেমন ডোমনী চণ্ডীর মহাদেবকে ব্যঙ্গ—
“বানরের মুখে যেন ঝুনা নারিকেল।
কাকের মুখেতে যেন দিব্য পাকাবেল ॥”
তার কাব্যে যে বেহুলার প্রত্যাবর্তন কাহিনী দৃশ্যমান, তার কারণ এটি একটি রূপক। ভারতীয় ধর্মসাহিত্যের আদর্শে বীর বা বীরাঙ্গনা মৃত্যুর পর তার পুনর্জীবনপ্রাপ্তি না দেখালে কাব্য হয় না। তাই তাদের প্রত্যাবর্তনের বৃত্তাস্ত কাব্যের সঙ্গে যুক্ত। বেশিরভাগ কবির রচনায় রূপকের সঙ্গে সত্যের ব্যবধান অবলুপ্ত। কিন্তু নারায়ণদেব সেখানে সফলকাম শিল্পী। লখিন্দরের পুনর্জীবনলাভে চাদের মনে একটা সংঘাতের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই সবাইকার অনুরোধে চাদ যখন মনসার পূজা না করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন তার মনে অসহায়া বেহুলার মুখছবি গভীরভাবে দাগ কাটতে আরম্ভ করেছে। এখানে সে পুত্রবধূ নয়, সে ব্যথিত মানবাত্মার প্রতীক। আর সেই মানবাত্মার প্রতি সহানুভূতিতে চঁাদ আজন্মপূজিত আদর্শের অটুট নিষ্ঠা ত্যাগ করে ব্যথিত মানবাত্মার বেদনাবোধকে স্বীকার করে নিয়েছে। তবুও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তার শাশ্বত পৌরুষ পরিস্ফুট—
“চাঁদ বোলেতোমা পারি পুজিবারে।
আমার নাম চান্দোয়ায় টাঙ্গাও তো উপরে ।”
বাংলা সাহিত্য যখন কোন রকমে অনুবাদ ও অনুকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে তখন এরকম একটি চরিত্রসন্ধান বিস্ময়কর ব্যাপার। আর ততোধিক বিস্ময়কর কাব্য মধ্যে তাকে জীবন্তভাবে অঙ্কন করা। নারায়ণদেবের কাব্য পৌরাণিক সাহিত্যের পরিবেশ শাসিত রুচি-নিষ্ঠার ফসল। কাব্যে প্রতি ছত্রে ছত্রে তা ব্যক্ত হয়েছে। পাণ্ডিত্য কবিত্ব প্রকাশে বাধা না হয়ে এখানে সহযোগসূত্রে আবদ্ধ। বাংলার ঘর ও বাহিরকে এমনভাবে একাকার করে নেওয়ার ক্ষমতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কবিদের মধ্যে বিরলদৃষ্ট।
Leave a comment