ভূমিকা: আধুনিক ভারতের নিমার্তারূপে ভারতপথিক’ রাজা রামমােহন রায় যে সংস্কারমুখী কাজগুলি করে গেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ভারতবর্ষ আধুনিক রূপ পেয়েছে। তাই তাকে ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়।
সতীদাহপ্রথার অবসান: তৎকালীন হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর চিতায় তার স্ত্রীকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। আসলে মৃত কুলীন ব্যক্তিকে বহু বিধবার দায় থেকে মুক্তি, মৃতার সম্পত্তি গ্রাসের ইচ্ছা ও অন্যান্য সামাজিক জটিলতা এড়ানাের লক্ষ্যে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে এই জঘন্য সতীদাহপ্রথার প্রচলন ছিল। এই প্রথাটি বন্ধ করবার জন্য রামমােহন সেসময়কার বাংলার ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সম্মিলিত এক আবেদনপত্রে তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে পাঠান। বেন্টিঙ্ক রামমােহনের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি বলে ঘােষিত করেন।
জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা: রামমােহন জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরােধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন। তবে সমালােচকদের মতে, জাতিভেদ প্রথার বিরােধী হয়েও তিনি উপবীত ধারণ করতেন।
নারীকল্যাণ প্রচেষ্টা:
-
[i] স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে রামমােহন লড়াই করেছিলেন। তিনি যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, ব্যাস প্রমুখ শাস্ত্রকারদের শাস্ত্রবিধান তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার রয়েছে।
-
[ii] স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার চেয়েছিলেন রামমােহন। কারণ তিনি মনে করতেন নারীসমাজে শিক্ষার আলাে নিয়ে আসতে না পারলে সমাজের প্রগতি ও সভ্যতার উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যাবে।
-
[iii] কৌলীন্য প্রথা থেকে নারীসমাজকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তিনি।
-
[iv] বিবাহ বিষয়ক এক নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করার ওপর জোর দেন তিনি।
একেশ্বরবাদের প্রচার: মূর্তিপূজার ঘাের বিরােধী ছিলেন বলেই তিনি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই কারণে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে তার বিশুদ্ধ রূপটি তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেন।
কুসংস্কারের বিরােধিতা: ধর্মীয় ক্ষেত্রে রামমােহন এক যুক্তিবাদী মন নিয়ে চিন্তার স্বচ্ছতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ধর্মীয় কুসংস্কারগুলি দূর করার উদ্যোগ নেন। ইংল্যান্ডে অতিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি ইউনিটেরিয়ান খ্রিস্টধর্মের অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক: প্রাচ্য দর্শনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ভারতের পুনর্জাগরণের উপায় বলে রামমােহন মনে করতেন। তাই তিনি নিজে সংস্কৃত সাহিত্য, জৈনধর্ম, হিন্দু দর্শন, আরবি, ফারসি ও কোরানের মূল শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি, লাতিন, হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসীকে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক মনের অধিকারী করে তুলবে।
স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা: রামমােহন শিক্ষার সার্বিক প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। এই লক্ষ্যে তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলেকজান্ডার ডাফের সহযােগিতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলাে হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
সংবাদপত্র প্রকাশনা: রামমােহন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও ফারসি ভাষার বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১৮২২ খ্রি.) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্রের নিদর্শন।
রামমােহনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় মেলে সিলেক্ট কমিটির নির্ধারিত আর্থিক সমস্যার সমাধানকল্পে তার অভিমত থেকে। ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্যয়সংকোচের প্রশ্নে রামমােহনের অভিমত ছিল অধিক বেতনের ইউরােপীয় কর্মচারীর পরিবর্তে ভারতীয় কালেক্টর নিয়ােগ অধিক উপযােগী। রামমােহনের যুক্তি ছিল—অবাধ বাণিজ্যনীতির সূত্রে ভারতে ব্যাপকভাবে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটবে, তার সুফল হিসেবে ভারতবাসীর আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে। রামমােহন সম্পদের নির্গমনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেও অবশিল্পায়নের প্রশ্নে নীরব ছিলেন।
রামমােহনের রাজনৈতিক ভাবনা মন্তেস্ক, রুশাে, ভলতেয়ার, টম-পেইন, বেন্থাম প্রমুখের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। [1] তিনি মনে করতেন ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানাের জন্য ভারতবর্ষের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে নিয়ে ব্রিটিশ পালার্মেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই শ্রেয়। রামমােহন সাংবিধানিক নিয়ম মেনে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে শাসনতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন। [2] সমকালীন ইউরােপের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় রামমােহনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। যেমন—ইতালির রাজতন্ত্র বিরােধী অভ্যুত্থানের (১৮২১ খ্রি.) ব্যর্থতায় তিনি হতাশ হন। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় স্পেন বিরােধী বিদ্রোহের (১৮২৩ খ্রি.) সফলতা এবং ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রি. জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে তিনি উৎফুল্ল হন।
মূল্যায়ন: উনিশ শতকের সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুসমাজে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষার উদারীকরণের ক্ষেত্রে রামমােহন ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অগ্রদূত স্বরূপ।
Leave a comment