সূচনা: মাত্র ১৫ মাসের রাজত্বকালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। উভয়ের সম্পর্কের চরম পরিণতি ছিল পলাশির যুদ্ধ।

[1] নবাব সিরাজের অবমাননা: সিরাজ নবাব পদে বসার পর রীতি মেনে ওলন্দাজ ফরাসি বণিকগণ ও বাংলার জমিদাররা সিরাজকে নজরানা পাঠিয়ে যথাযােগ্য সম্মান জানান। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে কোনাে উপঢৌকন না আসায় নবাব সিরাজ বিরক্ত হন।

[2] দন্তকের অপব্যবহার: ফারুখশিয়ারের ফরমান অনুসারে (১৭১৭ খ্রি.) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দস্তক বা বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু সিরাজের আপত্তি সত্ত্বেও কোম্পানির কর্মচারীবৃন্দ ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তক ব্যবহার করতে থাকলে নবাব তার প্রাপ্য শুল্ক থেকে বঞ্চিত হন।

[3] ষড়যন্ত্রে মদত দান: সিরাজের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই নবাব হিসেবে সিরাজকে মনে নিতে পারেননি। সিরাজ মসনদে বসার পর তাই পারিবারিক অন্তঃকলহ বাঁধে। সুচতুর ক্লাইভ এই পারিবারিক অন্তঃকলহকে সিরাজ বিরােধী ষড়যন্ত্রের রূপ দেন। সিরাজ নিজে এই ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের হস্তক্ষেপের সত্যতা যাচাই করেন। ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের মদত রয়েছে জেনে সিরাজ কোম্পানির ওপর বেজায় ক্ষুধ হন।

[4] সিরাজের দূতকে অপমান: ঢাকার নবাবের বিধবা রানি (সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগম)র দেওয়ান রাজবল্লভের পুত্র কৃয়দাস নবাবির ৫৩ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। এই বিপুল অর্থ নিয়ে তিনি সপরিবারে কলকাতায় ইংরেজের ডেরায় আশ্রয় নেন। সিরাজ এ সংবাদ শুনে ব্যক্তিগত দূত নারায়ণ দাসের মাধ্যমে কৃয়দাসকে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশবার্তা পাঠান। কিন্তু গভর্নর ড্রেক নারায়ণ দাসকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। নারায়ণ দাসের এই অপমানে সিরাজ নিজে ভীষণভাবে অপমানিত বােধ করেন।

[5] দুর্গ নির্মাণ: সিরাজের আমলে এই প্রথম ফরাসিরা চন্দননগরে এবং ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করে। সিরাজ এ সংবাদ পেয়ে অবিলম্বে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার আদেশ পাঠান। সিরাজের আদেশ পেয়ে ফরাসিরা দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিলেও ইংরেজরা সিরাজের নির্দেশ অমান্য করে। দুর্গ নির্মাণ চালু রাখে ও তার ওপর কামান বসায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সিরাজ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে ওঠে।

[6] সিরাজের কলকাতা আক্রমণ: নির্দেশ অমান্য করে কোম্পানি বাংলায় দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখায় ক্ষুদ্ধ সিরাজ কলকাতায় অভিযান চালান। কাশিমবাজার কুঠির দখল (১৭৫৬ খ্রি. ৪ জুন) নেওয়ার পর তিনি কলকাতায় পৌঁছােন (১৬ জুন)। গভর্নর ড্রেক, সেনাপ্রধান ও অন্যান্য ব্রিটিশ নেতৃবর্গ দুর্গ ছেড়ে ফলতায় পালিয়ে যান। কলকাতা দখলের পর সিরাজ তার নাম দেন আলিনগর। সেনাপতি মানিকচাদের ওপর কলকাতার দেখাশােনার দায়িত্ব দিয়ে সিরাজ পুনরায় মুর্শিদাবাদ ফিরে যান।

[1] বাংলায় কোম্পানির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায়: পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলায় ব্রিটিশ প্রাধান্যের সূচনা ঘটে। বাংলার নবাবকে পুতুল নবাবে পরিণত করে, বাংলার রাজনীতির প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে কোম্পানি।

[2] ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্যের সূচনায়: বাংলায় রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরে সারা ভারতে ব্রিটিশরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগ নেয়। বাংলার সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলগুলিকেও ব্রিটিশরা নিজেদের অধিকার আনার চেষ্টা শুরু করে।

[3] প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধিতে: পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ শূন্যতার সৃষ্টি হয়। একের পর এক নবাবকে সিংহাসনে বসিয়ে কোম্পানি আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করতে চাইলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিচালনায় জটিলতার সৃষ্টি হয়।

[4] ব্যাবসাবাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্বে: পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানির নির্দ্বিধায় বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকার বা দস্তকের প্রয়ােগ ঘটাতে শুরু করে। ফলে বাংলা ব্যাবসাবাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে দেশীয় ব্যাবসাবাণিজ্যের সর্বনাশ ঘটে।

[5] নতুন যুগের সূচনায়: পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা এদেশে শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার স্পর্শে ভারতের সমাজ ও সভ্যতার নবজাগরণ ঘটে। ফলে মধ্যযুগের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে।

উপসংহার: পলাশির যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করে। ড. তারাচাদের মতে, পলাশির পরাজয় ভারতের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। (The defeat of Plassey exposed all the Indian weakness).