সূচনা: ষােড়শ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ইউরােপে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে এক সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। খ্রিস্টানজগতের চার্চ ও পােপতন্ত্রের নানান অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন রিফরমেশন বা ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত।

ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

[1] চার্চতন্ত্রের দুনীতি: চার্চগুলি ছিল দুর্নীতির আখরা। অর্থের বিনিময়ে যাজক পদ বিক্রয় করা হত, অনেকসময় যাজকদের নিকট আত্মীয়দেরও যাজকল্পদে বসানাে হত।

[2] পােপতন্ত্রের দুর্নীতি: চার্চের আদায় করা অর্থ পােপ ভােগবিলাসে খরচ করতেন। অনাচার, ব্যভিচার, বিলাসব্যসন, মদ্যপান ইত্যাদি যাজক জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।

[3] পােপদের অর্থ ও ক্ষমতা লিপ্সা: সমগ্র খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু পােপেরা রাজার অভিষেক থেকে শুরু করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। উৎকোচ গ্রহণের পাশাপাশি ‘অ্যানেটস’, ‘টেথস’, ‘ফাস্টফুট’, ‘টাইথ’ প্রভৃতি কর এবং ‘ইনডালজেন্স বিক্রি থেকে পােপেদের প্রচুর অর্থ আয় হত।

[4] জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান: দ্বাদশ শতকে সামন্ততন্ত্রের পতনের পর জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ঘটতে শুরু করে। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ ইউরােপীয় বেশ কিছু দেশে রাজারা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। এই রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষকতায় সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।

[5] মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাব: মুদ্রণ-যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে চার্চের নানান দুর্নীতি ও তার সমালােচনা বই ও পুস্তিকা আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষিত শ্রেণি বুঝতে শুরু করে ধর্মশাস্ত্রে আসলে কী বলা আছে আর চার্চ তা থেকে সরে গিয়ে কী বলছে।

[6] বিভিন্ন পণ্ডিত ও মানবতাবাদীদের ভূমিকা: ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ, বােহেমিয়ার জন হাস, ফ্রান্সের পিটার ওয়ালভাে, ইটালির জিওলামাে সাভােনারােলা, হল্যান্ডের এরাসমাস প্রমুখ পণ্ডিত ও মানবতাবাদীগণ চার্চ ও পােপতন্ত্রের বিভিন্ন দুর্নীতির সমালােচনা করে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।

ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রসার

[1] জার্মানিতে: ষােড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ইউরােপের মধ্যে মার্টিন লুথারই সর্বপ্রথম জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। তিনি চার্চ ও পােপতন্ত্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খােলেন৷ উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে ৯৫ থিসিস টাঙিয়ে দিয়ে তিনি যে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটান তা সমগ্র ইউরােপকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

[2] সুইটজারল্যান্ডে: সুইটজারল্যান্ডে উলরিখ জুইংলি (জাতিতে জার্মান)র নেতৃত্বে ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। জুইংলির মতে, ধর্মীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মশাস্ত্রকে অনুসরণ করা উচিত। জুরিখের টাউন হলে আয়ােজিত এক বিতর্ক সভায় (১৫২৩ খ্রি.) জুইংলি লুথারের অনুকরণে ‘Sixty-Seven Articles পেশ করেন। তাঁর এই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য ছিল ঈশ্বরের করুণার ওপরেই মানুষের মুক্তি নির্ভরশীল।

[3] ইংল্যান্ডে: ইংল্যান্ডে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। ইংল্যান্ড-রাজ অষ্টম হেনরির আমলে চার্চ ও রাজার দ্বন্দ্ব চরমে পোঁছােয়। ঐতিহাসিক পােলার্ডের মতে, বিবাহবিচ্ছেদ প্রসঙঙ্গাকে কেন্দ্র করে অষ্টম হেনরি ও পােপের মধ্যে সংঘর্ষ চরম রূপ নেয়। এই সংঘর্ষে শেষপর্যন্ত অষ্টম হেনরি জয়ী হন এবং চার্চের জাতীয়করণ হয়ে যায়। অষ্টম হেনরি একাধারে নিজেকে রাজা, পােপ এবং সম্রাট হিসেবে তুলে ধরেন। ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করেছিল জন ওয়াইক্লিফের ললার্ড গােষ্ঠী।

[4] স্কটল্যান্ডে: ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে জন নক্স স্কটল্যান্ড থেকে প্রথম ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। জন নক্স এখানে ফরাসি ক্যাথােলিক ধর্ম ও রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। স্কটল্যান্ড থেকে ফরাসি কর্তৃত্বের অবসান ঘটলে এখানে প্রােটেস্ট্যান্টপন্থী অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় হয়।

[5] ফ্রান্সে: জুইংলির মৃত্যুর পর জন ক্যলভিন রােমান ক্যাথলিক চার্চ ও পােপতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিজের মতবাদ ঘােষণা করেন। তিনি ফরাসি রাষ্ট্রীয় দমননীতির কারণে সুইটজারল্যান্ডের জেনিভায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই তিনি জুইংলির চার্চ সংগঠনের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।