“খুঁজলে আপন ঘরখানা তুমি পাবে সকল ঠিকানা” –সহজ সুরে গভীর ভাবপ্রকাশ করে, আর “লালন কয়, জাত হাতে পেলে পুড়াতাম আগুন দিয়ে” বিদ্রোহের এই রাঙা আলো ছড়িয়ে—ধর্মের গৈরিক বেশে বাউলের সাহিত্যের আসরে প্রবেশ। এই সাহিত্যের জন্ম পল্লী বাংলার মাটিতে। তবু ঘরের সমাজের জাতের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস প্রথম গানে গানে ছড়িয়ে দিল বাউল কবির দল। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে, নিয়মবিধির বাঁধন মেনে মূর্তিপূজায় এদের বিশ্বাস নেই। হিন্দু-মুসলমান ধর্মের জাতের বিভেদ-প্রাচীর ভেঙে বাউল তার মনের মানুষ খুঁজে ফেরে। স্বভাবতই বাউল গানে এই ধূলি-মলিন জগৎসংসার, ঈশ্বরদত্ত দেহ আর অস্তরাকাশের নব নব অনুভূতি, সৃষ্টিরসের উপাদান হয়ে দেখা দিয়েছে।
‘বাউল’ কথার অর্থ, রচনাকালভাষাবিদদের মতে, ‘বাউল’ কথাটি সংস্কৃত শব্দ ‘ব্যাকুল’ কিংবা ‘বাতুল’ থেকে উদ্ভূত। ‘বাতুল’ কথাটির অপভ্রংশ ‘বাউর’। এর অর্থ, অসংলগ্ন বা খাপছাড়া কথাবার্তা বলে এমন পাগল বা উদাসী মানুষ। ‘বাউল’ কথাটি গান ও ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এর উদ্ভব-ইতিহাসও তথ্যের অভাবে অজানা থেকে যায়। অবশ্য গবেষক-সঙ্কলকদের মতে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল। ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, পালযুগের ৪০০ বছর ধরে বাউল ধর্ম বাংলাদেশের প্রকাশ্য ও প্রধান ধর্ম ছিল। সেক্ষেত্রে বাউল ধর্মের উদ্ভব বা আবির্ভাবকাল শুরু হয় আনুমানিক ১০ম শতাব্দী বা চর্যাগীতির সমকালে। এর পরে তা সমাজের শ্রেণীবিশেষের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আবার ১৬২৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে এর নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৬৭৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে এই বাউল ধর্মের পূর্ণরূপ দেখা যায়। ১৭০০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি হিন্দু-মুসলমান ফকির-বৈষ্ণবের মিলিত ধর্মরূপে সারা বাংলায় বাউল সঙ্গীত ও ধর্মের প্রসার ঘটে। (বিস্তৃত তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য : ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, ২য় সংস্করণ, ১৩৭৮, ভূমিকা পৃষ্ঠা ঞ, ট)। কিন্তু বাউল ধর্ম ও গানের সমস্ত অংশ মৌখিক হওয়ার ফলে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত কোন লিখিত তথ্যের দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে নি। ‘বাউল’ কথাটির লিখিত উল্লেখ পাওয়া গেছে মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। যেমন “চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যের মধ্যলীলার একটি পঙ্ক্তিতে (২১/১২৪) শ্রীচৈতন্যদেব প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন—
“আমি তো বাউল, আন কহিতে আন কহি।
কৃষ্ণের মাধুর্য স্রোতে আমি যাই বহি।”
অথবা অদ্বৈত আচার্য মহাপ্রভু নীলাচলে থাকাকালীন বঙ্গদেশে নিত্যানন্দের স্বেচ্ছায় নিয়ম-বহির্ভূত আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি প্রহেলিকাময় ছড়া পাঠিয়ে ছিলেন, যার প্রথম পক্তি ছিল এইরকম— “আউলকে কহিও লোকে হইল বাউল” ইত্যাদি। এখানে ছড়াটির যে-অর্থই থাক, ‘আউল’ শব্দটি সমজাতীয় আরবী শব্দ ‘আউর’ বা সুফী ‘ওয়ালিয়া’ শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। আউল-বাউল শব্দ দু’টিরও একত্র ব্যবহার দেখা যায়। আবার আকুল থেকে ‘আউল’ এবং ‘ওয়ালী’ অর্থাৎ ঈশ্বরের নিকটস্থ ব্যক্তি বোঝাতে ‘ওয়ালীয়া’ শব্দটির ব্যবহারও সুফী ধর্মে আছে, এক সময় আমাদের দেশে মুসলিম সাধক ভক্তেরা ‘আউলিয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলামে দীক্ষিত বাউলদের ‘আউল’ নামে অভিহিত করা হয়। এঁদের আদিগুরু আউলিয়া। বাউলদের সাধনপদ্ধতির সঙ্গে এদের গভীর মিলও আছে। প্রকৃতির মাঝে পরমার্থ সন্ধান এবং নাচ ও গানের দ্বারা ঈশ্বর আরাধনার অনুষ্ঠান এদের মধ্যেও দেখা যায়। সেইজন্য ‘আউল’ বলতে বোঝানো হয়েছে “ইসলামে দীক্ষিত বাউল” (দ্রষ্টব্যঃ ‘বঙ্গ অভিধান’ যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাঃ লিঃ প্রথম সংস্করণ, বইমেলা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৭)। আবার আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন গৌড়ীয় ও সহজিয়া বৈষ্ণব, এবং সুফী বা ফকিরী সাধনার মিলিত ভাবধারায় বিকশিত বাউলদের কথা স্মরণ করেছেন তাঁর গ্রন্থেঃ “হিন্দু, মুসলমানের সবচেয়ে সহজ ও অপূর্ব যোগসাধনা হইয়াছে বাংলাদেশের বাউলদের মধ্যে (‘ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ বিশ্বভারতী ১৩৯৭, পৃষ্ঠা ৯৯)।
সুতরাং বাউলদের মুসলিম (সুফী) ভাবধারার সঙ্গে সংযোগের কারণ অনুভব করা যায়। অনুমান করা যেতে পারে, লোকসাধনা ও লোকসঙ্গীত রূপে ভারতবর্ষে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে বাউলগীতির বিস্তার ঘটেছিল।
বাউল এবং চৈতন্যপ্রসঙ্গ :
বাউলদের গান, ধর্মতত্ত্ব এবং সাধনরীতির মধ্যে নানাভাবে চৈতন্যপ্রসঙ্গ, চৈতন্যবন্দনা এবং চৈতন্যপ্রভাবের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণবধর্মের বিভিন্ন রূপ ধারণের ক্ষেত্রে সহজিয়া ধর্মশাখাটি ছিল বিশেষ শক্তিশালী। এখানে বৈষ্ণবধর্ম ছাড়া বৌদ্ধ-তন্ত্র-নাথ-সুফী প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের কিছু কিছু প্রভাব দেখা যায়। এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ শাখা রূপে বাউলদের আবির্ভাব ঘটে। এরা ঈশ্বরপ্রেমে ব্যাকুল, ভাবরসে বিভোর অথচ উদাসীন। ধর্মের সংস্কার, বিধি-নিষেধ, প্রভৃতি শাস্ত্রীয় নিয়ম পালনে অনিচ্ছুক, কিন্তু রহস্যময় ক্রিয়াকর্ম, অসঙ্গতিতে পূর্ণ, গুপ্ত জীবনচর্যায় অভ্যস্ত। এরা রাগমার্গের সাধনাকারী। আবার ঈশ্বরের অলৌকিক মহিমা এবং স্বর্গীয় কল্পনার পরিবর্তে মর্ত্যের জাতিভেদহীন প্রত্যক্ষ মানুষরূপের বা মানবরূপী ঈশ্বর ভজনায় এরা আত্মস্থ। আর এই মানবরূপী ঈশ্বর মহিমার গুণকীর্তনে বাউল ধর্ম এবং গান নিজস্ব দৃষ্টিকোণে শ্রীচৈতন্য এবং রাধাকৃষ্ণ ভাবরূপকে ব্যাখ্যা করেছে ; যেমন বাউলগানের আদি কবি লালন ফকির গেয়েছেন— “এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন/তাই তো মানুষরূপ গটলে (গড়লে) নিরঞ্জন” (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত, গান নং ১)।
আর একটি গানে আছে— “কেঁদে কয় লালন আমার নাই উপায় গোরাচঁাদ বিনে” বা “গৌর এসে হৃদয়ে বসে করে আমার মন চুরি” প্রভৃতি। এইভাবে শ্রীচৈতন্য ও গৌরলীলা সহ কৃষ্ণ-রাধা-গোপী গোকুল-বৃন্দাবনের নানা প্রসঙ্গ এমন কি নিত্যানন্দ, জয়দেব-পদ্মাবতী, বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণি। রামী চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি-লছিমাবাঈ ইত্যাদি বৈষ্ণবীয় নারী-পুরুষের কথা বাউল গানে স্থান পেয়েছে।
হিন্দু এবং ফকির বাউল :
বাউল ধর্মে এবং জীবনাচরণে জাতিভেদ নেই। তবে এখানে সহজিয়াপন্থী হিন্দু বাউল এবং সুফীপন্থী মুসলমান ফকির বাউলের (আউলিয়া) দুটি শ্রেণী আছে। এদের মধ্যে ক্রিয়াকর্মে যে স্বাতন্ত্র্য দেখা যায় তা হল—
- (১) হিন্দু বাউলরা সহজিয়া বৈষ্ণবদের মত দেহের মধ্যে অসীম প্রেমরস উপলব্ধি করতে চায়। সহজিয়ারা প্রকৃত মানুষের উপর রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব আরোপ করে অদ্বৈতানুভূতি সন্ধান করে।
- (২) হিন্দু বাউল দেহের মধ্যে ‘মনের মানুষ’, ‘অচিন পাখি’, ‘অধরা’ মানুষকে ধরতে চায়। তারা সীমাবদ্ধ মানবসত্তাকে ভাগবতীসত্তায় এক করে দিতে উৎসুক, অর্থাৎ দেহের ক্ষুদ্র আমিকে অসীম অখণ্ড আমির সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।
- (৩) হিন্দু বাউলরা সাধনার লক্ষ্য রূপে ‘জেস্তে মরার’ (জীবস্মৃত) কথা বলেছেন। এই ভাবটি হল, প্রেমরসে বিভোর হয়ে সচেতন সত্তার অবসান বা বিস্মৃতিতে মনের বিবশ অবস্থা। এই অবস্থা শ্রীচৈতন্যদেবের দিব্যোন্মাদ বা ভাবোন্মত্ত অবস্থার অনুরূপ।
‘জেন্তে মরা’ এবং ফণা:
সুফী ধর্মের সাধনা ও আদর্শ জানা পরস্পরবিরোধী বৈচিত্র্যে পূর্ণ। সমালোচকের ভাষায় ‘Sufism…….. is a very complex pheno menon (8: A History of Sufism in India’, Saiyid Athar Abbas Rizvi. Vol I, New Delhi, 1978, p. 397)। তবু এই ধর্মের উদার প্রেমভাবনা বাউলদের বিশেষভাবে মুসলিম বাউলদের ফকিরী-সাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁরা শেষে এই সুফী ধর্মের আদর্শেই আল্লার সমীপস্থ সাধক রূপে নিজেদের ‘আউলিয়া’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। হিন্দু বাউলদের ‘জেন্তে মরা’র ভাব সাদৃশ্য সুফী সাধনায় ‘ফণা-ওয়া-বাকা’ (দ্রষ্টব্য : ‘Fana-wa-Baqa-dying to self and living in god. Dr. Roma Choudhuri, ‘Sufism and Vedenta’, Part II. p. 44) ভাবকল্পনার মধ্যেও পাওয়া যায়। ঈশ্বর অনুরাগের গভীরতায় আত্মবোধ বিলোপ বা বিস্মৃতিকে বলা হয় ‘ফণা’। এই ঈশ্বর বিভোরতায় থাকা বা তুরীয় অবস্থা ‘আউলদের’ মধ্যেও দেখা যায়। এই অবস্থার নাম ‘দিওয়ানা’ বা উন্মত্ত অবস্থা। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন সুফী শব্দ ‘দিওয়ানা’ এবং ‘বাউল’ বা ‘বাউর’ শব্দ একই ভাবার্থক : “With the Bengali word ‘baul’ we may also compare the Sufi word Diwana which means mad” লালন ফকিরের গানে এই ‘জেন্তে মরা’ এবং ‘দিওয়ানা’ দুরকম ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়; যেমন—প্রথমটির দৃষ্টাত্ত : “একাত্ত যে অনুরাগী জেত্তে মরা ভয় ত্যাগী।”
আবার এই লালনের আর একটি গানে শোনা যায়—
“পাগল দেওয়ানার মন কি ধন দিয়ে পাই….
ও সে পাগল ভেবে পাগল হলাম,
আপন পর তো ভুলি নাই।”
আবার পাঞ্জ সাহের একটি গানে আছে—
“যে জানে ব্রজগোপীর মহাভাব
ও সে জেত্তে মরে কৃষ্ণপ্রেমের করিছে আলাপ।
অনুরাগের জোরে বিধির কলম নাহি সে মানে,
বেদ-বেদান্ত দূরে রেখে করে প্রেমালাপ ॥”
মুসলিম বাউল ও হিন্দু বাউলদের মধ্যে ঐক্য :
মুসলিম বাউল আর হিন্দু বাউলদের মধ্যে ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে কিছু সাদৃশ্য আছে; যেমন মুসলিম বাউলদের ‘ফণা’ আর হিন্দু বাউলদের ‘জেন্তে মরা’ একই ব্যাপার। মুসলিম বাউলদের দৃষ্টিতে ‘ফণা’ মানে ব্যক্তিসত্তার বিলোপ সাধন। সুফীরাও বলেন, সকলকে ভালোবাস এবং অপরের কল্যাণসাধনায় আপনার স্বাতন্ত্র্যের সম্পূর্ণ বিলোপ কর— Sufi’s message to the individual is Love all, and forget your own individuality in doing good to others.
মুসলিম বাউল জানেন, নবী (আল্লাহর জ্যোতি) এবং সাধারণ মানুষ সকলের মধ্যেই আল্লাহ্ আছেন। তবে সাধারণজনের মধ্যে আল্লা প্রচ্ছন্ন। নবীদের মধ্যে তার পূর্ণ স্বরূপ প্রকাশিত। আল্লার প্রেমে যারা ‘মজ্জুব’ বা মাতোয়ারা এবং ‘দিওয়ানা’ বা পাগল হয়, শুধুমাত্র তারাই তাঁকে লাভ করে। সুফী ধর্মে আছে চার প্রকার সাধনার কথা—
- (ক) ‘ফণা কিস শেখ’ অর্থাৎ গুরুর মধ্যে বিলীন হওয়া।
- (খ) ‘ফোন ফের রসুল’ অর্থাৎ, ঈশ্বরের অবতারের মধ্যে লীন হওয়া।
- (গ) ‘ফোনা ফিস আল্লা’ অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে বিলীন হওয়া।
- (ঘ) ‘বকাবিল্লা’ বা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। আবার
- (ঙ) হিন্দু বাউলের যিনি ‘গুরু’, তিনিই মুসলিম বাউলের চোখে ‘মুর্শিদ’ এবং পরম ঈশ্বর বা ‘সাঁই’।
বাউল তত্ত্ব ও সাধনা :
বাউল তত্ত্বের উৎস বিচিত্র। বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়, সুফী আউলিয়া ভাব, নাথ সম্প্রদায়ের শৈব ভাবনা, যোগতন্ত্র, হঠযোগ ইত্যাদি ধর্ম ও উপধর্মের কায়াসাধন তত্ত্ব, উপনিষদের পরমাত্মা প্রভৃতি সব কিছুই এখানে উপস্থিত। তবে গৃহ্য-ক্রিয়াকর্মের অনেকটাই প্রধানতঃ দেহাশ্রিত। এর তান্ত্রিক প্রক্রিয়া বহু ক্ষেত্রে রুচিহীনতার জন্যই নিন্দিত। বাউল তত্ত্বে আসলে, বাউলরা নরনারীর দেহকে রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত দেহরূপে কল্পনা করেন। তাঁদের মতে, জীবদেহে সব আছে— “যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাহা আছে দেহ ভাণ্ডে।” দেহের মধ্যেই মনের মানুষের উপস্থিতি, দেহমন্দিরেই ভগবানের অধিষ্ঠান। এই দেহের মধ্যেই রাধাকৃষ্ণ বা শিবদুর্গার মিলনানন্দ অনুভব করে বাউল সাধক মোক্ষলাভের প্রথম সোপানে পৌঁছন। আর এক ধরনের বাউল নারী-পুরুষে মিলে কামকে প্রেমে পরিণত করেন। দৈহিক আসক্তি ও দেহভোগের মধ্য দিয়ে দেহাতীত সূক্ষ্ম সত্তাকে উপলব্ধি করাই তাদের উদ্দেশ্য। জড়সত্তাকে বিনষ্ট করে দেহে ও মনে পরমার্থ সন্ধানী হয়ে উঠাই বাউল তত্ত্বের মর্মকথা। এই পরমার্থকে বাউল নাম দিয়েছেন ‘সাঁই’।
বলা বাহুল্য, কায়াসাধন পদ্ধতি এখানে রক্ত-মাংসের আশ্রয়ে অনুষ্ঠিত। তাই তারা নীর ক্ষীর তত্ত্ব (রজঃ ও শুক্র), চারি চন্দ্রতত্ত্ব গোপনে অনুষ্ঠান করেন। বাউল সাধক স্ত্রীধর্মের তিন দিনে নারীদেহ অবলম্বন করে চতুর্থ দিনে ‘অধরা’কে খুঁজে পান। নারী পুরুষের আশ্রয়ের অচঞ্চল আনন্দানুভূতিকে ঊর্দ্ধগামী করে সহজস্বরূপ ‘মনের মানুষে’র সঙ্গে মিলিত হন। বস্তুত, প্রকৃতি পুরুষের বিশেষ মৈথুনজাত মহোল্লাস থেকে বাউল সাধনার পরমতত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত দেহসুখ লক্ষ্য নয়, পরমার্থ লাভ করাই তাঁদের উপলক্ষ্য হয়। দেহযন্ত্র বাজিয়ে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অর্থাৎ পরমসত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়াই বাউল ধর্মের মূল কথা।
দুই সাধনরীতি :
সাধনরীতির দিক থেকে বাউল সাধনার দুটি পর্যায় আছে— একটির নাম ‘পুথ্যা’ অন্যটির নাম ‘তথ্যা’। প্রথম পর্যায়টি হল পুঁথি বা শাস্ত্র অনুসারী। পুথ্যা-পর্যায়ে সাধনক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবে নানা তান্ত্রিক জটিল অনুষ্ঠানাদির সঙ্গে সাধন সঙ্গিনী ব্যবহার করা হয়। এই অনুষ্ঠান প্রক্রিয়া বাউল সাধনার পশ্চাৎপট মাত্র। এই অনুষ্ঠানকারী বাউলেরা অন্যদের চোখে ‘বস্তুবাদী বাউল’ ব’লে চিহ্নিত।
“বস্তুবাদী বাউল আদ্য কেহ কেহ কয়” (৩৭৩)।
অর্থাৎ যারা ‘তথ্যা’ পন্থী বা আচার সংস্কারহীন ভাববাদী প্রেমমার্গের সাধক, তারা এই সাধনসঙ্গিনীর বা কামাচারের পথ এড়িয়ে চলেন। তাঁরা জানেন—“মেয়ে সর্বনাশী জগৎ ডুবায়”, “যাতে জনম তাতেই মরণ”, “বে হুঁশিয়ারী হলে পরে হারাবি অমূল্য ধন”, “মেয়ে যাকে স্পর্শ করে পাঁজরাকে ঝাঝরা করে’, ‘তোর দফারফা হয়ে গেছে কুহকেতে পড়ে” ইত্যাদি। আর এই জাতীয় বাউল সাধকেরা শুদ্ধ অনুরাগে মনকে প্রেমের রঙে রাঙিয়ে তোলেন। তাই লালনের গানে আছে—“অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়” (৫৮)।
সমালোচকের দৃষ্টিতে “কামনাবাসনামুক্ত সেই শুদ্ধ প্রেম ও অনুরাগের সন্ধানেই বাউলদের মুখ্যতঃ গৌড়ীয় ভাবানুগত্য, কৃষ্ণ-রাধা ও অন্যান্য গোপীদের আশ্রয়-প্রার্থনা, গৌর বন্দনায় শ্রীচৈতন্যদেবের কাছে নিঃশেষ আত্মসমর্পণ – “আমার নাই উপায় গৌরচঁাদ বিনে।” “কামের আশ্রয়ে নয়, তার পরিপূর্ণ বর্জনের মধ্যেই নিহিত আছে এ সকল যথার্থ বাউল সাধকের খাঁটি প্রেমে উত্তরণের সাধনা”। কামাচারের বিপক্ষে তাই সাধক বাউল বার বার তাঁর গানে সতর্ক করেছেন—
“আগে কপাট মারো কামের ঘরে
মানুষ ঝলক দেবে নেহারে ॥” (১৬৬)
অথবা –
“কামে রত যত জনা
পথ থাকিতে পথ পাবে না,
ঘাটে গিয়ে হবে কানা সেই সময়” (২৪৩)।
এর বিপরীত চিত্র ধরা পড়েছে বাউল সাধক ঈশানের গানে—
“প্রেম তারে যার মন বান্ধা
তার কি আছে কোন ধান্ধা,
কাম-ঊর্মিতে তার কি করে” (৩৪০)।
বাউল কবি পদ্মলোচনও হৃদয়জাত শুদ্ধ প্রেমের দ্বারা রসিকের রূপ দর্শনের কথা বলেছেন—
“ওরে হৃদবদ্ধ ঘরে রাগের জোরে
রসিক যারা রূপ নেহারে” (২১১)।
প্রকৃতপক্ষে, বাউলদের গোপী অনুগত স্বার্থহীন প্রেম বা একান্ত অনুরাগের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রেমভাবনার ধারাটি মিশে গেছে। তাই বাউলগানে এবং সাধনায় গোপীপ্রেমের প্রসঙ্গ বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে ; যেমন লালন ফকিরের একটি পদে আছে—
“যেজন গোপী-অনুগত
জেনেছে সেই নিগূঢ় তত্ত্ব ;
লালন কয় রসিক মত্ত
পেয়ে সেই রসের ঠিকানা” (১১৩)।
বাউল গানে মানবতত্ত্ব :
বাউল সাধনার প্রধান মন্ত্র সঙ্গীত। গুপীযন্ত্র বা একতারার সাহায্যে বাউল মানবতত্ত্বের বাণী শুনিয়ে জগৎবাসীকে মুগ্ধ করে; যেমন—
“এমন মানবজন্ম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে ৷৷
অনস্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই।
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই ৷৷”
(১) এই মানবসাধনা ও মানবমহিমার প্রচার করে বাউল বলে, এই মানুষ বিশ্বস্রষ্টা অলখ নিরঞ্জনের আপন হাতের সৃষ্টি। মুনি-ঋষিরা যাঁকে চার যুগ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, বাউলের মতে, “এই মানুষে সেই মানুষ আছে” (৫০) অথবা—
“মানুষের আকার ধরে,
খোদ খোদা যে ঘোরে ফেরে” (৩৯৭)।
আর সেইজন্য বাউল সাধকের কাছে—
“মানুষতত্ত্ব ভজনের সার” (৮৫)।
তাই সাধক দুদ্দু শাহ, পাঞ্জ শাহ, কেদার বাউল প্রমুখ সকলেই মানবতত্ত্বের বা মানবমহিমার কথা বলেছেন, যেমন :
দুদ্দু শাহ—
“যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল” (৪১২);
কেদার বাউল—
“নররূপে কেঁদে বেড়ায় তোমরা যারে বল নারায়ণ
……মানসেতে পূজব এবার মানুষ শ্রীচরণ” (454) ;
পাঞ্জ শাহ—
“এই মানুষের রঙ্গ-রসে বিরাজ করে সাঁই আমার ॥”
অথবা—
“পাঞ্জ বলে, মানবলীলা করেছেন সাঁই চমৎকার।
মানুষ ভজে’ মানুষ ধর, মন, যাবি দুই ভব পার ৷৷” (২৮২)।
মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে লালন ফকিরের কাছে সাধন-পূজন-ভজন-আরাধনা-দেবদেবী শাস্ত্রগ্রন্থ সব অর্থহীন মনে হয়েছে। তাই তিনি প্রশ্ন করেছেন—
“মানুষ তত্ত্ব যা সত্য হয় মন
সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।”
জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে গভীর মানবপ্রেম ও মানবমহিমা, জীবনমাধুর্য ও লীলাবাদের কথায় বাউল গান তাই সাধনসঙ্গীত হয়েও মানবগীতি হয়ে উঠেছে।
বাউল সঙ্গীতে অসাম্প্রদায়িকতা :
বাউল সঙ্গীতের এক মহৎ লক্ষণ— অসাম্প্রদায়িকতা, গৌড়ীয় ও সহজিয়া বৈষ্ণব এবং সফু বা ফকিরী সাধনার ভাবধারায় তারা উজ্জীবিত। বাউল গানে প্রথম থেকেই অসাম্প্রদায়িক রূপটি স্পষ্ট হয়। ভারতবর্ষের সনাতন জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় বাউল কবি সর্বদাই কুণ্ঠাহীন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ এবং কট্টর মুসলিম মোল্লা উভয়ের প্রতি তীব্র তিরস্কার বা ভর্ৎসনায় মুখর। জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে সমালোচনার সৎসাহস দেখিয়ে বাউল ধর্ম ও গান আধুনিক শ্রোতা পাঠকের মনে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। যেমন—
“জাতাজাতি সৃষ্টি করে ভারতকে শ্মশানে দিলে।
যত সব কায়েত বামন অবশেষে এই বুঝিলে॥”
তারা অপৌত্তলিক দৃষ্টিভঙ্গী, হিন্দু-যবন, শূদ্র-বৌদ্ধ সমদৃষ্টি মনুষ্যত্বের মহিমা সগৌরবে ঘোষণা করে—
“শূদ্র, বৌদ্ধ, ইতর, মুসলমান
সবি তো এক মায়ের সন্তান,
ভারতের মাটিতে সবারই প্রাণ,
কেউ না দেখিলে ৷৷
রচিয়া জাতির বেড়া; দেবতায় করলে দেশছাড়া,
মানুষ ছাড়িয়া নোড়া সবাই পূজিলে ৷৷” (৪০২)।
সকল সৃষ্টির মূলে অদ্বিতীয় একের কথা দুদ্দু শাহও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—
“ধলা-কালার একই বীজ ভাই
সব জাতি যাতে হয় উদয়” (৪০৪)।
অনুরূপ কথা লালনও বলেছেন—
“ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে তাঁর কাছে জাতির বিচার নাই ৷৷” (১০২)।
প্রকৃতপক্ষে, এই জাতবিচারের অনুপস্থিতিই বাউল-সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। বাউলশ্রেষ্ঠ লালন ফকিরের সম্বন্ধে কিংবদন্তী আছে, হিন্দু ধর্মের নানা কুসংস্কার ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি এক ফকিরের কাছে বাউল ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
তাই লালনের এই গান জাত বিচারের কঠোর সমালোচনা এবং মানবপ্রীতির এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে—
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয় জেতের কি রূপ, দেখলাম না এ নজরে….
কেউ মালা কেউ তসবী গলায়
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জেতের চিহ্ন রয় কার রে॥” (১৬০)।
বিশ্ব জুড়ে লোকে যে জাতের কথায় গৌরব করে, এই গানের শেষ কথায় তিনি গভীর আত্মপ্রত্যয়ে বলেছেন—
“লালন সে জেতের ফাতা
বিকিয়েছে সাত বাজারে।”
অনেক সময় তিনি অন্যের কথার উত্তরে জানিয়েছেন—
“সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান
একই ঘাটে যাওয়া আসা যাওয়া,
একই পাটনী দিচ্ছে খেয়া,
কেউ খায় না কারও ছোঁওয়া,
বিভিন্ন জল কে কোথায় পান॥”
জাত-নির্ভর বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে লালন ফকিরের তীব্র ক্ষোভের সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে এই পদে—
“জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয়, জাত হাতে পেলে পুড়াতাম
আগুন দিয়ে।” (১২২)
আবার লালন ফকিরের মত পাঞ্জ শাহ বাউল ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেছেন—
“জেতের বড়াই কি।
ইহকাল পরকালে জেতে করে কি॥
আমার মনে বলে অগ্নি জ্বেলে দিই জেতের মুখি॥” (৩১৫)।
তাই শেষে তীব্র ব্যঙ্গে বলেছেন—
“মৃত্যু হলে যাবে চলে,
জেতের উপায় হবে কি !!”
পাঞ্জ শাহের অনেক গানে আল্লা-শ্রীচৈতন্য রাধাকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ অভিন্ন ভাবে স্থান পেয়েছে। এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের বশেই বাউল সাধক কোনো সুনির্দিষ্ট কৃত্য বা গণ্ডীবদ্ধ ভাবনায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে নি।
বাউলগান ও মিস্টিক ভাবনা :
বাউল গান বাউল-সাধকের ধ্যানমস্ত্র। বাউলতত্ত্ব এই গানে নানা স্থানে আছে, তবে সর্বত্র নয়। বস্তুতঃ বাউলতত্ত্ব কোথাও বাউল গানকে আচ্ছন্ন করেনি। বরং মরমিয়া ভাবনায় মিস্টিক-রহস্য ছড়িয়ে তা যুগে যুগে সংবেদী মানুষকে আকর্ষণ করেছে। ‘মনের মানুষ’, ‘অধরা’, ‘অচিন পাখি’, ‘ভবনদী’, ‘রসিক পুরুষ’, ‘দয়াল’ প্রভৃতি শব্দের আড়ালে সৃষ্টিতত্ত্ব, সৃষ্টি ও স্রষ্টার লীলাবাদী রহস্য বাউল কবি প্রকাশ করেছেন নানাভাবে। যেমন—
“আছে যার মনের মানুষ আপন মনে
সে কি আর জপে মালা
নির্জনে সে বসে বসে দেখছে খেলা॥”
কোথাও বা লালনের গানে অচিন পাখীর কথা বলা হয়েছে—
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কমনে আইসে যায়
(আমি) ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখীর পায়।
চিরকালটা পুষলেম পাখি
বুঝলেম না তার ফাকি-জুকি
দুধ কলা দিই খায় রে পাখী তবু ভোলে না তায়।”
আবার ‘ভবনদীর’ যে চিত্রকল্প চর্যাকবির কল্পনায় দেখা দিয়েছিল তা বাউল কবির মধ্যেও ধারাবাহিত হয়েছে। দুদ্দু বা অন্য বাউল কবির পদে পাওয়া যায়—
“আমার আসা যাওয়া ফুরাবে কবে।
ভবনদীর মাঝে বারে বারে যাই গো ডুবে” (৪১৭)।
কোথাও বা লালন বলেছেন—
“এসো দয়াল আমায় পার করো ভবের ঘাটে” (২০)।
সীমার বন্ধন থেকে মুক্তির বাসনা মিস্টিক কবির স্বভাবজাত। রসিক বাউল জীবনের সুখ-দুঃখ দিবারাত্রির ঊর্দ্ধস্তরে নির্বিকল্প জগতে পরমার্থের সন্ধানী। এমন কি, কালনদীর খরধারাও তার অজানা নয়। সেই ধারায় কত ধনীজনের ঐশ্বর্য-তরণী ভেসে যায়। কিন্তু রসিক সাধক সেই নদীর ধারা চিনে সুখ-দুঃখ জন্ম-মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করেন—
“কত ধনীর ভরা যাচ্ছে মারা পড়ে নদীর ভর তুফানে।
ভবে রসিক যারা পার হয় তারা তারাই নদীর ধারা চিনে।”
এই কালধারার বশবর্তী না হয়ে বাউল কবি তার মনের মানুষ’ বা ‘মনের রতন’ খুঁজেছেন নিজের মধ্যে। লালন কবির মতে, এই রতনকে খুঁজে পাওয়াই উপাসনা—
“আপনাকে আপনি চেনা
সেই বটে উপাসনা।”
কখনও কখনও বাউলের সাধনতত্ত্ব মিস্টিক চেতনায় রহস্যময় হয়ে উঠেছে—
“চেয়ে দেখ কারে মন দিব্য নজরে
চারি চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মণিকোঠার ঘরে।”
বাউলগান ও রবীন্দ্রনাথ :
বাউলগানের এই রহস্যময়তা মরমিয়া ভাবের সহজ সরল প্রকাশ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মনে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বহু রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বাউলগীতির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা যায়। যেমন—সাধক দ্বিজদাসের একটি গানে আছে
“একদিন যদি আমায় ছাড়
দেখি কেমনে থাকতে পার,
ছাড়াতে চাই বেড়ে ধর,
দায়ে ঠেকছি আমি তাই !”
অনুরূপ ভাব রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র “তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর” গানের মধ্যে অনুভূত হতে পারে। আবার “আমার আসা যাওয়া ফুরাবে কবে” ইত্যাদি বাউল গীতের পাশে ‘খেয়া’ কাব্যের ‘শেষ খেয়া’ কবিতার ভাব সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বাউল সঙ্গীতের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও তার সহজ সরল প্রকাশরীতি সম্পর্কে আলোচনায় প্রথম শিক্ষিতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর কণ্ঠে বহু গান বাউলগীতির ভাবে ও সুরে বাঁধা হয়েছে। তার রহস্যময় মরমিয়া সংলাপ একান্তভাবে বাউলদের মানবকল্যাণ ও একক সাধনার সুরে অনুরণিত। আবার বাউলদের ‘মনের মানুষে’র উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে যেমন— “বিশ্বদেবতা আছেন, তাঁর আসন লোকে লোকে, গ্রহ চন্দ্র তারায়। জীবনদেবতা বিশেষভাবে জীবনের আসনে, হৃদয়ে হৃদয়ে তার পীঠস্থান; সকল অনুভূতি, সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে। বাউল তাকেই বলেছে মনের মানুষ। এই মনের মানুষ, এই সব মানুষের জীবনদেবতার কথা বলবার চেষ্টা করেছি ‘Religion of Man’ বক্তৃতাগুলিতে” (দ্রষ্টব্যঃ রবীন্দ্র রচনাবলী ১০ম খণ্ড, বিশ্বভারতী, সুলভ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৬৫৯)। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, গগন বাউলের “আমি কোথায় পাব তারে” গানটির সুর সংযোজন করে তিনি লিখেছিলেন—
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।”
লালন ফকিরের মানবিকতাবোধ, চলিত ভাষা বা মুখের ভাষাকে গান রচনায় প্রাধান্য দেওয়া রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। অক্সফোর্ড বক্তৃতায় তিনি লালনকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বস্তুতঃ বাউল চরিত্রের বেশবাস, তাদের গানের সুরবৈচিত্র্য, মানবভাবনা, মিস্টিক কল্পনা রবীন্দ্র-চিত্তে এক দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। এমনকি, বাউলদের অনুরূপ পোশাক বা আলখাল্লাকে কবি তাঁর প্রিয় পরিচ্ছদ ব’লে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকে ঠাকুরদা, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগী প্রভৃতি বাউল গীতি সাধকের মাধ্যমে দুঃখ-ভোগের মধ্যে ত্যাগ ও সহ্যশক্তির মহিমা মানবরূপী ঈশ্বরের ভাবকল্পনা আভাসিত হয়েছে ; যেমন ধনঞ্জয় বৈরাগীর সংলাপ—
“যেদিন থেকে জন্মেছি, আমার এই গাঁয়ে তিনি কত দুঃখ সইলেন
কত মার খেলেন, কত ধুলোই মাখলেন-হায় হায়”
আবার বাউল সঙ্গীতের সামাজিক আবেদনও তাঁর চিত্তে নাড়া দিয়েছে। “এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরাণে-পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি। এই মিলনেই ভারতের সত্য পরিচয়, বিরোধে বিবাদে বর্বরতা।” ইস্কুল-কলেজের শিক্ষার বাইরে বাংলাদেশের গ্রামের অখ্যাত পরিবেশে বাউল গান “হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে” দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন।
বাউল গানের কাব্যমূল্য :
বাউল গান কবিতার মত আবৃত্তি-নির্ভর নয়, গেয়। বিশেষ ধরনের সুর মূৰ্চ্ছনায় ও একক নৃত্য যোগে তা রসিক মানুষকে আকৃষ্ট করে। বাউল সাধক অরূপ রসের সন্ধানী। এই অরূপ ভাবকে বোঝাতে চেয়ে তাঁরা সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় পরিচিত রূপক উপমাদি অলঙ্কার ও প্রতীকের সাহায্য নিয়েছেন। এইসব রূপক-উপমার মধ্যে আছে খাঁচা, অচিন পাখী, রান্নাবান্না, ঘর-বাড়ী, তাঁবা, দস্তা, চাষা, পাটনী, ভবনদী থেকে শুরু করে আধুনিক শহর জীবন-নির্ভর আইন-আদালত, রেলগাড়ী, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, বৈদ্যুতিক আলো পর্যন্ত বিবিধ উপাদান। এর দ্বারা বোঝা যায়—
(ক) বাউল গান মধ্যযুগীয় অন্যান্য সাহিত্যরূপের মত প্রাচীনপন্থী ভাবনায় আবদ্ধ নয়। তার মধ্যে সমকালীনতাও দেখা যায়। ভাবপ্রকাশের প্রয়োজনে দৃশ্যভুবনের অনেক কিছুকে সে গ্রহণ করেছে।
(খ) বাউল গান স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। তার সুরে কথা বলায়, ঘুরে ঘুরে নেচে গাওয়ায়, এমনকি একতারাটি কখনও দুই হাতে কখনও এক হাতে নিয়ে বাজিয়ে চলায় পায়ে পায়ে মধুর শব্দ ছড়ায়। আনন্দের বৃত্ত রচনা করে।
(গ) পথে পথে কথা-সুর-নৃত্যযোগে শিল্প সৃষ্টির এই অভিনব মৌখিক প্রচেষ্টা বাউল কবিরই প্রথম কীর্তি বলা চলে। ঘরের, শাস্ত্রের, জাতিভেদের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে উদার বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে যাওয়া, মনকে প্রসারিত করা মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মনের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার মুক্ত শিল্পাঙ্গিক বাউলই প্রথম বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেছে। এমনকি, অনেক সময় অস্তর ও বাহিরের দ্বন্দ্ব, জাতিভেদ ও আচার-অনুষ্ঠানের বিপরীতে মানবচিত্তের যন্ত্রণাময় একক পরিচয়টি এই গানের মধ্যেই যেন নাটকের সূচনা করেছে।
(ঘ) সহনশীল মনোভঙ্গী বিভিন্ন জাতিধর্মকে ঐক্যবদ্ধ করার উদারতা এবং গ্রাম বাংলার অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষজনের বোঝার মত সহজবোধ্য উপস্থাপনা বাউলগানকে লোকায়ত বা লোকগীতির সার্থক পরিচয়ে ভূষিত করেছে।
বাউল সাধক লীলাবাদী। তাদের দৃষ্টিতে পরমপুরুষ রসিকশেখর। লীলারস সম্ভোগের জন্য প্রেমের দায়ে রূপধারণ করেছেন। তাই কবি সাধক স্মরণ করিয়ে দেন—
“আমার একলা দায় নহে গো,
রয়েছে যে তোমারো দায়।
আমার অঙ্গে তোমার বিলাস
তাই ধরতে যে হয় আমারো পায় ।”
এই পরমপুরুষের সঙ্গে হয় মানুষের যোগাযোগ। দেহের বিদেহী সত্তার সঙ্গে চলে তখন লীলারঙ্গের সাধনা। একমাত্র হৃদয়ে আবদ্ধ শুদ্ধ প্রেমের দ্বারা তখন রসপ্রাপ্তি ঘটে। তাই বাউল কবি পদ্মলোচন বলেছেন—
“ওরে হৃদবদ্ধ ঘরে রাগের জোরে
রসিক যারা রূপ নেহারে ৷৷” (২১১)
অনেক সময় দুর্বল কামার্ত মন বিপথগামী হয়। কবি বলেন—
“মন যদি আপনার হতো
রত্ন মাণিক চিনে নিত,
তাবা দস্তায় হতো না রত……
বুঝলি নারে চাষা, তাইতে তোর এ দুর্দশা ঘটে গেল” (২১৫)।
নিজেকে চেনা, নিজের দেহের তত্ত্বকে (“ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণাঃ সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে”) জানাই বাউল সাধনার বড় কথা। লালন কবি বলেছেন—
“খুঁজলে আপন ঘরখানা
তুমি পাবে সকল ঠিকানা” (৫৩)
কখনও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বাউল আকুল হয়—
“এসো দয়াল আমায় পার করো ভবের ঘাটে” (২০)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই ‘দয়াল’ সম্বোধন পরবর্তীকালে রজনীকান্তের, অতুলপ্রসাদের গানে দেখা গেছে বাউলের মরমিয়া ভাবের প্রভাবে। দেহভিত্তিক সাধনার তত্ত্ব লালনের গানে সঙ্কেতের ব্যবহারে অপরূপ কাব্যময়তা লাভ করেছে এই পদে—
“চেয়ে দেখ নারে মন দিব্য নজরে।
চারি চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মণিকোঠার ঘরে ।।
হলে সে চাঁদের সাধন অধর চাঁদ হয় দরশন
আবার চঁদেতে চাঁদের আসন রেখেছে ঘিরে ৷৷”
এখানে ‘চারি চঁাদ’, ‘মণিকোঠার ঘর’, ‘চঁাদ’ ‘অধর চাদ’ প্রভৃতি কথাগুলি গুহ্য বাউল সাধনার সঙ্গে যুক্ত। বলা বাহুল্য, শুধু অধিকারী ভেদেই তার তত্ত্ব-রহস্য ধরা পড়ে। এই সাধনতত্ত্বের সিদ্ধিলাভে সাধকের অবস্থা বাউল কবি দুদ্দু শাহও বর্ণনা করেছেন—
“যে দেখেছে সেই রূপের বিহার।
আপনে সে ছেড়ে গেছে এ সংসার॥…..
স্বীয় কামে দিয়ে ফাসি
সদায় চিন্তা শ্রীরূপ-শশী
পলানুপল দিবানিশি,
জেগেছে সে সারাৎসার” (৩৮১)৷
এইভাবে সহজ সুরে গভীর ভাবের কথাকে নানা সূত্রে প্রকাশ করে বাউল গানের কাব্যমাধুর্য প্রকাশ পেয়েছে।
Leave a comment