বাংলা কাব্যের নবযুগের কবি প্রকৃতির নতুন পরিচয়ের একটি দিক মধুসূদনে রূপায়িত। তার বিপরীতধর্মী আর একটি দিক বিহারীলাল চক্রবর্তীর মধ্যে উদ্ভাসিত। কবি-অন্তরের যে একটি অকারণ অনির্দেশ্য বেদনাবোধ, একটি অপ্রকাশিত অভাবের অস্বস্তি যে কবি মনে সদাজাগ্রত এবং এটাই যে কবিতায় কবির প্রেরণা হতে পারে তা অনাধুনিক বাংলা কাব্যের কবিদের কাছে অজ্ঞাত ছিল। এমন কি, যুগসন্ধির কবি ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু করে মধুসূদনের পূর্ব পর্যন্ত কবিদের কাছেও তা অজানা ছিল। মধুসূদনের কবিতায় নিজের মনের কথা’ লিপিবদ্ধ করার বাসনা ব্যক্ত হলেও মহাকাব্যের সৌধ নির্মাণেই তার কবিপ্রতিভা ছিল অভিনিবিষ্ট। যেমন তার ব্যক্তিকতা, তেমনি তার গীতিপ্রবণতাও ছিল পরোক্ষাবৃত। তাঁর দুই যোগ্য উত্তরসাধক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেন মুখ্যতঃ মহাকাব্য প্রণেতারূপেই সুখ্যাত। স্বভাবতই বাংলা কাব্যক্ষেত্রে গীতিকবিতার প্রয়োজন মেটাতে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর আবির্ভাব ঘটেছিল।
“সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কার ঘরের ছাত্র” বিহারীলাল চক্রবর্তী বৈষ্ণব কবিতা, ঈশ্বর গুপ্ত ও দাশু রায়ের পাঁচালী এবং শেক্সপিয়ার, টড, স্কট, ম্যুর এবং বায়রনের ‘Child Hareold’ ইত্যাদি কাব্য যত্ন সহকারে পাঠ করেছিলেন। নিমতলার ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম, সঙ্গীতরসে আবাল্য আসক্তি, মাতৃবিয়োগ বেদনা, আত্মীয় পরিজনদের স্নেহলাভ এবং যৌবনের পূর্ব-পরিচিতা নারীকে বধূরূপে লাভ এবং ক্ষণকাল পরে স্ত্রী বিয়োগ ইত্যাদি সীমিত অভিজ্ঞতার পরিসরেই তাঁর সংবেদী কবিচিত্ত লালিত ও বৰ্দ্ধিত হয়। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য রচনার মধ্যে উল্লেখ করা যায়।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর রচনাসমূহ:
‘স্বপ্নদর্শন’ (১৮৫৮) নামে, অভিনব গদ্যরূপক কাব্য, ‘সংগীত-শতক’ (১৮৬২), ‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০), ‘নিসর্গসন্দর্শন’ (১৮৭০), ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ (১৮৭১), ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯), ‘মায়াদেবী’ (১৮৮২), ‘ধূমকেতু’ (১৮৮২), ‘বাউল বিংশতি’ (১৮৮৭), ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯), শরৎকাল এবং দেবরাণী, গোধূলি (১৮৯৯)। এছাড়া ‘অবোধবন্ধু’ নামে একটি ক্ষুদ্রায়তন পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় (১৮৭০)। কবি বিহারীলাল সম্পাদিত ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধু কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে হয়ে উঠেছিল ‘প্রত্যুষের শুকতারা’, তার মনের একতারায় বেজে ওঠা মাঠের এবং বনের গান। বিপরীতভাবে কবি ঈশ্বর গুপ্তের ‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকা ‘স্বপ্নদর্শন’ কাব্যটিকে অভিনন্দন জানায়।
বিহারীলালের কবিধর্মে ছিল অনন্যসাধারণ স্বকীয়তা। সঙ্গীতের আদিম পরিচয় হল তা হবে over heard অর্থাৎ তা গায়কের অভিপ্রেত না হলেও শ্রোতা সেই গান শুনে নির্জনতার বেদন-রসে অভিষিক্ত হবেন। বিহারীলাল সেই জাতের গায়ক। তার ‘বন্ধুবিয়োগ’ ও ‘প্রেমপ্রবাহিণী’ কাব্যদুটিতে নিজের অন্তরঙ্গ জীবনের সমস্ত কথাই অনাবৃত। কবি-বন্ধু যিনি এর নায়করূপে চিত্রিত, তিনি কবিরই আত্মপ্রতিম, প্রণয়ী দম্পতির প্রণয়ভঙ্গ ও সেই প্রেমের আদর্শায়িত ভাববিগ্রহের সন্ধানে নিসর্গে অন্বেষণ, কবিতায় উপাখ্যান অংশ এইটুকু মাত্র। আসলে উপাখ্যান নয়, আধ্যাত্মিকতাই হল এর মূল নির্ভরস্থল। তাই বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে কাব্যের যেমন অন্তরঙ্গ মিল দেখা যায়, তেমনি শেলির ‘Alastor’ কাব্যের সঙ্গেও আধুনিক পাঠক এর বহিরঙ্গ সাদৃশ্য লক্ষ্য করতে পারেন।
তাঁর ‘প্রেমপ্রবাহিণী’র সমকালে প্রকাশিত ‘বঙ্গসুন্দরী’র নারীবন্দনার মধ্যে রোমান্টিক মনোভাব অভিব্যক্ত। ‘বঙ্গসুন্দরীর’ মধ্যে তথ্যের বস্তু প্রধান কাঠামো ভেদ করে নারী আদর্শের ভাবপ্রশস্তি দেখা যায়। এর দার্শনিক ভিত্তি অগস্ত কোতের দর্শন অনুসারে সৃষ্ট বলে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন : “….আমার মনে হয় কেঁাৎ যদি এইটি পাইতেন, তাহা হইলে তাঁহার ধ্রুবধর্মের গাথাসমূহ মধ্যে (hymns of Positive religion) ইহাকে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ স্থান দিতে অগ্রসর হইতেন (দ্রষ্টব্য : ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’, বিপিনবিহারী গুপ্ত)।” এই কাব্যে রূপহীন বস্তু থেকে স্বপ্ন-সুষমা আহরণের প্রচেষ্টা দেখা যায়—
“একদিন দেব তরুণ তপন
হেরিলেন সুর-নদীর জলে
অপরূপ এক কুমারী রতন
খেলা করে নীল নলিনীদলে।”
কবির সর্বালোচিত কাব্য ‘সারদামঙ্গল’-এ অপরূপ জ্যোতির্ময়ী বালা ‘তামসী-তরুণ ঊষা-কুমারীর রতন’-এর আবির্ভাব দেখা যায়। ‘সারদামঙ্গল’ এবং ‘সাধের আসনে’র মধ্যেই বিহারীলালের কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরকম বিরাট মহিমান্বিত কল্পনা, অন্তগূঢ় রহস্যময় ভাবব্যঞ্জনা, বোধাতীত ধ্যানতন্ময়তার এরকম আত্মকেন্দ্রিক বিস্তার বাংলা কাব্যে বিরলদৃষ্ট। এই দুই কাব্য রচনার সূত্রেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূচনা। তাই ‘সারদামঙ্গলে’ কাদম্বিনী দেবীর সেই বিখ্যাত জিজ্ঞাসা—
“-হে যোগীন্দ্ৰ যোগাসনে
ঢুলুঢুলু দু’নয়নে
বিভোর বিহ্বল মনে কাহারে ধেয়াও?”
—সূচিমুখে ‘স্বরচিত’ আসনে প্রশ্নটি লিপিবদ্ধ করে কাদম্বিনী দেবীর কবিকে দেওয়া আসন উপহারের সঙ্গে যে উত্তর দানের অনুরোধ ছিল, বিহারীলাল ‘সাধের আসন’ কাব্যে তারই উত্তর দিয়েছিলেন—
“ধেয়াই কাহারে দেবি নিজে আমি জানিনে।
কবিগুরু বাল্মীকির ধ্যানধনে চিনিনে ।”
আপন কাব্যাদর্শ সম্পর্কে এই অনিশ্চয়তা এর আগে বাংলা কাব্যে ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তিনি প্রথম “নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন…সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখী সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল, সে সুর তাহার নিজের।” এই ‘ভোরের পাখি’ বিহারীলাল। কবি মাত্রেই এক অর্থে ‘বিহঙ্গ’। কারণ ‘ক’ ধাতু থেকে ‘কবি’ শব্দ নিষ্পন্ন অর্থাৎ কুজন করেই কবির আনন্দ। বিহারীলালের সারদা সৌন্দর্যময়ী ও প্রেমিকার চিন্ময় রূপ, তিনি মূর্তিমতী করুণাময়ী। তাই কবির প্রার্থনা—
“এস মা ঊষার সনে
বীণাপাণি চন্দ্রাননে
রাঙাচরণ দুখানি রাখ হৃদয় কমলে।”
এই কাব্যে সরস্বতী কখনও জননী, কখনও প্রেয়সী, কখনও কন্যা। তিনি সৌন্দর্যরশ্মির দ্বারা উদ্ভাসিত। তার মধ্যে শেলির ‘Spirit of Beauty’, মধুসূদনের ‘তিলোত্তমা’ ও ‘বীরাঙ্গনা’ নারীর স্বাতন্ত্রময়ী ভাবদীপ্ত, এমনকি রবীন্দ্রনাথের “বিকশিত বিশ্ববাসনার অরবিন্দ মাঝখানে” আবির্ভূত উর্বশীর পূর্বাভাস অনুভব করা যায়।
নিভৃতে আপনমনে গান গাওয়া গীতিকবির বৈশিষ্ট্য হলেও শুধু গান গেয়েই তার দায়িত্ব শেষ হয় না। তাঁকে গান গাইতে হয় এমনভাবে যাতে তার সহৃদয়তাজাত হৃদয় সংবাদ অপরের হৃদয়কে অভিভূত করতে পারে, ভাষার ও ভাবে, ছন্দে ও শব্দের সুষম সমন্বয়ে পাঠকমনকে আকৃষ্ট করতে পারে। বিহারীলালের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি যতখানি ভাবুক, তত বড় ভাষাশিল্পী নন। তাঁর বহু কবিতায় তথ্যের শুষ্কতা সুস্পষ্ট, রসগভীর ভাবের দ্যোতনা সেই ভাষায় বিরলদৃষ্ট। যেমন, “দারুণ আগুন শুধু ধূ-ধূ-ধূ-ধূ ধায়”, কিংবা “পাজর ঝাঁঝর মোর দাঁড়াই কোথায়” ইত্যাদি পক্তি।
তাঁর কবিতায় অনেক সময় রসের অভাব ও ভাবের অতিভাব দেখা যায়। তার উপমাগুলি স্থির সংজ্ঞাবহ নয়, তা যুক্তিহীন রেখাহীন, সীমাহীন। আসলে তার শক্তির উৎস ছিল অন্যখানে। অনায়াস দক্ষতায় তিনি প্রাকৃত বাচন ও প্রাকৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। যাত্রা, পাঁচালী কবিগানের ভাষার প্রত্নাভ টঙটিকে বাঙলা কবিতায় স্থানান্তরিত করেছেন, দার্শনিক ভাবকে বাংলা কাব্যে সন্নিবেশিত করেছেন, কিন্তু ভাষা ও ভাবের সমন্বয় সর্বত্র ঘটেনি। যদি তা ঘটত তবে আধুনিক বাংলাকাব্যে তিনি নিশ্চয়ই শুধুমাত্র ‘ভোরের পাখী’ হয়েই থাকতেন না।
Leave a comment