বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ভারতবাসীর জীবনযুদ্ধের চিরসারথী। জীবনের দুর্গম পথে বিবেকানন্দ-সাহিত্য দুঃসাহসী মানবাত্মার জয়গান। তাঁর কন্ধু-কণ্ঠে শুনি উপনিষদের সেই আশ্চর্য জাগরণের বাণী—“উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরাণ নিবোধত।” সংসারপাশ-মুক্ত এই দৃপ্ত বেদান্তকেশরী জড়তা ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধেও ছিলেন সংগ্রামী সৈনিক। তিনি বলেন : “Yes, the more everything seems to me to lie in manliness” বাংলা সাহিত্যে এবং জাতির জীবনে এই ‘manliness’ বা পৌরুষের আদর্শসঞ্চার সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে স্মরণ সুন্দর অবদান। তামসিকতা ও জড়তায় সমাচ্ছন্ন, পাপবোধে ন্যুব্জ মানুষের মধ্যে যেখানেই তিনি দেখেছেন পুরুষত্বের (manliness) অনুপস্থিতি, সেখানেই তাঁর মসী অসি হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝিমিয়ে পড়া, সঙ্কীর্ণ সংস্কারে বাঁধা হিসেবী মনগুলো যেন তাঁর কলমের অপ্রত্যাশিত চাবুকের আঘাতে চমকে উঠেছে, দশ হাজার বছরের মমির মধ্যে জেগেছে প্রাণের স্পন্দন।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ও কর্মজীবন:
স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাস-পূর্ব নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি সোমবার উত্তর কলকাতার সিমলা পল্লীতে গৌরমোহন মুখার্জি লেনে সম্ভ্রান্ত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহ দুর্গাচরণ দত্ত ছিলেন ফার্সী ও সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত। পরিণত বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন। নরেন্দ্রনাথের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতিমান অ্যাটর্নি। মা, ভুবনেশ্বরী দেবী।
নরেন্দ্রনাথের ডাক নাম ছিল বিলে। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র নরেন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয় বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন স্কুলে। তারপর স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে প্রেসিডেন্সী, পরে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) ভর্তি হন। সেখান থেকে বি.এ. পাশ করে আইন কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে বা তার পূর্ব থেকেই তার মনে ঈশ্বর জিজ্ঞাসার সূত্রপাত হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্রাহ্ম নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তার মনের নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। সেইসময় ঘটনাক্রমে তার কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক W. W. Hasty-র কাছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা ব্যাখ্যার সময় ‘ভাবসমাধি’ প্রসঙ্গ আলোচনায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নাম শুনতে পান। আর তারপরেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আকর্ষণে ও প্রভাবে তীক্ষ্ণধী, যুক্তিবাদী এই অসাধারণ যুবক দিব্যজগতের পথ নির্দেশ পেয়ে ধীরে ধীরে ‘স্বামী বিবেকানন্দে’ রূপান্তরিত হন।
স্বামীজীর পাশ্চাত্য কর্মজীবনের পরিসীমা ছিল মাত্র দশ বছর। তার পূর্বে ত্রিশ বছর ছিল প্রস্তুতির কাল। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে তিনি আমেরিকা যাত্রা করেন। পরে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর কলম্বাস হলে আন্তর্জাতিক ধর্মমহাসভায় যোগদান করে উদাত্ত ভাষণে ভারতবর্ষ সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসীকে কৌতূহলী ও সচেতন করে তোলেন। তাঁর ২০ সেপ্টেম্বরের ভাষণেও ভারতের দুর্দশা, তার অতীত গৌরব, তার গুরু পরমহংসদেবের সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী জগৎবাসীকে আকৃষ্ট করে। বহু বিদেশী পণ্ডিত এবং বিদেশিনী মহিলা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বা ভাবধারায় মুগ্ধ হয়ে ভারতে আসেন ভারতবাসীর সেবার উদ্দেশ্যে। ফলে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই তিনি অকস্মাৎ লোকান্তরিত হন। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন না। তবু বাংলা ভাষাচর্চায় তার অবদান অসামান্য।
স্বামী বিবেকানন্দের রচনাসমূহ:
তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘পরিব্রাজক’ (১৮৯৯), ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য’ (১৯০৩), ‘বর্তমান ভারত’ (১৯০৫), ‘ভাববার কথা’ (১৯০৭) এবং ‘পত্রাবলী’। তিনি কিছু কবিতাও লিখেছিলেন— ইংরেজী-বাংলা-সংস্কৃতে। তাঁর কবিতা-সঙ্কলন ‘বীরবাণী’ (১৯০৪)। প্রথম তিনটি সংস্করণে রামকৃষ্ণস্তোত্র এবং ‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’ কবিতা দুটি ছিল। পরে আরও কবিতা যুক্ত হয়েছে। ‘সখার প্রতি’ ও ‘Kali the Mother’ নামে ইংরেজী কবিতাটি ভাব ও ভাষা-সম্পদের জন্যে বিখ্যাত হয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ নামে তার অনুবাদ করেন। এছাড়া, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মুখপত্র ‘উদ্বোধন’ (১৮৯৯) পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজি ‘ব্রহ্মবাদিন’ এবং ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায়ও তিনি কিছু লিখেছিলেন। এখানে আছে তাঁর লেখা নটি বাংলা রচনার নিদর্শন। এর মধ্যে বিবেকানন্দের ‘Imitation of Christ’-এর প্রথম ছটি। পরিচ্ছেদের বঙ্গানুবাদ এবং ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামে প্রসিদ্ধ প্রবন্ধটি আছে। এই রচনাগুলি ১৮৯৭ থেকে ১৯০৭-এর মধ্যে লেখা হয়।
বিবেকানন্দের প্রথম চারটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থ ‘পরিব্রাজক’ মূলতঃ ভ্রমণকাহিনীর লঘু চালে লেখা, ব্যক্তিগত চিন্তা ও মননের দ্বারা সমৃদ্ধ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা আছে দ্বিতীয় গ্রন্থে। ইতিহাসের আলোকে উভয় সভ্যতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে সনাতন ভারতের রূপটি উদ্ঘাটিত হয়েছে। বর্তমান ভারতে’ যুগসন্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয়টি বিশ্লেষিত। সেইসঙ্গে আছে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ভারতবাসীকে নব-ভারত গঠনের পথ নির্দেশ। ‘ভাববার কথা’ গ্রন্থে ধর্মীয় প্রসঙ্গ কৌতুকরসের দ্বারা ব্যাখ্যাত। আর ‘পত্রাবলী’তে আছে শিষ্যকে বা সুহৃৎকে লেখা তাঁর অন্তরঙ্গ মনের পরিচয়।
বিশ্বন্ধর বিবেকানন্দের শৌর্য-দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব তাঁর রচনাবলীতেও একটি বিশেষ বাগভঙ্গী বা শৈলী সৃষ্টি করেছে যার তুলনা উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বা বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও দুর্লভ। সাহিত্যের সৃষ্টিমূলক কল্পনাজগৎ বিবেকানন্দ-সাহিত্যে অনুপস্থিত। তাঁর গদ্য যেন লক্ষভেদী বাণ। তার সমস্ত চলায়, বলায়, স্পর্শে ঠিকরে ওঠে প্রাণ। তাঁর ব্যক্তিত্বের মতো তাঁর গদ্যও পৌরুষব্যঞ্জক। আত্মশক্তির প্রতি অনন্ত বিশ্বাসের কথাই তার ধ্রুবপদ।
পূর্ববর্তী গদ্যলেখকদের থেকে স্বামী বিবেকানন্দের স্বাতন্ত্র্য:
হৃদয়াবেগমূলক ভক্তিতন্ময়তা থেকে যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞানসাধনার দিকে বাঙালী মনকে আকৃষ্ট করার প্রথম সাধুবাদ ভারতপথিক রামমোহনেরই প্রাপ্য। প্রাক্-বিদ্যাসাগরী ভাষা ছিল নীরস “পণ্ডিতী বাংলা”। পরবর্তী যুগে বিদ্যাসাগরের লেখনী স্পর্শে সেই গদ্যের বুকে প্রাণসঞ্চার হয়। তার বিতর্কমূলক রচনাবলীর মধ্যে শোনা যায় স্বামীজীর ক্ষীণ পদধ্বনি। আবার ভাষাকে ঐরাবতের গজেন্দ্রগমন থেকে অনেকটা মুক্তি দিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ ও প্যারীচাদ মিত্র। ভাঙ্গাচোরা চলতি মুখের কথা সাহিত্যে পেল প্রবেশের অধিকার। ‘আলালী’ ও ‘বিদ্যাসাগরী’ ভাষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সাধুভাষার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র করলেন এক নতুন পথনির্দেশ। এর পর চলতি গদ্যের মধ্যে গতিবেগের সাইক্লোন আনায় যিনি জনগণমন অধিনায়করূপে বাঙালী হৃদয়ে হলেন চির প্রতিষ্ঠিত, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। কলকাতার মার্জিত কথ্যবুলির উপরেই চলতি গদ্যকে তিনি দাঁড় করালেন। ভাষাকে দক্ষ নাবিকের মতো দিক চেনাতে বিবেকানন্দ-সাহিত্য বিকশিত। এই ভাষাটি কখনো তাঁর হাতে শাণিত তলোয়ার, কখনো কিছুটা তৎসম-শব্দযোগে গম্ভীরনাদী তূর্য। কোমলে-কঠোরে তা যেন পার্বতী পরমেশ্বরের মিলন।
যথার্থ চলতি গদ্যের যে কত শক্তি, কত বিচিত্র এর রূপাভিব্যক্তি, তার সার্থকতম নিদর্শন তার গ্রন্থাবলী। তার মতে সংস্কৃতের “গদাই লস্করি চাল” পরিত্যাগ করে “ভাষাকে করতে হবে যেন সাফ ইস্পাত, মুচ্ড়ে মুচ্ড়ে যা ইচ্ছে কর–আবার যে কে সেই, একচোটে পাথর কেটে দেয় দাঁত পড়ে না।” এই ইস্পাতের ঝলক বিবেকানন্দ গদ্যেরও মুখ্য বৈশিষ্ট্য। বঙ্কিমচন্দ্র গদ্যের আপেক্ষিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু এই আপেক্ষিকতার রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি বঙ্কিমযুগের অনেক গদ্যলেখক। বঙ্কিমের সৃষ্ট তৎসম শব্দবহুল ও সমাসবদ্ধ গদ্যকেই তাঁরা বঙ্কিমের আদর্শ গদ্যরীতি বলে ভুল করেছেন। এই আপেক্ষিকতার মূল্য একমাত্র হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বিবেকানন্দ। বঙ্কিমযুগে তিনি ‘সবুজপত্র’ যুগের আগমনী গাইলেও প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে তার পার্থক্য সুস্পষ্ট। তাঁর চলিত গদ্যরীতি একেবারে কলকাতার খাঁটি “কক্নি”, অথচ অশিষ্ট বা অমার্জিত নয়। তার রীতিতে হুতোমী দুঃসাহসিকতা আছে কিন্তু নাগরালীর মেরুদণ্ডহীনতা অনুপস্থিত। প্রমথ চৌধুরীর মননশীলতা এ গদ্যে আছে কিন্তু ভাষার কৃত্রিম মারপ্যাচ সেখানে দুর্লভ।
বাংলা চলতি গদ্যের নব ভগীরথ স্বামীজী এর স্বপক্ষে যে অভ্রান্ত যুক্তি দেখিয়েছেন প্রাক্-“সবুজপত্র” যুগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাষ্যেও তা বিরলদৃষ্ট। তাঁর “য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র” অথবা “পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরী” অথবা জীবনের বয়ঃসন্ধির পত্রাবলীতে চলতি গদ্যের মধ্যে যে কমনীয়তা পরিস্ফুট তার মাধ্যমে বাংলা গদ্য অনেক আগেই চলতি পথের যাত্রী হতে পারত। এই চলতি গদ্যকে সাহিত্যের জীবনসঙ্গিনী করবার জন্য, সার্বজনীন অনুভূতির সঙ্গে চলতি গদ্যের ‘গাঁটছড়া’ বাঁধবার জন্য হুতোমের পর জ্বালাময় আবেগের অগ্নিস্পর্শে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এই সন্ন্যাসী—“দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, তা দু-হাজার ছাঁদি বিশেষণেও নেই।” অথবা “চলিত ভাষায়। কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে?” ভাষাকে মেজে ঘষে সাফ্ ইস্পাতের মতো করতে চেয়েছেন তিনি। যার মাধ্যমে সাহিত্য পাবে বেগবতীর প্রাণ আর ভাষা পাবে মননশীলতার ঐশ্বর্য। সেই বিস্ময়কর বাকনির্মিতির ফসল বিবেকানন্দ সাহিত্য—“বলি রঙের নেশা ধরেচে কখন কি-যে রঙের নেশায় পতঙ্গ আগুনে পুড়ে মরে, মৌমাছি ফুলের গারদে অনাহারে মরে?”—“একটি রেখার মধ্যে এত রঙের খেলা” – বিবেকানন্দ ছাড়া কেউ বাংলা সাহিত্যে দেখাতে পেরেছেন কি?
মানবতাবোধের দৃপ্ত বিশ্বাসে শান্ত শিব ও সুন্দরের ধ্যানমগ্ন এই বেদান্ত-পথিক আশ্চর্য সুন্দর সাধু ভাষারও স্রষ্টা। তার নিঃসংশয় নিদর্শন তার ‘বর্তমান ভারত’। তবে তাঁর গদ্যভাষার অনায়াসগামিতা ও বেগ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় চলিত ভাষায়। চলিত ভাষায় তিনি প্রাণময় বৈদ্যুতিক গতিসম্পন্ন; সাধুভাষায় সংহত শঙ্কর ভাষ্যের গভীর গম্ভীরতায় সমাসীন। তার দ্বৈত গদ্যরীতি যেন তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বারই দ্বৈত প্রকাশ। ওয়াল্টার পেটারের “Style is the man” কথাটি এখানে সুপ্রযোজ্য।
সাহিত্যিক হিসাবে এই যুগন্ধর চরম আদর্শবাদী। শুধুমাত্র ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানিতেই তাঁর প্রবন্ধের আদিগন্ত আলোকিত হয়নি। বাস্তববাদী জীবন-জিজ্ঞাসা যেখানে মানুষের অন্নবস্ত্র ও বুদ্ধি হৃদয়ের সামঞ্জস্য বিধানে ব্যস্ত, এই মহামানবধর্মের উদ্গাতা সেখানে আত্মার আলোকে জীবনের পরম সত্যটিকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে দৃঢ় সংকল্প। মানুষে মানুষে যে ভেদের অচলায়তন গড়ে উঠছে তা এই নবভারতের ঋত্বিককে ব্যথিত করত। তার অন্তরতম আকাঙক্ষা “নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালা মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালা উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড়, জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে…” বিবেকানন্দ-সাহিত্যে সেই অবহেলিত জাতি আর অবদমিত মানবাত্মার জীবনবেদ। এই অগ্নিবাণী বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ।
চলিত ভাষাকে গভীর মননের উপযোগী করতে হলে সংস্কৃত থেকে আমাদের উপযুক্ত শর-সন্ধান করতেই হবে। পাশ্চাত্ত্য ভাষাকেও ল্যাটিনের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সংস্কৃতের সাহায্যে বাংলাভাষা হবে ওজস্বিনী এবং সংহত গভীর। কোন শব্দকুহেলীর সৃষ্টি না করে জনসঙ্ঘের জাগৃতির জন্য উপনিষদের অগ্নিবর্ণ অক্ষরের সাহায্য নিয়েছিলেন স্বামীজী। বৈষ্ণব ভক্তিবাদের উচ্ছ্বসিত প্লাবনে বাঙালী জীবনে যে জড়তা দেখা দিয়েছিল তা স্মরণ করে তিনি রুদ্রবীণার ঝঙ্কারে উচ্চারণ করেছেন : “দেশে দেশে গাঁয়ে গাঁয়ে যেখানেই যাবি দেখবি খোল করতালই বাজছে। ঢাক ঢোল কি দেশে তৈরি হয় না… কীর্ত্তন শুনে শুনে দেশটা যে মেয়েদের দেশ হয়ে গেল।” আবার বলেছেন—“ডমরু শিঙ্গা বাজাতে হবে।… যেসব music-এ মানুষের Soft feelings উদ্দীপিত করে সেসব কিছুদিনের জন্য এখন বন্ধ রাখতে হবে। …সকল বিষয়ে বীরত্বের কঠোর মহাপ্রাণতা আনতে হবে।”
স্বামীজীর চলিত ভাষার প্রতি অনুরাগের মূলে ছিল জনগণের সঙ্গে একাত্মভাব। এই গণদৃষ্টিই চলিত ভাষার মূল কথা। কোমলকান্ত রূপের পরিবর্তে ঋজু ওজস্বিতা সাহিত্যে আনায় বাংলা গদ্য সাহিত্য তার কাছে চিরঋণী।
ভাষার ভারসাম্য না হারিয়ে সংস্কৃত সমাসবদ্ধ শব্দ আনায় তার সাহিত্য কলমন্দ্রে মুখরিত। যেমন—হৃষীকেশের গঙ্গাতীর বর্ণনায় “কণপ্রত্যাশী মৎসকুল” অথবা মাঝে মাঝে ইংরেজী চলিত শব্দকে অসঙ্কোচে হজম করে নিয়ে এমন আতিথ্য তারা পেয়েছে যে তারা যে ঘরের নয় সেকথা ভুলেই গেছি।
স্বামী বিবেকানন্দের হাস্যরস:
বিবেকানন্দের প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে মাঝে মাঝে হাস্যরসের “মেঘ-ছেঁড়া আলো” তাঁর প্রবন্ধে এসে পড়েছে। শুধু জ্ঞানময় নয় বলার ভঙ্গিটিও হয়ে উঠেছে মনোময় ও রসময়—“জাহাজ বেজায় দুলচে আর তু-ভায়া দুহাত দিয়ে মাথাটি ধোরে অন্নপ্রাশনের অন্নের পুনরাবিষ্কারের চেষ্টায় আছেন” অথবা মার্কিনী বর্ণ-বিদ্বেষের মধ্যে “চোখের জলে জমানো হাসির শিলাবৃষ্টি বোঝাতে গিয়ে” “যা কিছু সাহেব হবার সাধ ছিল, মিটিয়ে দিল মার্কিন ঠাকুর। দাড়ির জ্বালায় অস্থির, কিন্তু নাপিতের দোকানে ঢোকবামাত্রই বললে ও চেহারা এখানে চলবে না।” হাঙ্গর শিকারের বর্ণনায় চলিত ভাষার সাহায্যে সমগ্র ঘটনাটির গতিবেগ ও কৌতুকের আশ্চর্য নিপুণতায় উদ্ঘাটিত : ‘বাঘা হাঙর থ্যাবরা’কে “মুচকে হেসে, “ভাল আছ তো হে’ বলে সরে গেল।”
বিবেকানন্দের বিভিন্ন গ্রন্থের ব্যবহৃত গদ্যরীতির দৃষ্টান্ত:
সংস্কৃত ও ফরাসি মিশ্রিত শব্দ ব্যবহারে উজ্জ্বল চলিত গদ্যঃ “লক্ষ্ণৌ শহরে মহরমের ভারি ধূম। বড় মসজিদ ইমামবাড়ায় জাঁকজমক রোশনির বাহার দেখে কে! বেসুমার লোকের সমাগম। এ দর্শকবৃন্দের ভিড়ের মধ্যে দূর গ্রাম হতে দুই ভদ্র রাজপুত তামাসা দেখতে হাজির। ঠাকুর সাহেবদের, যেমন পাড়াগেঁয়ে জমিদারের হয়ে থাকে, বিদ্যাস্থানে ভয়েবচ। সে মোসলমানি সভ্যতা, কাফগাফের বিশুদ্ধ উচ্চারণসমেত লস্কির জবানের পুষ্পবৃষ্টি, আবাকাবাচোস্ত পায়জামা, তাজামোড়াসার রঙ্গবেরঙ্গ শহরপসন্দ ঢঙ্গ অত দূর গ্রামে গিয়ে ঠাকুর স্পর্শ করতে আজো পারেনি। কাজেই ঠাকুররা সরল, সিধে, সর্বদা স্বীকার করে জমামরদ কড়াজান আর বেজায় মজবুত দিল।” (‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’)
চিত্রধর্মী গদ্যরীতি : “সে নীল নীল আকাশ, তার কোলে কালো মেঘ, তার কোলে সাদাটে মেঘ, সোনালী কিনারাদার, তার নীচে ঝোপ-ঝোপ তাল-নারিকেল-খেজুরের মাথা বাতাসে যেন লক্ষ লক্ষ চামরের মত হেলচে…” (‘পরিব্রাজক’)
ব্যঙ্গধর্মী ভাষারীতি : “ঐ যে একদল দেশে উঠছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম নরম বুলি কাটেন, এঁকে বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবধি পিরীতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাঁসেন হোঁসেন’ করেন।” (পূর্বোক্ত)
সাধু ভাষার গদ্যরীতি : “হে ভারত, ভুলিও না— তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দয়মস্তী; ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ….. বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।” (‘বর্তমান ভারত’)
জাতির জীবনে ও বাংলা সাহিত্যে এই বীর ও রৌদ্ররসের স্পষ্টবক্তা সন্ন্যাসী বৈদিক ছন্দের মেঘমন্দ্রে প্রাণসঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। জ্ঞান-ভক্তি, ধর্ম-কর্ম, আত্মস্থ সমাধি ও বিগলিত মানবপ্রেমের যুক্ত বেণীরূপে বিবেকানন্দ-সাহিত্য দোসরহীন।
বিশুদ্ধ সারস্বত প্রেরণায় লেখনী ধারণ না করলেও বিবেকানন্দ বাংলা সাহিত্যে এক জ্যোতির্ময় প্রেরণা। বাংলা ভাষা থেকে পৌরুষ আজ যখন অস্তর্হিত, তখন মনে পড়ে যায় Milton-এর সম্বন্ধে Wordsworth এর ক্ষোভোক্তি—যা বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে এদেশে স্বামীজীর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য—”Milton thou should’st be living at this hour. England had need of thee.”
Leave a comment