সনাতনী সাহিত্যে অভিজাত স্বীকৃতির সূচনা হয় রাজসভায়। দেশ এবং পাত্রের যে প্রসঙ্গ পুরোনো সাহিত্যে লক্ষণীয় তা প্রধানত রাজা-বাদশাহ, সামন্ত প্রভু, জমিদার জায়গীরদার, আমীর-অমাত্যদের নির্দেশে রচিত হত। রুটি যোগাতেন যিনি রুচিরও কর্তা ছিলেন তিনি (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ‘Lord’ শব্দটির ব্যবহার ওল্ড ইংলিশে ছিল ‘Loaf guard’। সম্ভ্রান্ত টিউটনিক বা জার্মান প্রধানদের সম্পর্কে তার প্রথম প্রয়োগ ছিল)। সুতরাং এ সত্য কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, মান্ধাতাগন্ধী সেই অতীতের ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘হাজার আফসান’ ইত্যাদি থেকে কালিদাস, চসার, ধোয়ী, জয়দেব, উইডসিথ প্রমুখ কবিদের রচনার আবেদন যদিও সার্বজনীন, তবু তা প্রথমত এবং প্রধানত ছিল রাজা ও তার সভাসদদের ভোগ্য ও আস্বাদ্য, দরবারী মেজাজ ও রুচি-পরিতৃপ্তির উদ্দেশ্যে রচিত। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী শুকিঙ তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন : “…the history of literature is in large part the history of the beneficience of individual princes and aristocrats. …… In the Middle Ages much of the principal art kept entirely within the general outlook of the bread-giver” (The Sociology of Literary Taste’, Chap. 2, London, 1945, L. L. Schucking),
একথা ঠিক, কোনো যুগই যেহেতু স্বয়ংজাত নয়, তাই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিরাও যে রাতারাতি পূর্বাচার্যদের কাব্যানুশাসনকে এড়িয়ে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাব্য-শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।
মধ্যযুগের অনেক কবি রাজা ও স্থানীয় ভূস্বামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কাব্যের আরম্ভেও আছে রাজপ্রশস্তি, আছে পৌরাণিক দেবতা বা নৃপতির সঙ্গে সমসাময়িক রাজাকে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা। তবু কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের স্বাতন্ত্র্য অনুপেক্ষণীয়—
প্রথমত, রাজসভা থেকে জনসভার দিকে কাব্য পরিবেশনের আগ্রহ (যার নিদর্শন কৃত্তিবাস, মালাধর বসু) কাব্যকে রাজা ও সভাসদদের উপযোগী পণ্ডিতপাঠ্য করে তোলার চেয়ে শ্রোতা সাধারণের উপযোগী সর্ববোধ্য করে তোলার চেষ্টা। কোনো কোনে৷ ক্ষেত্রে রাজসভা থেকে দূরত্ব রক্ষা।
দ্বিতীয়ত, লোকত্রাণ সম্পর্কে সচেতন দায়িত্বপালন, দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন। তৃতীয়ত, পূর্বতন কবিদের কাব্যে পৃষ্ঠপোষক রাজার স্তাবকতা প্রসঙ্গে কেলি-বিলাস-কলার যে কুণ্ঠাহীন উপমা প্রয়োগ দেখা যায়, পরবর্তী কবিদের মধ্যে তার ব্যবহার খুবই সীমিত, নেই বললেই চলে।
চতুর্থত, পূর্বজ কবিদের মত কাব্যরচনার সঙ্গে রাজা সুলতানকে শাসনকার্যের ব্যাপারে বা রাজকার্যে উপদেশ দানের ক্ষমতা (‘সেখশুভোদয়া’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, বণিকবধু মাধবীর শ্লীলতাহানির অপরাধে লক্ষ্মণসেনের কাছে রাজশ্যালকদের বিচারের জন্য গোবর্ধন আচার্য সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন) হয়ত পরবর্তী কবিদের আর ছিল না। তাঁরা রাজার প্রিয়ভাজন হওয়ার চেয়ে লোকপ্রিয় হওয়ার দিকেই যেন বেশি নজর দিয়েছিলেন। সমাজসচেতনতার দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়েছিল ‘লোকত্রাণ’ বা ‘লোকনিস্তারের’ ভাবনায়।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের সীমান্তপর্ব ১৪শ শতক থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত। এই বিস্তৃত কালসীমায় বাংলা সাহিত্য হয়েছিল গৌড়বঙ্গ বা কৃষ্ণনগরের মতো কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় রাজসভার সীমানালগ্ন। অন্যদিকে তীরহুত, চট্টগ্রাম, রোসাঙ (আরাকান), কামতা-কামরূপ প্রভৃতি প্রান্তীয় রাজসভাতেও বাংলাভাষা স্বীকৃত হয়। পাশাপাশি ছিল স্থানীয় ভূস্বামী সামন্তদের কবি-পোষকতার ঐতিহ্য অনুসরণ। তালিকা নির্ভর সেই দীর্ঘায়ত আলোচনার অবকাশ বর্তমানে নেই। তবু তারই মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রাজসভা হল—
গৌড়ীয় রাজসভা : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একাধিক গৌড়ীয় সুলতান এবং সামস্তদের পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস সুবিদিত। তাঁদের সেই পোষকতার ফলে বাংলাদেশে এবং তার বাইরে অনুবাদ সাহিত্যের ধারা দেশীয় ভাষার আশ্রয়ে সচল ও সাবলীল হয়ে ওঠে। রাজা গণেশ বা রুকনুদ্দীন বরবক শাহের আমলে কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরামপাঞ্চালী’ ও মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যরচনার ইতিহাস সুবিদিত। সুবিদিত সুলতান য়ুসুফ শাহের অনুগ্রহে সাবিরিদ খানের এবং সুলতান ফিরোজ শাহের আগ্রহে শ্রীধর দাসের বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনার প্রসঙ্গ। কিন্তু বিচার্য, এর ফলে কবিরা কতদূর পৃষ্ঠপোষকের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন?
‘গৌড়েশ্বর’ সম্পর্কে মালাধর বসু যখন বলেন “গুণ নাই অধম মুঞি নাই কোন জ্ঞান। গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান ।।” কিংবা কৃত্তিবাস “সন্তুষ্ট হইয়া রাজা দিলেন সস্তোক। রামায়ণ রচিতে করিলা অনুরোধ।” তখন দেখা যায় এই অনুরোধ কখনো সীমা লঙ্ঘন করে কাব্যের প্রকরণ ও প্রসঙ্গে রাজ করক্ষেপ হয়ে ওঠেনি।
মালাধর বসুর গৌড়েশ্বরের প্রশস্তিও যেন দূর থেকে উচ্চারিত রাজশক্তির প্রতি প্রণতি মাত্র। এর কারণ প্রথমত, আরবদেশের মনসুর, হারুণ বা মামুদের মতো খলিফাদের অনুরূপ ঔদার্য, সহিষ্ণুতা ও সাহিত্যবীক্ষা তৎকালীন বঙ্গদেশের ইসলামী শাসনবর্গের মধ্যে খুব কমই ছিল, যদিও তুলনামূলকভাবে মুঘল সুবেদারদের চেয়ে তাঁরা ছিলেন সহিষ্ণু এবং হিন্দু পুরাণ সম্পর্কে কৌতূহলী। কিন্তু কবিরা রাজার প্রিয়ভাজন হওয়ার চেয়ে লোকপ্রিয় হওয়ার দিকেই যেন নজর দিয়েছিলেন সমাজসচেতনতার ত্ববোধ জাগ্রত হয়েছিল ‘লোকত্রাণ’ বা ‘লোকনিস্তারে’র ভাবনায় গোবর্ধন আচার্যদের মত পূর্বজ সভাকবিদের কাজকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ ও ক্ষমতার (‘সেখশুভোদয়া’তে দুষ্ট রাজশ্যালকের বিচার-ঘটনা স্মরণীয়) অধিকার ভোগ এযুগের সুলতান-পোষক কবিদের মধ্যে বিরলদৃষ্ট। হয়ত সেইজন্যই রাজসভার বদলে ধর্মিষ্ঠ শ্রোতৃমণ্ডলীর সম্বন্ধেই কবিরা সচেতন হতে শুরু করেন। অবশ্য কবিদের ‘লোকত্রাণ’ চিন্তা ও শাসকদের রাজত্বরক্ষার কায়েমী স্বার্থের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধও দানা বেঁধে ওঠেনি, একথা সত্য।
হোসেন শাহের কর্মচারী চট্টগ্রামের ‘লস্কর’ পরাগল খান ও ছুটি খানের পরমেশ্বর দাস ও শ্রীকর নন্দীর ‘মহাভারত পাঞ্চালী’ মূলতঃ পৃষ্ঠপোষকের শ্রুতিতৃপ্তির জন্য রচিত হয়। এঁদের রাজ-শরণার্থী মনোভঙ্গী শুধু যে “তাহার আদেশমাল্য মাথে আরোপিয়া উচ্চারণেই প্রকট হয়েছে তাই নয়, আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন জানিয়েছেন, কোনো কোনো স্থলে “উচ্ছ্বলিত কৃতজ্ঞতা রসে পয়ারের বাঁধ ছুটিয়া গিয়াছে” (‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’) – “ক্ষৌণী কল্পতরু শ্রীমান দীন দুর্গতি কারণ। পুণ্যকীর্তি গুণাস্বাদী পরাগল খান।”
রোসাঙ রাজসভা : বিষয়বস্তুর বিস্তারিত বৈচিত্র্য এবং আঙ্গিকের নতুনত্ব সন্ধানের সম্ভাবনা সৃষ্টিতে বাংলাসাহিত্য আরাকান রোসাঙের কবি ও পৃষ্ঠপোষকদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয়। “দেশী ভাষে কহ তারে পাঞ্চালীর ছন্দে। / সকলে শুনিয়া যেন বুঝয়ে আনন্দে ॥” ‘লোর-চন্দ্রানী’ (অনুমান ১৬২২-৩৮ খ্ৰীঃ) কাব্যরচনার মুহূর্তে পৃষ্ঠপোষক থিরি-থু-ধম্মার প্রধান অমাত্য আশরফ খানের এই নির্দেশ দৌলত কাজীর কাছে হয়ত যথার্থই প্রেরণাজাগর মনে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি আলাওল তিরিশ বছর বাদে এই কাব্য সমাপ্ত করেন আরাকানরাজ সান্দ-থু-ধম্মার প্রধানমন্ত্রী সুলেমানের নির্দেশে, অথবা তার পরে মাগনঠাকুরের অনুরোধে ‘পদ্মাবতী’ (আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রীঃ) ও ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জমাল’ (১৬৫৮-৭০), সুলেমানের নির্দেশে ‘তোহফা’ (১৬৬৩-৬৯), সৈয়দ মহম্মদের উপরোধে ‘সপ্তপয়কর’ হপ্তপয়কর (১৬৬০ খ্রীঃ), আরাকানরাজ শ্রীচন্দ্র সুধর্মার আদেশে ‘সেকেন্দারনামা’ (১৬৬২ খ্রীঃ) প্রভৃতি কাব্য লেখেন। বার্ধক্যপীড়িত এই কবির প্রতিক্রিয়া আমরা তখন বুঝে নিতে পারি তাঁর “বিশেষতঃ রাজদায় অধিক জঞ্জাল” উক্তিতে।
চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার রাজসভা : রোসাঙ রাজসভায় কবিদের কাব্যচর্চার ধারা চট্টগ্রাম এবং ত্রিপুরার রাজসভার মুসলমান কবিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কোরেশী মাগন ঠাকুর-সৈয়দ সুলতান মহম্মদ খান আব্দুল নবী-আকবর-শগীরএঁরা ছিলেন মুখ্যত অনুবাদক। অনেকে একই কাব্যের একাধিক অনুবাদ করেছেন। এঁদের কাব্য রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
-
(১) বিষয়বস্তুর নির্বাচনে এবং প্রকাশে এঁরা যথাসাধ্য দেবতা ও ধর্মের বিষয় পরিহার করেছেন।
-
(২) কাব্যে প্রধানত মানুষের কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
-
(৩) কাহিনী কথনে অনেক সময় রূপকথার আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন।
এই পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল, কোরেশী মাগন ঠাকুর রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্য। সুধীজনের অনুমান, এই ‘কোরেশী মাগন ঠাকুর’ আর রোসাঙ রাজসভার অমাত্য আর আলাওলের আশ্রয়দাতা ‘মাগন ঠাকুর’ অভিন্ন ব্যক্তি। তবে ইনি জাতিতে মুসলমান কি বৌদ্ধ ছিলেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। পরবর্তী কবি হলেন চট্টগ্রাম পরাগলপুরের অধিবাসী সৈয়দ সুলতান। ইনি ‘‘শবেমেরাজ’, ‘জ্ঞানপ্রদীপ’ এবং ‘নবীবংশ’ নামে তিনটি কাব্য লেখেন। ‘শবেমেরাজ’ এবং ‘নবীবংশে’ আছে ইসলামী তত্ত্ব ও পুরাণ কাহিনী। কবি নবীদের তালিকায় ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব এবং কৃষ্ণের স্থান দিয়ে ধর্মনৈতিক উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তার অনেক রচনা চর্যাপদের মত সাংকেতিক ভাষায় লেখা। কয়েকটি বৈষ্ণব পদও তিনি রচনা করেন। কবি-প্রদত্ত গ্রন্থ-তারিখ দেখে মনে হয়, সৈয়দ সুলতান সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান ছিলেন।
চট্টগ্রামের কবি মহম্মদ খান আরবী ভাষায় লেখা ‘মুক্তাল হোসেন’ কাব্যে কারবালা কাহিনীর পরিচয় দিয়েছেন। এখানে কবি কারবালা কাহিনীর পাশাপাশি নিজের অঞ্চলের কথাও কিছু বলেছেন। তাঁর লেখা, অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলঃ ‘কাসিমের লড়াই’, ‘হানিফের পত্রপাঠ’, ‘কেয়ামতনামা’ প্রভৃতি। কবি তাঁর কাব্যে পিতৃবংশ ও মাতৃবংশের বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাভাষা এবং হিন্দুপুরাণেও তার জ্ঞান ছিল যথেষ্ট।
সপ্তদশ শতকের আর এক কবি আব্দুল নবী ফার্সী কাব্য আমীর হামজা’র বাংলা অনুবাদ করেন। ফার্সীতে লেখা মূল কাব্যটি যাতে বাঙালী পাঠক পড়ে বুঝতে পারে সেইজন্য তিনি দেশী ভাষায় কাব্য লিখতে চান। কিন্তু কবির মনে সংশয় জাগে—
“মুছলমানি কথা দেখী মনেহ ডরাই।
রচিলে বাঙ্গালা ভাসে কোপে কি গোঁসাই ৷৷
লোক উপকারহেতু তেজি সেই ভএ।
দরবারে রচিবারে ইচ্ছিলুম হৃদএ ॥”
‘আমীর হামজা’ কাব্যটি আশিটি পর্বে বিভক্ত। কবি মূল কাব্যের অনুবাদ করার সময় বহু স্থানে স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন।
সৈয়দ মহম্মদ আকবর ‘জেবলমূলক-শামারোখ’ নামে একটি প্রণয়কাব্য অনুবাদ করেন। এখানে জেবলমূলক ও শামারোখের প্রণয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থারম্ভে ফিরিস্তাকে নারদ, হজরত রসুলকে চৈতন্য ইত্যাদি রূপে বন্দনার মধ্য দিয়ে কবির অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। আকবরের কাব্যে আলাওলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সৈয়দ মহম্মদ শগীর ‘য়ুসুফ জোলেখা’ নামে একটি প্রণয়কাব্য রচনা করেন। নাম উল্লেখ ছাড়া কাব্য মধ্যে কবির আর কোন পরিচয় নেই। অনেকের মতে, তিনি চতুর্দশ শতকের কবি। তবে এর পশ্চাতে কোন প্রমাণ নেই।
অন্যান্য মুসলমান কবি : উপরোক্ত কবিরা ছাড়া অখ্যাত বা স্বল্পখ্যাত আরও বহু মুসলমান কবি মধ্যযুগে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন; যেমন মোহম্মদ রাজা, সেরবাজ, আব্দুল হালীম, আব্দুল হাকীম প্রমুখ। বস্তুত, সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এই মুসলিম সাহিত্যধারার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
- (ক) বাঙালি মুসলিম কবিদের ‘হিন্দুয়ালি বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনা।
- (খ) বাংলা অক্ষরের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ব্যবহৃত ফার্সী অক্ষর এবং কিছুটা পরিবর্তিত নাগরী অক্ষরে (শ্রীহট্টের মুসলিম লেখকেরা সিলেটি নাগরীতে লিখতেন) বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা।
- (গ) কিছু কিছু হিন্দু কবিদের প্রণয়মূলক মুসলমানী সাহিত্য রচনার প্রচেষ্টা।
- (ঘ) রোমান্সধর্মী সাহিত্যের বাইরে অধ্যাত্ম-মূলক সাহিত্য রচনা।
- (ঙ) প্রতিবেশী হিন্দুদের ধর্ম ও সমাজ বিষয়ে মুসলিম কবিদের গ্রন্থ রচনা।
- (চ) লোকসাহিত্যের পালা গান প্রভৃতি।
সমালোচকদের মতে, মীরজাফরের পুত্র নবাব নজমুদ্দৌল্লাহ-র কালে অর্থাৎ খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে সম্ভবত হিন্দুয়ালি বাংলার সূত্রপাত হয়। ইউসুফ জুলেখা’ কাব্যটি এই ভাষাতেই লেখা হয়—
“হানিফা খোওাবে কহে তুমি কোন জন।
টুঙ্গির শহরে থাকি বুলিল স্বপন ৷৷
সোনাভান নামে মোর ছিল আরামেতে।
তোমার ছুরত আমি শুনিনু কামেতে ॥”
মনে হয়, সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই বাঙালী মুসলিম কবিরা এই হিন্দুয়ালি ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তবে এই ভাষার বিশেষ সমাদর হয়নি। প্রণয়মূলক মুসলিম সাহিত্য এবং বীরত্বমূলক কাব্য কাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, পশ্চিমবঙ্গের গবিবুল্লা রচিত ‘আমীর হামজা’ কাব্য। এটি কবির আকস্মিক মৃত্যুতে অসমাপ্ত থাকে। পরে সৈয়দ হামজা সেটি সমাপ্ত করেন। গবিবুল্লা ‘য়ুসুফ জোলেখা’ও লিখেছিলেন। অন্যদিকে সৈয়দ হামজা লিখেছিলেন ‘‘হাতেম তাই’, ‘মনোহর মধুমালতী’, ‘জৈণ্ডনের পুঁথি’ প্রভৃতি। চট্টগ্রামের দৌলত উজীর রচিত ‘লায়লি-মজনু’ও একটি সার্থক কাব্য।
কারবালার কাহিনী অনেক মুসলিম ও হিন্দু কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই চট্টগ্রামের কবি নসরুল্লা খান থেকে বীরভূমের রাধাচরণ গোপ পর্যন্ত একাধিক কবি ‘জঙ্গনামা’ রচনা করেন। এ সম্পর্কে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের অভিমত হল : “কারবালার যুদ্ধ, এজিদের কথা প্রভৃতি যে সকল বিষয় দূর-দেশাগত, তাহা মুসলমান কবিরা বিদেশাগত অতিথির ন্যায় গৃহের বাহিরের একখানা একচালায় স্থান দিয়া তৃপ্ত হন নাই, তাঁহারা এমনভাবে সেই সকল অতিথিকে গ্রহণ করিয়াছিলেন যে তাঁহাদের রূপ বদলাইয়া তাঁহারা বাঙালী হইয়া গিয়াছেন” (‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’)।
আধ্যাত্মিক সাহিত্য : আধ্যাত্মিক সাহিত্যেরও কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় এই সময়। এর মধ্যে আছে সুফী ধর্ম বিষয়ক রচনা এবং নামধর্ম-বিষয়ক গ্রন্থ; যেমন— শেখ ফয়জুল্লা রচিত ‘গোরক্ষবিজয়’, সৈয়দ সুলতানের লেখা ‘জ্ঞানপ্রদীপ’, হাজি মুহাম্মদের ‘নব জামাল’, শেখ চান্দ রচিত ‘তালিব নামা’, মীর মুহাম্মদ সফীর লেখা ‘নূরনামা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। বীরত্ব কাহিনীর পরিচয় আছে জয়েনুদ্দিনের ‘রসুল বিজয় কাব্য’, শোকাবহ মহরম কাহিনী স্থান পেয়েছে মহম্মদ খানের ‘মুক্তাল হোসেন’ এবং হায়াৎ মামুদের ‘মুহরম্ পর্ব’ কাব্যে। জীবনীকাব্যের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে ‘তাজ কিরাত’ এবং ‘চাহার দরবেশ’।
মুসলিম হয়েও হিন্দু দেবদেবী ও ধর্ম-বিষয়েও কেউ কেউ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন; যেমন শেখ চান্দের ‘হরগৌরী সম্বাদ’, আলী রেজার ‘আগমজ্ঞান সাগর’, শেখ জাহিদের ‘আদ্যা পরিচয়’, আব্দুর রহিমের ‘মুহাম্মদি বেদতত্ত্ব’ প্রভৃতি। এছাড়াও স্মরণ করা যায়, সাবিরিদ বা শাহ বারিদ খানের বিদ্যাসুন্দর কাব্য’ এবং সৈয়দ মূর্তাজা, শাহ আকবার, নাসির মামুদ, গরীবুল্লাহ ও অন্যান্য অনেক মুসলমান কবির বৈষ্ণব পদ ও শাক্ত পদ রচনার কথা। এঁদের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। মোহাম্মদ খানের এবং করিমুল্লাহ অউধী কবির ‘মৃগাবতী’র অনুসরণে বাংলা কাব্য রচনা করেছিলেন।
মুসলমান কবিদের মধ্যে অনেকে লোক সাহিত্যের পালা গানও লিখেছিলেন; যেমন আমীর সওদাগর, কাফেন চোরা, নছরমালুম, সুরতজামাল ও আধুয়াসুন্দরী, চৌধুরীর লড়াই, নূরন্নোহা ও কবরের কথা, দেওয়ান ভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এদের অনেকগুলি অনুবাদ নয়, স্বাধীন রচনা। স্থানীয় প্রেমকাহিনীও মুসলিম কবিদের কাব্যের বিষয় হয়ে উঠেছিল।
কৃষ্ণনগর সভা :
“চন্দ্রের হৃদয়ে কালী কলঙ্ক কেবল
কৃষ্ণচন্দ্র হৃদয়ে কালি সর্বদা উজ্জ্বল !!”
—পৃষ্ঠপোষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি বিদ্যাসুন্দরের শ্রুতকীর্তি কবি ভারতচন্দ্রের এই প্রশস্তি তাঁর কাব্যের ভাষা-বিষয়বস্তু-রুচিবোধকে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছে একথা অনস্বীকার্য। তবু ভুরসুট পরগনার রাজবংশজাত এই নিঃসম্বল কবির একটি নিরাপদ আর্থিক আশ্রয়ের যে প্রয়োজন ছিল (প্রথমে ৪০ টাকা বেতন পান) এ সত্যও এইসঙ্গে উপেক্ষণীয় নয়। তাই পরবর্তীকালে প্রমথ চৌধুরী যখন বলেন “…কৃষ্ণচন্দ্রের মনোরঞ্জন করতে বাধ্য না হলে তিনি বিদ্যাসুন্দর রচনা করতেন না, কিন্তু তাঁর হাতে বিদ্যা ও সুন্দরের অপূর্ব মিলন সংগঠিত হত, কেন না; Knowledge এবং Art উভয়ই তাঁর সম্পূর্ণ করায়ত্ত ছিল” (“বীরবলের হালখাতা) তখন বাস্তবিক এই সভাকবির ওপর পৃষ্ঠপোষক রাজা ও সভার প্রভাব অনুভব করা যায়। সহকালীন কবি রামপ্রসাদের ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি কৃষ্ণচন্দ্রেরই দেওয়া কিনা পুঁথিতে তার ‘পাথুরে প্রমাণ’ আমরা পাই না ঠিকই, কিন্তু ‘কালীকীর্তন’ উল্লিখিত রাজকিশোর (সম্ভবত, হুগলীর দেওয়ান) নামক ব্যক্তির উল্লেখে মনে হয়, রামপ্রসাদের মত কবিকে তিনি হয়ত একসময় অনুগ্রহ করেছিলেন।
কামতা-কামরূপ রাজসভা : কামরূপ ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। তুর্কীশক্তির আক্রমণেও এ রাজ্যের সার্বভৌম শক্তি ছিল অনাহত। এখানকার অধিবাসী প্রধানত কোঁচ, মেছ, আঁড়ু ইত্যাদি। আসামে দুর্ধর্ষ অহোম-জাতির অভ্যুদয়ে ত্রয়োদশ শতকের শেষে রাজা সু-কাংফার সময়ে ১২২০-৩২ খ্রীস্টাব্দে কামরূপ অহোম রাজগণের কাছে নতি স্বীকার করে। অন্যদিকে কোচশক্তির বিশা কেঁাঁচ বা বিশ্বসিংহের রাজত্বকালে (১৪৯৬-১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দে) কামরূপ প্রাধান্য লাভ করে। এই বিশ্বসিংহের দুই পুত্র নর নারায়ণ এবং শুক্লধ্বজ (চিলা রায়) তারা সুশিক্ষিত এবং সাহিত্যরসিক ছিলেন। আসামের আদি কবি মাধব কন্দলী শঙ্করদেব এবং মাধবদেব এঁদের সমকালেই কাব্য রচনা করেন। এঁদের কাব্য উত্তরবঙ্গের তৎকালীন বাংলা ভাষা কামরূপীয়াতে রচিত হয়। সেইসঙ্গে মৈথিলী ভাষা ও ব্রজবুলির ব্যবহারও দেখা যায়।
শুধু গৌড়ীয় সুলতান বা রোসাঙরাজের অমাত্যরা নন, দেখা যায় কামরূপরাজ বিশ্বসিংহের পুত্র সমরসিংহ কবি পীতাম্বরকে ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ লিখতে বলবার উদ্দেশ্য পুরাণ শাস্ত্রের রহস্য যা কেবল “পণ্ডিতে বুঝায় মাত্র অন্যে না বুঝায়” তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন “সবে বুঝিবার / নিজ দেশভাষা বন্ধে রচিয়ো পয়ার।” তার আর এক পুত্র শুক্লধ্বজ কবি অনিরুদ্ধ বা ‘রামসরস্বতী’-কেও বলেন—“ভারত পয়ার তুমি করিয়ো যতনে।” এছাড়া মনকর দুর্গাবরের ‘মনসামঙ্গল কাব্যেও যথাক্রমে জলেশ্বর ও বিশ্বসিংহের নাম পাওয়া যায়, যেমন পাওয়া যায় ভবানন্দের ‘গোবিন্দরচিত’ কাব্যে দারঙরাজ চন্দ্রবর্মার নামল্লেখ-তথ্য। (সুখময় মুখোপাধ্যায় : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তথা ও কালক্রম’) বিষ্ণুপুররাজের আশ্রয়ে সভাকবি শঙ্কর কবিচন্দ্র ভাগবত অনুবাদ করেন। প্রকৃতপক্ষে মল্লরাজবংশ পরমবৈষ্ণব এই বিষ্ণুপুর রাজাদের প্রতি প্রশস্তিবাচন অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়ের অনেক কাব্যে দেখা যায়, যেমন অনেক মঙ্গলকবির কাব্যে দেখা যায় বর্ধমানের রাজবংশের প্রশস্তি।
স্থানীয় ভূস্বামী : স্থানীয় ভূস্বামীদের আশ্রয়েও মধ্যযুগে বেশ কিছু কাব্য রচিত হয়। বলা বাহুল্য, এইসব ক্ষেত্রে কবিকে ভূস্বামী ধন-সম্পত্তির পরিবর্তে আশ্রয় দিয়ে কাব্য রচনার নিরাপদ পরিবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যেমন আরড়া গ্রামের (উত্তর মেদিনীপুর) জমিদার রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাঁকুড়া রায় ব্রাহ্মণ কবি মুকুন্দরামকে শান্ত ও নিরাপদ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে রঘুনাথের অনুরোধে মুকুন্দরাম ‘চণ্ডীমঙ্গলকাব্য’ রচনা করেছিলেন। কবি-সম্বর্ধনার প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন রঘুনাথ।
গোপভূমের ভূস্বামী গণেশ রায়ের অনুরোধে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে লেখা হয় রূপরামের ‘অনাদ্যমঙ্গল’ বা ‘ধর্মায়নকাব্য’। লেখা হয় ব্রাহ্মণ জমিদার যাদবচন্দ্রের আগ্রহে রামদাস আদকের ‘অনাদিমঙ্গল’ (১৬৬২ খ্রীঃ)। কবি ঘনরাম বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের নামোল্লেখ করে তার ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে বলেন : “রাজার মঙ্গল চিন্তি দেশের কল্যাণ। দ্বিজ ঘনরাম কবিরত্ন রস গান।” এছাড়াও লেখা হয় মেদিনীপুরে কর্ণগড়ের সামন্ত রামসিংহের সভায় পুরাণপাঠক পরে তাঁর পুত্র যশোমন্ত সিংহের সভাকবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবসঙ্কীর্ত্তন কাব্য’।
অনেক ভূস্বামী ছিলেন কবি প্রতিভার অধিকারী, তাঁদের রচিত কয়েকটি কাব্যের মধ্যে আছে; যেমন—পাকুড়ের রাজা পৃথ্বীচন্দ্রের ‘গৌরীমঙ্গল কাব্য’, ভুলুয়ার অধিপতি লক্ষ্মণমাণিক্য দেবের ‘সৎকাব্য রত্নাকর’ কাব্য সঙ্কলন প্রভৃতি গ্রন্থের নামোল্লেখ করা যায়।
Leave a comment