সূচনা: বিংশ শতকের শুরুতে চিনে প্রকৃত বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাহিত্য-সহ অন্যান্য বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটানাের প্রয়াস শুরু হয়।
[1] বিদেশি আধিপত্যের বিরােধিতা: চিনে বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে সেদেশের বুদ্ধিজীবীরা সরব হন। ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদ্র জাপানের কাছে সুবিশাল চিনের পরাজয় চিনের বুদ্ধিজীবীদের সচেতন করে তােলে। তারা ‘জাতিকে বাচাও’ শ্লোগান তুলে সাধারণ মানুষের মনে দেশাত্মবােধ জাগ্রত করার উদ্যোগ নেন। তারা জাপান সরকারের বিরুদ্ধে চিনের মানুষকে সচেতন করে তােলেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান চিন সরকারের কাছে ২১দফা দাবি পেশ করলে বুদ্ধিজীবীরা এর বিরুদ্ধে সরব হন।
[2] কাং-ইউ-ওয়ের ভূমিকা: চিনের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আধুনিক ঋষি নামে পরিচিত দেশপ্রেমিক ও চিন্তাবিদ কাং ইউ-ওয়ে। তার নেতৃত্বে চিনে ‘তরুণ চিন আন্দোলন’ গড়ে ওঠে। চিনে সংস্কারের দাবিতে তিনি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২ মে সম্রাটের কাছে প্রায় ১৩০০ বুদ্ধিজীবীর সাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দেন। বুদ্ধিজীবীরা এই সংস্কারের দাবির সমর্থনে সমগ্র চিনে জনমত গঠন করেন। আধুনিক সংস্কারের সপক্ষে চিনে প্রচুর পাঠচক্র গড়ে ওঠে। চিনের নাবালক সম্রাট কোয়াং সু সংস্কারের দাবি মেনে নিয়ে এক সংস্কার কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এই সংস্কারকার্য ১০০ দিন ধরে চলে বলে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের সংস্কার ‘শতদিবসের সংস্কার’ নামে পরিচিত।
[3] ভাষার অগ্রগতি: চিনের সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য সেখানকার কথ্যভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রে তাইপিং বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিজীবীগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। হু শী, চেন- তু-সিউ প্রমুখ বুদ্ধিজীবী উপলদ্ধি করেন যে, চিনে গণ আন্দোলনের চেতনা প্রচার করতে গেলে তা সহজসরল ভাষায় করা দরকার। তাই তাদের প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের কথ্যভাষায় লেখার প্রচলন, পত্রপত্রিকা ও পুস্তকে কথ্যভাষার ব্যবহার শুরু হয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মূল্যবান গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ শুরু করেন ইয়েন-ফু এবং লি-সু নামে দুজন প্রখ্যাত অনুবাদক। প্রাচীন ভাষার জটিলতা থেকে মুক্তিলাভ এবং ‘পাই-হুয়া’ বা কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনার ফলে এই সময় চিনা সাহিত্যের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। নতুন এই ভাষায় সাহিত্য-পাঠ সহজ হয়ে ওঠে।
[4] পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ: চিনের পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল অধ্যাপকগণ চিনাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও আধুনিক ভাবধারার প্রসারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। নতুন বুদ্ধিজীবীদের নেতা সাই উয়ান-পেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। তার উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের যথার্থ উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন। তাঁর ছত্রছায়ায় নতুন বুদ্ধিজীবীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হলে বৌদ্ধিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।
[5] চেন-তু-শিউ-র উদ্যোগ: পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু শিউ ছাত্রদের প্রাচীন কনফুসীয় মতবাদ পরিত্যাগ করে যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ প্রভৃতি আদর্শে দীক্ষিত করেন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর প্রেরণায় চিনে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের পঠন-পাঠন, চর্চা ও অনুশীলন শুরু হয়।
[6] সংবাদপত্রের প্রকাশ: বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে চিনে এই সময় কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাগরণ’, ‘জ্ঞানের আলাে’, নব তারুণ্য প্রভৃতি। ‘নব তারুণ্য’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন চেন-তু শিউ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে পিকিং-এর কিছু ছাত্রের উদ্যোগে ‘নতুন জোয়ার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সংবাদপত্র প্রকাশেও জটিলতামুক্ত নতুন ও সহজ ভাষারীতি গ্রহণ করা হয়। এই পত্রিকাগুলি দেশবাসীকে নব মার্কসবাদ, আধুনিকতা ও বহু নতুন ভাবাদর্শে দীক্ষিত করে।
[7] বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা: বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে চিনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল হুনান প্রদেশে মাও সে-তুং-এর ‘নতুন গণ অধ্যয়ন সমিতি’ এবং টিয়েন সিন নামক স্থানে চৌ এন-লাই-এর ‘জাগরণ সমিতি’। ক্রমে বুদ্ধিজীবীরা দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণপন্থীরা অরাজনৈতিক পথে অগ্রসর হলেও বামপন্থীরা রাজনীতির সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এভাবে চিনে এক ধরনের নবজাগরণ ঘটে যায়, যা যুবশক্তিকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে।
উপসংহার: চিনে বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ছড়িয়ে পড়া আধুনিক ভাবধারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি করে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মের আন্দোলন তারই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি।
Leave a comment