সূচনা: ‘জিন থেকে জৈন শব্দের উদ্ভব। জয়ী অর্থে জিন শব্দের ব্যবহার করা হয়। যিনি রাগ, বিদ্বেষ-সহ বিভিন্ন রিপু জয় করতে পেরেছেন, তিনিই জয়ী বা সিদ্ধপুরুষ অর্থাৎ জিন। এই জিনদের প্রচারিত ধর্মমতই হল জৈনধর্ম।
[1] দর্শন: জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়নি। জৈন মতে, বিশ্বসৃষ্টি ও তা রক্ষার পেছনে কোনাে দৈব অনুগ্রহ নেই। জৈনরা জীব বা প্রাণের ব্যাপক অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কর্মফল ভােগ করতেই জীবের পুনর্জন্ম ঘটে। এই কর্মবল্ধন ছিন্ন করতে পারলেই জীবের মােক্ষ বা মুক্তিলাভ ঘটবে। এ ছাড়া কৃষ্ছসাধনকেই জৈনরা শাশ্বত সত্যকে জানার একমাত্র উপায় বলে মনে করতেন। অনশনের মাধ্যমে মৃত্যুকে জৈনরা পরম পুণ্যের পরিচায়ক বলে মনে করত।
[2] ত্রিরত্ন: কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে মহাবীর তিনটি পথ নির্দেশ করেছেন—সৎ বিশ্বাস, সৎ আচরণ ও সৎ জ্ঞান। এই তিনটি নীতি ‘ত্রিরত্ন নামে খ্যাত। জৈনরা কঠোর কৃচ্ছ্বসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন।
[3] চতুর্যাম: পার্শ্বনাথ প্রচারিত চারটি মূল নীতি ছিল- [i] অহিংসা, [ii] মিথ্যা কথা না বলা (সত্যবাদিতা), [iii] চুরি না করা (অচৌর্য) এবং [iv] পরদ্রব্য গ্রহণ না করা (অপরিগ্রহ)। এগুলি চতুর্যাম নামে খ্যাত।
[4] পঞ্চমহাব্রত: মহাবীর চতুর্যামের চারটি নীতির সঙ্গে আরও একটি নীতি যােগ করেন। এই পঞ্চম নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য, অর্থাৎ সংযমপূর্ণ পবিত্র জীবন যাপন করা। এই পাঁচটি নীতির মিলিত রূপকে পঞ্চমহাব্রত বলে। পঞ্চমহাব্রত নামে খ্যাত এই পাঁচটি নীতিই জৈনধর্মের সারকথা।
[5] মহাবীরের ধর্মনীতি: মহাবীর কর্মফলবাদ এবং জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভালাে কাজ করলে উচ্চবর্ণে উত্তরণ ঘটে। তার ধারণা ছিল ত্রিরত্নের দ্বারা আত্মার মুক্তি লাভ ঘটে। মহাবীর চরম কৃচ্ছ্বসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, মনকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য তপস্যার পাশাপাশি অহিংস নীতি গ্রহণ ও উপবাসের প্রয়ােজন।
[6] জৈনধর্মের বিস্তার: জৈনধর্ম প্রথমে পূর্ব ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পরে তা পশ্চিম ভারতে বিস্তৃত হয়। বিম্বিসার, অজাতশত্রু, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রমুখের পৃষ্ঠপােষকতায় মগধ, অঙ্গ, কোশল-সহ একাধিক মহাজনপদে জৈনধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
[7] জৈনধর্মের প্রভাব
-
সহজ সরল ধর্মাচরণের পথপ্রদর্শক: জটিল ও ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞকেন্দ্রিক বৈদিক ধর্মাচরণের পরিবর্তে ভারত বাসীকে সহজসরল ধর্মাচরণের পথ দেখিয়েছিল জৈনধর্ম।
-
বর্ণভেদপ্রথার কঠোরতা হ্রাস: জৈনধর্মাচার্যরাই প্রথম সব মানুষের সমান অধিকারের দাবি তুলে এবং বর্ণপ্রথার বিরােধিতা করে ভারতীয় সমাজে জাতপাতের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করেছিলেন।
-
ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার: জৈনধর্মের সুদের কারবার ও সমুদ্রযাত্রাকে স্বীকৃতিদান ব্যাবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়।
-
কলুষতামুক্ত সমাজ গঠন: সৎকর্মের মাধ্যমে সমস্ত মানুষই মােক্ষ লাভ করতে পারবে—জৈনধর্মের এই শিক্ষা সমাজকে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মিথ্যাচার প্রভৃতি কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে পেরেছিল।
-
শিল্প, সাহিত্য ও ভাষার বিকাশ: প্রাচীন কালে ভারতে নির্মিত উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, মাউন্ট আবু এবং শ্রবণবেলগােলার জৈনমন্দিরগুলি স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন। সংস্কৃত ভাষায় জৈন পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের রচিত টীকাভাষ্যগুলি সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। জৈন পণ্ডিতদের অর্ধমাগধী ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যচর্চা আঞ্চলিক ভারতীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল।
Leave a comment