সূচনা: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক এক আলােড়নের যুগ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ শুরু হয় এবং বেশকিছু নতুন ধর্মমতের উদ্ভব ঘটে। এই যুগে ভারতে প্রায় ৬৩টি নব্য ধর্মের উত্থান ঘটেছিল।

ধর্মীয় কারণ

[1] আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা: বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়। ‘শ্রমপ ও পরিব্রাজক নামে দুটি সন্ন্যাসী গােষ্ঠীর তাদের প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

[2] যাগযজ্ঞে জটিলতা বৃদ্ধি: বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাম্মণ্যধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মাচরণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। উপরন্তু এই ব্যয়বহুল ধর্মাচরণ পদ্ধতির ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

[3] ধর্মাচরণের অধিকার হ্রাস: ব্রাম্মণ্যধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে হ্রাস পায়। অথচ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমস্ত ব্যয়ভার তাদেরই বহন করতে হত। নারীরাও বেদ পাঠের অধিকার হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়।

অর্থনৈতিক কারণ

[1] কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গাে-বলি শুরু হলে নতুন কৃষি-অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জীবে দয়া এবং অহিংসার বাণী প্রচার করলে কৃষকশ্রেণি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ক্ষতিকারক ধর্মব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

[2] ব্যবসায়ীশ্রেণির উচ্চাকাঙ্ক্ষা: এই সময় নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বস্তু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্যবৃদ্ধির ফলে বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদের অবসান কামনা করে।

[3] ব্যয়বহুল আচার-অনুষ্ঠান: বৈদিক ব্রাম্মণ্যধর্ম ছিল আড়ম্বরসর্বস্ব এবং ব্যয়বহুল| ধর্মের প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ। যজ্ঞ পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য করা হত। তাই তারা নতুন ধর্মে আকৃষ্ট হয়।

রাজনৈতিক কারণ

[1] গণরাজ্য প্রতিষ্ঠা: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। সেই গণরাজ্যগুলিতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ এবং উপজাতীয় রীতিনীতির অনুসরণে বর্ণাশ্রমবিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা নব্য ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল।

[2] নতুন সমাজ স্থাপন: ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে নবগঠিত গণরাজ্যগুলিতে উপজাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বর্ণাশ্রম-বিহীন নতুন সমাজ স্থাপিত হয়। সেখানে ব্রাহ্মণদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বা বৈদিক রীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক ছিল না।

[3] মতপ্রকাশের স্বাধীনতা: গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযােগ ছিল। এই উদার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজসংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন।

সামাজিক কারণ

[1] ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ: বর্গবিভক্ত বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে—সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বহু সুযােগসুবিধার একচেটিয়া অধিকারী ছিল। অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে ব্রাহ্মণদের এই একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল।

[2] ব্রাম্মণ-ক্ষত্রিয় দ্বন্দ্ব: যুদ্ধে অংশগ্রহপ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনার মতাে গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাম্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ও অধিকার ছিল কম। এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ক্ষত্রিয়দের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে নব্য ধর্ম আন্দোলনে।

[3] বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্ষোভ: সম্পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রে আর্থসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ বা রাষ্ট্র বৈশ্য ও শূদ্রদের কোনােরকম মর্যাদা দেয়নি। এই শ্রেণিবৈষম্য তাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। বৌদ্ধ ও জৈন, এই দুই নব্য ধর্মে বর্ণভেদহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থাকায়, বৈশ্য ও শূদ্ররা এই দুই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

[4] ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীজাতির ক্ষোভ: ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারীজাতিকে সম্মানের চোখে দেখা হত না। বুদ্ধ ও মহাবীর নারীজাতি, এমনকি সমাজচ্যুতা নারীদের মর্যাদা দেওয়ায় তারা নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

দার্শনিক কারণ

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মানুষের মনে বুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে। এর ফলস্বরূপ এই সময় জন্মান্তরবাদ, কর্মফল প্রভৃতি ধর্মাচরণকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সব মানুষকেই কর্মফল ভােগ করতে হবে।

ভাষাগত কারণ

বৈদিক আর্যদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ার জন্য তা সাধারণ মানুষের বােধগম্যের বাইরে ছিল। অন্যদিকে বুদ্ধদেব আঞ্চলিক পালি ভাষায় ধর্মপ্রচার করায় তা সর্বসাধারণের সহজবােধ্য হয়।

মূল্যায়ন: ধর্মকে মানুষের জীবনে সহজসরল রূপ দেওয়ার জন্য নব্য ধর্মের উত্থান ঘটে। নব্য ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এক মানবতাবাদী জীবনমুখী ধর্মের অনুসন্ধানে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। অধ্যাপক এ. এল. ব্যাসামের মতে, “বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক আলােড়নের মাধ্যমে ভারতের এক মহান ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে।