সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্প স্থাপনে ইউরােপীয় পুঁজিপতিরা বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়ােগ করে। তাদের উদ্যোগে এদেশে যেসব শিল্পের বিকাশ ঘটে সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বাগিচা শিল্পের বিকাশ। যেমন-চা, কফি, নীল, আখ প্রভৃতি শিল্প।
[1] চা:
-
প্রাথমিক উদ্যোগ: রবার্ট ব্রুস নামে জনৈক ইংরেজ আসামের জঙ্গলে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে চা গাছ আবিষ্কার করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক সর্বপ্রথম চায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং এ সম্পর্কে কিছু তথ্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘চা কমিটি’ গঠন করেন যার ভিত্তিতে ভারতে চা-শিল্প গড়ে ওঠে।
-
চা উৎপাদক অঞ্চল: সরকারি সহযোগিতায় আসাম, বাংলার পার্বত্য অঞ্চল, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের কাংড়া অঞ্চল, হিমালয়ের তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল, দক্ষিণ ভারতের পার্বত্য অঞ্চল, নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতি এলাকায় ধীরে ধীরে চা শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। কয়েকজন ইংরেজ শিল্পপতি ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আসাম টি কোম্পানি’ গড়ে তােলেন।
-
ব্যাপক প্রসার: ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে চা শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ২০টি চা কোম্পানি রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়। ১৮৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে উৎপন্ন মােট চায়ের পরিমাণ ছিল ছয় লক্ষ পাউন্ডেরও বেশি। উনিশ শতকের শেষদিকে চা শিল্পের অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন ভারত থেকে ১৩ কোটি ৭০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের চা ক্রয় করে। চা শিল্পের প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘দ্য ইন্ডিয়ান টি অ্যাসােসিয়েশন’ (১৮৮১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এদেশে প্রায় ৫ লক্ষ ২০ হাজার একর জমির ওপর ৩০২টি চা বাগিচা গড়ে ওঠে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭,০৭,৭৩৩ একর।
[2] কফি: ইউরােপীয় মালিকানায় ফোর্ট গ্লস্টার সংস্থা ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় প্রথম কফি চাষ শুরু করে। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চল এবং মহীশূরে কফির চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ ভারতের দুটি উল্লেখযােগ্য কফি চাষ কেন্দ্র ছিল কুর্গ ও ওয়েইনাদ। কফি শিল্পে ইউরােপীয় উদ্যোগে যেসব কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ডানকান ব্রাদার্স, উইলিয়ামস্ ম্যাগর, অ্যান্ড্র ইয়ুল প্রভৃতি। তবে এই শিল্পে ভারতীয় পুঁজিপতিরা বিশেষ সাফল্য পাননি।
[3] নীল: বাংলায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম নীল কারখানা স্থাপিত হয়। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করত নীল। এই সময় ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটলে ইংল্যান্ডে বাংলার নীলের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ইংরেজ নীলকর সাহেবরা বাংলার নীলচাষিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালাত। শেষপর্যন্ত ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হলে ভারতে নীলচাষ গতি হারায়।
[4] আখ: ইউরােপীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে এদেশে বিহারের মারহাওড়ায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চিনিকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতের ৩০টি চিনিকলে প্রায় ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টন চিনি উৎপাদিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের মধ্যে ভারতে চিনিকলের সংখ্যা ১৬১-তে পৌঁছােয়। অবশ্য। এর সবগুলিই ইউরােপীয় পুঁজিপতিদের মালিকানাধীনে গড়ে উঠেছিল।
উপসংহার: ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকারের অবসান ঘটে। ফলে ইউরােপীয় পুঁজিপতিরা এদেশে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়ােগ করে। শিল্পে ইউরােপীয় পুঁজিপতিদের তুলনায় দেশীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগ ছিল খুবই সামান্য।
Leave a comment