ড. ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগে উপজাতিগুলির মধ্যে জাতিবৈষম্য বা শ্রেণিবৈষম্য ছিল না। পরবর্তীকালে উপজাতিগুলি ভেঙে পড়তে থাকে এবং ক্রমে জাতিভেদ প্রথার উৎপত্তি ঘটে। যজুর্বেদের যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথা চূড়ান্ত আকার নিতে থাকে।
উৎপত্তির পর থেকে ভারতের জাতিব্যবস্থা বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে।
[1] ঋগবৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১০০০): এন. কে. দত্ত, হগ, আপ্তে প্রমুখ চিন্তাবিদ মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগের সমাজেও জাতিব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ইতিহাসবিদ ড. এ. এল. বাসাম এবং ডি. ডি. কোশাম্বী প্রমুখের মতে, ঋগবৈদিক যুগের গােড়ার দিকে উপজাতীয় সমাজে জাতিবৈষম্য ছিল না। ড. কোশাম্বী মনে করেন যে, পরবর্তীকালে উপজাতিগুলি যখন ভাঙতে শুরু করে, তখনই জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটে।
[2] পরবর্তী বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৬০০): পরবর্তী বৈদিক যুগে সমাজে জাতিভেদ প্রথার উত্থান ঘটেছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন। এই সময়ে রচিত সংহিতাগুলিতে সমাজে চারটি জাতির কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এই সময় আর্য সমাজের বাইরে অবস্থানকারী ব্রাত্য’ ও নিষাদ নামে দুটি অস্পৃশ্য জাতিরও বিভিন্ন উল্লেখ পাওয়া যায়।
[3] প্রতিবাদী ধর্মের যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০) : প্রতিবাদী ধর্মের যুগে সমাজের বর্ণব্যবস্থা জাতিব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে চতুর্বর্ণের পাশাপাশি অন্ত্যজ, দাস ও অন্যান্য হীনজাতির কথা বলা হয়েছে। সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষের সঙ্গে অন্ত্যজদের বৈবাহিক বা পান-ভােজনের সম্পর্ক স্থাপনের ওপর বাধানিষেধের কথাও এইসব গ্রন্থে বলা হয়েছে।
[4] মৌর্যযুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২২-১৮৪): পূর্বের জাতিব্যবস্থা মৌর্যযুগে এসে অনেকখানি বদলে যায়। এসময় চারটি বর্ণের জায়গায় কতকগুলি পেশাগত বা বৃত্তিগত জাতির উত্থান ঘটে। মেগাস্থিনিস মৌর্যযুগের ভারতীয় সমাজে সাতটি জাতির অস্তিত্বের কথা বলেছেন। যথা—[i] দার্শনিক, [ii] কৃষক, [iii] পশু-পালক ও শিকারী, [iv] কারিগর ও শিল্পী, [v] সৈনিক, [vi] গুপ্তচর বা পরিদর্শক, [vil] মন্ত্রণাদাতা। মেগাস্থিনিস তাঁর সপ্তজাতিতত্বে বংশানুক্রমিকভাবে পেশা গ্রহণ ও স্বজাতির মধ্যে বিবাহের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
[5] মৌর্যগরবর্তী যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১৮৪-৩০০ খ্রিস্টাব্দ): মৌর্যপরবর্তী যুগে ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতির উত্থান ঘটে। এযুগে শক, গ্রিক, কুষাগ, পল্লব প্রভৃতি বিভিন্ন বিদেশি জাতিও ভারতে প্রবেশ করে ক্লমে ভারতীয় সমাজের সঙ্গে মিশে যায়। এযুগে মনুস্মৃতিতে ব্রাহ্মগদের বিশেষ অধিকারকে সমর্থন করা হয় এবং শূদ্রদের ওপর বিভিন্ন বাধানিষেধের কথা বলা হয়।
[6] গুপ্তযুগ (৩০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ): গুপ্তযুগে ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ জাতিগত (ethnic) ধর্মে পরিণত হয় এবং ব্রাহ্মপ্য জাতির প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন জাতির ওপর স্মৃতিশাস্ত্র গুলির বিধিনিষেধ আরােপিত হয়। তা সত্ত্বেও সমাজে অসবর্ণ বিবাহ চলতে থাকে এবং এর ফলে নানান মিশ্রজাতির সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীকালে হর্ষবর্ধনের আমলে এবং তার পরবর্তী আমলেও ভারতীয় সমাজে জাতিব্যবস্থা একইরকম অপরিবর্তিত থাকে।
উপসংহার: প্রাচীন ভারতে জাতিব্যবস্থার বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অধিকাংশ সময়েই ব্রাহ্অণদের আধিপত্য যেমন বেড়েছে, তেমনি শূদ্রদের সামাজিক অবনমন ঘটেছে।যাই হােক, মধ্যযুগে জাতিগত বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পেতে থাকে।
Leave a comment