ভূমিকা: রাজা রামমােহন রায় হলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক। তিনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের তীব্র বিরােধিতা সত্ত্বেও সমাজসংস্কারে উদ্যোগী ছিলেন ও একাই লড়াই করে গিয়েছিলেন।
[1] সতীদাহ প্রথা:
-
রামমােহনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি: হিন্দু নারীর জীবনে এক নিষ্ঠুর অভিশাপ ছিল সতীদাহপ্রথা। তখনকার সমাজে রক্ষণশীল হিন্দুরা মৃত স্বামীর বিধবা স্ত্রীকে বােঝাতেন যে, স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেলে পুণ্য অর্জন হবে এবং পরলােকে সে তার মৃত স্বামীর সাহচর্য পাবে। রামমােহন রায়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই নিষ্ঠুর সতীদাহপ্রথা রদ। তিনি বিভিন্ন গুণীজনের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্রের মাধ্যমে সরকারকে জানান, মানবতাবােধ ও শাস্ত্র সকল দিক থেকেই সতীদাহ নিন্দনীয়। এই কাজ নরহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
-
সতীদাহপ্রথার উদ্দেশ্য: সতীদাহপ্রথা চালু রাখার পিছনে সে সময়কার গোঁড়া ব্রাত্মণদের কিছু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া তৎকালীন হিন্দুসমাজের কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস এই প্রথা প্রচলিত থাকার পেছনে দায়ী ছিল। মৃত কুলীন পতির বহু বিধবার দায় এড়ানাের জন্য অর্থাৎ বিধবা নারীকে ভরণপােষণ করার যে ঝঞ্ঝাট বা দায়িত্ব থাকে তা থেকে উচ্চবর্ণের পরিবারগুলিকে রেহাই দিতে চাওয়া হয়েছিল। সে সময়ের সমাজের নিয়ন্ত্রকগণ বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিল। হিন্দুধর্মের সে সময়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবা পত্নীকে একই চিতায় দাহ করতে পারলে পরলােক গিয়ে পত্নীটি তার স্বামীর সাহচর্য পাবে। সতীদাহপ্রথায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলে বিধবা নারীটি সতীরূপে সারা গ্রামে পূজিতা হবেন এবং তার নামে কোনাে মনস্কামনা করলে তা পূরণ হবে—এই ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
-
সতীদাহপ্রথার বিবরণ: বাংলার সমাজে সতীদাহ নামে যে নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথাটি প্রচলিত ছিল, সেটি ছিল এরকম- উচ্চবর্ণের পরিবারে কোনাে বধূ স্বামীহারা হলে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সেই বিধবা নারীটিকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। জ্বলন্ত চিতায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সময় বিধবাটির চিৎকার যাতে অন্য কারাের কানে না পৌঁছােয় তার জন্য শ্মশানে ঢাক, ঢােল, কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে একদল মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠত।
-
সতীদাহপ্রথা রদে রামমােহনের প্রচেষ্টা: রামমোহন সতীদাহপ্রথা বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ একটি ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয় কুপ্রথা। এই প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর নিয়ে বড়লাট বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন। রামমােহনকে এসময় সমর্থন জানিয়ে সমাচার দর্পণ, সংবাদ কৌমুদী, বেঙ্গল হরকরা, ইন্ডিয়ান গেজেট, ক্যালকাটা জার্নাল, ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্রপত্রিকাতেও সতীদাহ বিরােধী লেখা প্রকাশিত হয়। রামমােহন নিজে সতীদাহ-বিরােধী এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন (১৮১৮ খ্রি.)।
-
সতীদাহপ্রথা রদ: রামমােহনের চেষ্টায় সতীদাহপ্রথাবিরােধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার রেশ বেন্টিঙ্ককেও স্পর্শ করে। বেন্টিঙ্ক ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা রদ করেন (১৮২৯ খ্রি. ৪ ডিসেম্বর)। ঘােষণা করা হয় সতীদাহপ্রথা হল বেআইনি এবং তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযােগ্য অপরাধ। মাদ্রাজ-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে এই আইন কার্যকারী হয়। যােগেশচন্দ্র বাগল মুক্তির সন্ধানে ভারত গ্রন্থে লিখেছেন, “রামমােহন জনসাধারণের চক্ষে সতীদাহ দমনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। টাউন হলের এক জনসভায় তাকে এজন্য কলিকাতার বিশিষ্ট নাগরিকরা সম্বর্ধনা দেন।”
[2] জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা: রামমােহন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরােধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরার জন্য ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন।
[3] নারীকল্যাণ প্রচেষ্টা: রামমােহন প্রথম অনুভব করেছিলেন যে, সমাজে নারীদের অবস্থানের উন্নয়ন ঘটানাে এবং তাদের মর্যাদা বাড়ানাে দরকার। তিনি মূলত যেসব নারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন সেগুলি হল一
-
[i] স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনি যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, ব্যাস প্রমুখ শাস্ত্রকারদের শাস্ত্রবিধান তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার রয়েছে।
-
[ii] স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার। কারণ তিনি মনে করতেন নারীসমাজকে শিক্ষার আলােয় নিয়ে আসতে না পারলে সমাজের প্রগতি ও সভ্যতার উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যাবে।
-
[iii] কৌলীন্য প্রথার শিকার নারীসমাজকে রক্ষা করা।
-
[iv] বিবাহবিষয়ক এক নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা।
মূল্যায়ন: রামমােহনই হলেন ভারতের প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি সমাজ সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই কাজে ব্রতী হন।
Leave a comment