জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্তের পৌত্র রজনীনাথ দত্তের পুত্র কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি। এঁদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার চুপি গ্রামে। জীবৎকাল তার সংক্ষিপ্ত, তবু জনপ্রিয়তার জোয়ারে দীর্ঘকাল ধরে অভিনন্দিত। জ্ঞানদীপ্ত মননধর্মিতার সঙ্গে রোমান্টিক আবেগ, গীতিপ্রাণ কল্পনাশক্তি এবং রুচির শুচিতায় তিনি ভূষিত। রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজের মধ্যেও তার শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। আবার কবিতা-অনুবাদ ব্যঙ্গ কবিতা-উপন্যাস-নাটক প্রভৃতি সাহিত্যের বিচিত্র পথেও ছিল তার অনায়াস পদচারণা। তবু সত্যেন্দ্রনাথের খ্যাতি মূলত রবীন্দ্রানুগত হয়ে কাব্যরচনায়, ছন্দের নব নব নিরীক্ষায় আর কথা দিয়ে ছবি আঁকার সহজাত ভঙ্গিমায়। পুরাণ, ভূগোল, ইতিহাস, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম নিসর্গময়তা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে তাঁর কবিতা আছে। কবির মানসিকতায় ও মননশীলতায় বুদ্ধির উজ্জ্বলতা এবং আস্তিক্যবোধের সংযম আছে, আছে কল্পনায় তার নিয়ন্ত্রণের প্রকাশ। তাঁর কাব্যে ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস ব্যক্ত হয়, প্রেম ও প্রকৃতি কাব্য-রঙ্গভূমির প্রধান পাত্রপাত্রী হয়ে দেখা দেয়, অশরীরী রহস্যময়তার পরিবর্তে জগতের স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ রূপ ছন্দে-তালে মূর্ত হয়। কবিতায় ‘imagination’-এর বদলে ‘fancy’-চপল কৌতূহল প্রাধান্য পায়। সংখ্যাধিক্য এবং প্রকরণগত বৈচিত্র্যেও তাঁর রচনা-তালিকা উল্লেখযোগ্য।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচনাসমূহ:

কাব্যগ্রন্থ : (ক) মৌলিক কবিতা, (খ) অনুবাদ কবিতা, (গ) ব্যঙ্গ কবিতা, (ঘ) উপন্যাস, (ঙ) নাটিকা, (চ) প্রবন্ধ গ্রন্থ।

কাব্য : ‘সবিতা’ (১৯০০), ‘সন্ধিক্ষণ’ (১৯০৫), ‘বেণু ও বীণা’ (১৯০৬), ‘হোমশিখা’ (১৯০৭), ‘ফুলের ফসল’ (১৯১১), ‘কুহ ও কেকা’ (১৯১২), ‘তুলির লিখন’ (১৯১৪), ‘অভ্র-আবীর’ (১৯১৬), ‘হসস্তিকা’ (‘নবকুমার কবিরত্ন’ ছদ্মনামে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা ১৯১৭), ‘বেলা শেষের গান’ (১৯২৩) ‘বিদায় আরতি’ (১৯২৪)।

অনুবাদ-কাব্য : ‘তীর্থসলিল’ (১৯০৮), ‘তীর্থরেণু’ (১৯১০), ‘মণি-মঞ্জুষা’ (১৯১৫)।

উপন্যাস : ‘জন্মদুঃখী’ (১৯১২), ‘ডঙ্কানিশান’ (ঐতিহাসিক উপন্যাস, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় আষাঢ়-কার্ত্তিক ১৩০০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়)।

নাটক : ‘রঙ্গমল্লী’ (১৯১৩), ‘ধূপের ধোঁয়া’ (১৯২৩)।

প্রবন্ধ : ‘ছন্দসরস্বতী’ (১৯১৮)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য-বৈশিষ্ট্য:

সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় দেখা যায়— (১) সৃজনী-কল্পনা অপেক্ষা খেয়ালী-কল্পনার প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ পর্যায়ে লঘু-তরল কল্পনা-বিলাস। (২) কৌতূহল জাগানোর চেষ্টা আছে কিন্তু ভাবগভীরতা নেই। (৩) কাব্যানুরঞ্জনের স্থলে সহজ-সরল জীবনরসের প্রকাশ। (৪) সুগম্ভীর ধ্যানতন্ময়তার পরিবর্তে গতিবেগের উন্মাদনা সৃষ্টি। (৫) রঙে-রেখায় ভঙ্গিতে সঙ্গীতে কাব্য বিষয়কে ইন্দ্রিয়গোচর করে তোলা। (৬) প্রথামাফিক কাব্যরীতির অনুসরণ না করে সংলাপ-ভঙ্গীর সাহায্যে দ্রুত সঞ্চারী ভাবানুসারিতা সৃষ্টি প্রভৃতি।

তাঁর কাব্যে রোমান্টিকতা থাকলেও কিন্তু হারফোর্ড-কথিত “extraordinary development of imaginative sensibility” ছিল না। আসলে সত্যেন্দ্রনাথ বিষয়ের ভাবগাম্ভীর্যে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য ছিলেন না। রঙে-রেখায়, ভঙ্গীতে আর সঙ্গীতে বিষয়কে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। এর ফলে মহৎ কবিতার ব্যঞ্জনাধর্মিতা থেকে তা বঞ্চিত হয়েছিল। এই সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্যটি সমর্থনযোগ্য “…তিনি কানের দাবি মেটাতে যতটা ব্যস্ত হয়েছিলেন, প্রাণের দাবি মেটাতে ঠিক ততখানি উদাসীন ছিলেন। প্রেমসৌন্দর্যকে তিনি শব্দমন্ত্রে বশীভূত করেছিলেন, কিন্তু জীবন সম্বন্ধে তার বিশেষ কোন বক্তব্য ছিল না, অধরা-অপ্রাপনীয় কোন সঙ্কেত তাঁকে ব্যাকুল করেনি, কোন গূঢ় রহস্য তাঁর কবিতাকে স্থূলসীমা ছাড়াতে সাহায্য করেনি”

দৃষ্টান্তস্বরূপ, তাঁর ‘বেণু ও বীণা’য় আছে প্রেম কবিতার প্রাধান্য। কিন্তু এখানে রোমান্সের রঙীন বর্ণালী থাকলেও অনুভূতির গভীরতা অনুপস্থিত। আবার গম্ভীর ভাবাত্মক সমুদ্র বন্দনার মধ্যেও মহত্তর গাম্ভীর্য বিরল, ছন্দের তরল বিলাস প্রবল; যেমন –

“সিন্ধু, তুমি বন্দনীয়, বিম্ব তুমি মাহেশ্বরী।

দীপ্ত তুমি, মুক্ত তুমি, তোমায় মোরা প্রণাম করি।

অপার তুমি, নিবিড় তুমি, অগাধ তুমি পরাণ-প্রিয়, 

গহন তুমি, গভীর তুমি, সিন্ধু তুমি বন্দনীয়। 

সিন্ধু তুমি, মহৎ কবি, ছন্দ তব প্রাচীন অতি, –

 কণ্ঠে তব বিরাজ করে ‘বিরাটরূপা-সরস্বতী’।”

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পুষ্প-বিষয়ক কবিতায় ইন্দ্রিয়প্রীতি:

সত্যেন্দ্রনাথের পুষ্প-বিষয়ক কবিতায় সৌন্দর্য-সন্ধান নয়, ইন্দ্রিয়ময়তা সুস্পষ্ট। ‘ফুলের ফসল’-এ আছে ভোগময়তার রুদ্রদীপ্তি। কবি চম্পার মধ্যে দেখেছেন রুদ্র ও তপস্যার বনে সাহসিকা অপ্সরাকে

“আমারে ফুটিতে হল বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাসে,

বিষণ্ণ যখন বিশ্ব নির্মম গ্রীষ্মের পদানত ;

রুদ্র তপস্যার বনে আধ ত্রাসে, আধেক উল্লাসে,

 একাকী আসিতে হল সাহসিকা অপ্সরার মতো।

 বনানী শোষণক্লিষ্ট মর্মরি’ উঠিল একবার, 

বারেক বিমর্ষ কুঞ্জে শোনা গেল ক্লান্ত কুম্বর; 

জন্ম যবনিকাপ্রান্তে মেলি’ নব নেত্র সুকুমার

দেখিলাম জলস্থল,-শূন্য, শুষ্ক, বিহ্বল, জর্জর।”

কখনো বা নীলকমলের মধ্যে শুনেছেন নিশীথে আলোর কামনায় তপস্যা মন্ত্র। তাঁর অনেক কবিতায় আছে পুরাণ-ভাবনার অনুষঙ্গ; যেমন—“হে নীলাম্বু! হে বিপুল! ইন্দ্রনীল নীলাম্বর সাথী / সূর্যের বারুণী সুরা! যোদ্ধ দেবতার বীরপাল”, অনেক স্থলে আছে চিত্রিত পল্লী-বর্ণনা

“… ময়রা মুদী, চক্ষু মুদি, পাটায় বসে ঢুলছে কযে

কুকুরগুলো শুঁকছে ধূলো, ধুঁকছে কেহ ক্লান্ত দেহ”।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ইতিহাস প্রসঙ্গ:

আবার অনেক স্থানে ইতিহাসের ধূষর উপকরণ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত হয়ে দৃশ্য ও শ্রুতিময় হয়ে উঠেছে ; যেমন

“মনো-যতনের সনে মণি রতনের 

দিল বিয়া রাজা শাজাহান,

পুণ্য প্রতিমা পানে চাহিয়া তাজের

কেটে গেল কত দিনমান,

বিরহীর অবসান হল বিরহের 

সেইক্ষণে টুটিল পরাণ”।

কৌতূক ও ব্যঙ্গকবিতা সংগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘হসস্তিকা’ কাব্যে। এই কবিতাগুলি ‘নবকুমার কবিরত্ন’ ছদ্মনামে প্রথমে প্রকাশিত হয়।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ কবিতা:

সত্যেন্দ্রনাথ অনুবাদক রূপেও দেখা দিয়েছেন। তিনি নরওয়ের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক Jonas Lic-এর ‘Livsslaven’ উপন্যাসের ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ‘জন্মদুঃখী’ নামে। একই ভাবে অনুবাদ কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথের কৃতিত্ব সুস্পষ্ট। তার হাফেজের-রুবাইয়াৎগুলির অনুবাদ অপূর্ব। অনুবাদ-কবিতাগুলি সংস্কৃত-ফরাসী-ইংরেজী-ফার্সী ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষা থেকে সংগৃহীত। এই অনুবাদে মূল রস অনেকখানি অক্ষুণ্ণ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই অনুবাদ কবিতার প্রতি অনুরাগে লিখেছিলেন “তোমার এই লেখাগুলি মূলকে বৃত্ত স্বরূপ আশ্রয় করিয়া স্বকীয় রস সৌন্দর্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমার বিশ্বাস কাব্যানুবাদের বিশেষ গৌরবই এই ; তাহা একই কালে অনুবাদ এবং নূতন কাব্য।”

এই প্রসঙ্গে মন্দাক্রান্তা ছন্দের অনুকরণে লেখা ‘মেঘদূত’ কাব্যাংশের কিছু অংশ স্মরণ করা যেতে পারে

“পিঙ্গল বিহুল ব্যথিত নভোতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও’, 

সন্ধ্যায় তন্দ্রার মুরতি ধরি’ আজ মন্দমস্থর বচন কও ; 

সূর্যের রক্তিম নয়নে তুমি মেঘ, দাও হে কজ্জলে, পাড়াও ঘুম, 

বৃষ্টির চুম্বনে বিথারি’ চলে যাও-অঙ্গে হর্ষের পড়ুক ধুম। 

বৃক্ষের গর্ভেই রয়েছে আজো যেই-আজ নিবাস যার গোপন লোক, 

সেই সব পল্লব সহসা ফুটিবার নষ্ট চেষ্টায় কুসুম হোক। 

গ্রীষ্মের হোক শেষ, ভরিয়া সানুদেশ স্নিগ্ধ গম্ভীর উঠুক তান, 

যক্ষের দুঃখের কর হে অবসান, যক্ষ-কান্তার জুড়াও প্রাণ।”

রবীন্দ্রানুসরণ ও পরবর্তী কবিদের উপর প্রভাব:

সত্যেন্দ্রনাথের এই অনুবাদ ও অনুবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রানুসরণ। ‘রবিরশ্মি’ পরিভাষাটি সম্ভবতঃ তাঁরই সৃষ্টি (দ্রষ্টব্য : হরপ্রসাদ মিত্র : ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ও কাব্যরূপ’, ১৯৬৪, পৃষ্ঠা ৬৮)।

রবীন্দ্রনাথের বাক্বন্ধে কথা বলার প্রবণতা ছিল ঠিক, তবু রবীন্দ্রনাথ থেকে তাঁর কবিতা যে ভিন্ন স্বাদুতা এনেছিল এ কথাও সত্য। তাই তার কবিতা সমকালীন পাঠকচিত্তকে স্পর্শ করেছিল। তাঁর কবিতায় কাঁচপোকা টিপের দীপ্তি, মেঘের কোলে আলতাপাটি শিমের আভাস, ধূপছায়া রঙের প্রকাশ, পাল্কীর গান, নৌকার মাঝি-মল্লাদের গান বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন ব’লে বিবেচিত হতে পারে। অন্যদিকে অনুজ সাহিত্যিকেরাও অদ্ভুতঃ প্রথমাবস্থায় সত্যেন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবিতার ক্ষেত্রে মোহিতলাল, নজরুল, এমনকি জীবনানন্দের মতো আধুনিকমনা কবিও ‘ঝরা পালক’ প্রভৃতি কাব্যের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের ভাষা ও ছন্দের ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “তুমি বঙ্গভারতীয় তন্ত্রী-‘পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে” –এ শুধু প্রিয়জনের প্রশংসা নয়, সংক্ষিপ্ত বাক্যে এক ঐতিহাসিক মূল্যায়নও বটে। তাই বলা যায় রবীন্দ্রানুগামী কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের স্থান সর্বোচ্চ।