ঈশ্বর গুপ্ত এবং মধুসূদনের মধ্যে কবিত্বের সংযোগ-বিন্দু রূপে যেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ও কর্মজীবন:
বর্ধমান জেলার কালনার কাছে বাকুলিয়া গ্রামে ১৮২৭ খ্রীঃ ডিসেম্বরে রঙ্গলাল জন্মগ্রহণ করেন। পিতা, রামনারায়ণ। মা, হরসুন্দরী। তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয় কলকাতায়। কিছুকাল প্রেসিডেন্সী কলেজে বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। পরে ডেপুটি কালেকক্টর ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন।
অনাধুনিক আঙ্গিক এবং আধুনিক মনোভাবনার এক বিচিত্র সমন্বয় রঙ্গলালের কাব্যগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। গুপ্ত কবির ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় রঙ্গলালের প্রথম মুদ্রিত আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারও আগে তিনি কবিগানের বাঁধনদার ছিলেন বলে জানা যায় (দ্রষ্টব্য : মন্মথনাথ ঘোষ : ‘রঙ্গলাল’, ১৩৩৬, পৃষ্ঠা-৭৩-৯২)। ঈশ্বর গুপ্ত প্রথম জীবনে ছিলেন তাঁর প্রেরণা। পরে স্কট, ম্যুর, উয়াট, কুপার, মিলটন, হোমার, প্রমুখ কবিদের কাব্য বিষয়ের সঙ্গে রঙ্গলালের পরিচয় ঘটে। তিনি লিখেছেন : “আমি সর্বাপেক্ষা ইংলন্ডীয় কবিতার সমধিক পর্যালোচনা করিয়াছি এবং সেই বিশুদ্ধ প্রণালীতে বঙ্গীয় কবিতা রচনা করা আমার বহুদিনের অভ্যাস” (‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যের ভূমিকা)। তাঁর এই ‘ইংলন্ডীয় কবিতার’ পৰ্য্যালোচনা (সম্ভবতঃ অনুবাদ) ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘রহস্যসন্দৰ্ভ’, ‘এডুকেশন গেজেট’, ‘বঙ্গদর্শন’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত অনুবাদ কবিতাগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:
(ক) কাব্যরচনা : রঙ্গলালের প্রথম গ্রন্থ কালিদাসের লেখা ‘ঋতুসংহার’ কাব্যের অনুবাদ (১৮৫১)। ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম জীবনে লেখা ‘ভেক মূষিকের যুদ্ধ’, হোমারের নামে প্রচলিত ‘Batrachomyomachia’ ব্যঙ্গ-কাব্যের অনুবাদ (১৮৫৮), সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত ‘পার্নেল’ ও গোল্ডস্মিথের ‘হার্মিট’ কাব্যের অনুবাদ (১৮৫৮), ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮) উৎস, টডের ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’ ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২), ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮), কুমারসম্ভব কাব্যের অংশবিশেষ অনুবাদ (১৮৭২), এবং ‘নীতিকুসুমাঞ্জলি’ নামে দুশ সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকের পদ্যানুবাদ (১৮৭৫)। ‘কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯), যার উৎস ঊড়িষ্যার কবি পুরুষোত্তম দাসের প্রাচীন কাব্যের অনুবাদ।
(খ) পত্রিকা সম্পাদনা : ‘এডুকেশন গেজেট’ এবং ‘সংবাদ রসরাজ’।
(গ) গদ্য রচনা : বীটন সোসাইটির অধিবেশনে পঠিত ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’ (১৮৫২), এবং ‘শরীর সাধন বিদ্যার গুণোৎকীর্ত্তন’।
কাব্য ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ : (এ সম্পর্কে সুবিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে টীকা অংশে, পৃষ্ঠা ২৮-২৯)।
রঙ্গলালের অন্য তিনটি কাব্য গাথাকাব্য বা রোমান্সকাব্য হিসাবে পরিচিত। ‘কর্মদেবী’ ও ‘শূরসুন্দরী’র উৎস রাজস্থান-কাহিনী, তৃতীয়টি উড়িষ্যার ইতিহাসের রোমান্টিক কাহিনী থেকে সংগৃহীত।
‘কর্মদেবী’ : যশল্মীর প্রদেশ শাসকের পুত্র সাধুর দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য দুঃসাহসিক বীরত্বের বর্ণনা এখানে আছে। কাহিনীর শেষ অংশে দেখা যায় কর্মদেবী তার বিজয়ী প্রণয়ীর সঙ্গে সহমরণে মৃত্যুবরণ করেছেন। কাহিনীটি বীররস এবং রোমান্স ভাবনায় পরিপূর্ণ। স্কট, বায়রন প্রভৃতি কবির প্রভাব এই কাব্যের বিভিন্ন অংশে লক্ষ্য করা যায়। ‘‘শূরসুন্দরী’ : কাব্যটি রাজপুত বীরত্বের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। মোঘল সম্রাট আকবরের হিন্দু নারী লোলুপতার কাহিনী এই কাব্যের প্রধান বিষয়। কাহিনীর শেষে হিন্দু নারীর সতীত্ব ও মর্যাদার জয় দেখানো হয়েছে। ‘কাঞ্চীকাবেরী’— উড়িষ্যার রাজকাহিনীর সঙ্গে লোককাহিনীর সংমিশ্রণে এর কাব্য বিষয় পরিকল্পনা করা হয়েছে। উড়িষ্যারাজ পুরষোত্তমের সঙ্গে কাঞ্চীরাজের বিবাদ হয়, কাঞ্চী রাজকন্যার হস্তান্তর এবং পুরুষোত্তমের হাতে লাঞ্ছনা ঘটে এবং শেষে বিবাহের মধ্য দিয়ে দুই রাজার মধ্যে বিবাদের নিষ্পত্তি হয়। এই কাব্যের রচনারীতি ও গঠন—কোনটাই তেমন গৌরবজনক নয়। ‘নীতিকুসুমাঞ্জলি’সংস্কৃত নীতি ও তত্ত্বমূলক উদ্ভট কবিতার অনুবাদে রঙ্গলাল কিছুটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন; যেমন—
“গ্রন্থগত বিদ্যা, পরহস্তগত ধন
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।”
অথবা, অর্থের গুরুত্ব বোঝানোর প্রয়াস—
“মাতা নিন্দাপরায়ণ পিতা প্রিয়বাদী নন
সোদর না করে সম্ভাষণ।
ভৃত্য রাগে কহে কত পুত্র নহে অনুগত
কাস্তা নাহি দেন আলিঙ্গন ৷৷
পাছে কিছু চাহে ধন এই ভয়ে বন্ধুগণ
কিছুমাত্র কথা নাহি কয়।
ওরে ভাই এ কারণ কর ধন উপার্জন
ধনেতেই সব বশ হয় ।”
বাংলা কাব্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান:
কবি রঙ্গলাল বাংলা কাব্যের আসরে কোন গুরুত্বহীন ব্যক্তিমাত্র নন। তার অবদান স্মরণ করলে মনে হয়—
(১) বাংলা কাব্যে তিনি প্রথম স্বদেশপ্রেম-নির্ভর আখ্যান কাব্য ও জাতীয় ক্ষুদ্র কবিতা রচনার সূত্রপাত করেন। ইতিহাস নির্ভর কাহিনীর আশ্রয়ে নিসর্গ বর্ণনা এবং রোমান্টিক দেশপ্রেম তাঁর কাব্য-পঙ্ক্তির মধ্যে রোমান্সরূপ পরিগ্রহ করে। ওয়াল্টার স্কটের মিস্ট্রেলদের মত চারণদের মুখে কাহিনী বিবৃত করে তিনি শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাদেশিকতার বোধ সঞ্চার করেন। তাই “Rangalal’s romances had almost the same significance for the nation as Scott’s had for his people”. (H. M. Dasgupta : ‘Wastern Influence on the 19th Century Bengali Poetry, 1935 p), প্রত্যক্ষ প্রভাব না হলেও পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্স-নির্ভর স্বদেশচেতনা প্রকাশেও হয়ত তা প্রেরণার কাজ করেছিল।
(২) মধুসূদনের উপমালঙ্কার রীতি, সর্গ-বিন্যস্ত কাব্যরচনা পদ্ধতি রঙ্গলাল যেমন গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি রঙ্গলালের পদ্মিনী অবিসংবাদিতভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল প্রমীলার মধ্যে।
(৩) অনুবাদ-কাব্য বা কবিতা রচনার ক্ষেত্রে রঙ্গলালের প্রয়াস সংস্কৃত কবি কালিদাস থেকে শুরু করে ওড়িয়া কবি দীন কৃষ্ণদাস, উপেন্দ্র ভঞ্জ, এমন কি ওমর খৈয়াম পর্যন্ত প্রাদেশিক বা বিজাতীয় কবির কাব্যের অনুবাদ বাংলা কাব্যের অনুবাদ শাখার ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছিল। রঙ্গলাল স্কট, ম্যুর, বায়রন, মিল্টন, শেক্সপিয়রের উজ্জ্বল কাব্য পক্তিগুলির বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা কবিতার প্রকাশ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
উপরোক্ত অবদান সত্ত্বেও বলা যায়, রঙ্গলাল আখ্যানকাব্য রচনার কাঠামো তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। কাব্য প্রকরণে বিদেশী কবিদের অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের ভাবধারাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি। অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা Blank Verse-এর সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন কিন্তু লোকাপবাদের ভয়ে তা অভ্যাস করতে পারেন নি ব’লে মধুসূদনের কাছে স্বীকার করেছিলেন।
Leave a comment