গান্ধিজি একসময় ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ’ বলে মনে করলেও কুখ্যাত রাওলাট আইনের সুপারিশগুলি কংগ্রেসের উদীয়মান নেতা মহাত্মা গান্ধিকে বিস্মিত করে। এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধিজি ব্রিটিশ শাসনকে ‘শয়তানবাদ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তােলেন। এই আন্দোলন ‘রাওলাট সত্যাগ্রহ’ নামে পরিচিত।
[1] প্রস্তুতি: প্রথমদিকে হােমরুল লিগের কিছু কর্মী ও কয়েকটি ইসলামপন্থী গােষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে গান্ধিজি রাওলাট সত্যাগ্রহে শামিল হন। অহিংস উপায়ে এবং শান্তিপূর্ণভাবে আইন অমান্য করে কারাবরণ করা ছিল রাওলাট সত্যাগ্রহের প্রধান কর্মপন্থা। মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে তিনি দিল্লি, বােম্বাই, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে আন্দোলনের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার চালান। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রচার-পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়।
[2] কংগ্রেসের উদ্যোগ: রাওলাট সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধিজি জাতীয় কংগ্রেসকে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে শামিল করেন। কংগ্রেস এই আন্দোলনকে শহরে, গ্রামে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র প্রভৃতি সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এভাবে কংগ্রেস তার দুর্বলতা কাটিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
[3] সত্যাগ্রহ সভা: রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের উদ্দেশ্যে গান্ধিজির সভাপতিত্বে ‘সত্যাগ্রহ সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাওলাট সত্যাগ্রহ শুরু হয়। এর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় বােম্বাই শহরে।
[4] ধর্মঘট: গান্ধিজির ডাকে ৬ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) সারা দেশে অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। এটিই ছিল প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট। দিল্লিতে পুলিশের গুলিতে ৮ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হলে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দিল্লি অন্তত ৭ দিন অচল থাকে। ১০ এপ্রিল পুলিশ গান্ধিজিকে গ্রেপ্তার করলে দেশ বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে।
[5] মুসলিমদের ভূমিকা: মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ রাওলাট সত্যাগ্রহে শামিল হয়। জাফর আলি খান, কবি মহম্মদ ইকবাল, যুব নেতা আনসারি প্রমুখ মুসলিম নেতৃত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাওলাট সত্যাগ্রহের প্রসার ঘটান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সারা দেশে এত তীব্র আন্দোলন সত্ত্বেও সরকার কিন্তু রাওলাট আইন প্রত্যাহার করেনি।
ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তীব্র দমনমূলক রাওলাট আইন পাস করলে এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে প্রতিবাদ আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পাঞ্জাবে রাওলাট-বিরােধী আন্দোলনের সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল ১৩ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে একটি শান্তিপূর্ণ জমায়েতে ইংরেজ পুলিশের নির্বিচার গুলিচালনা এবং এর ফলে অন্তত ১০০০ মানুষের মৃত্যু। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি নীচে উল্লেখ করা হল一
[1] পাঞ্জাবে নির্যাতন: জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ, গদর বিদ্রোহ প্রতিরােধ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে সরকার পাঞ্জাবে তীব্র দমনপীড়ন চালালে পাঞ্জাব ক্ষুধ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের কর্মচ্যুত সেনাদের সমাবেশে এই ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ারের অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে।
[2] রাওলাট আইন: ভারতীয়দের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ এবং আন্দোলন কঠোর হাতে দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী রাওলাট আইন প্রবর্তন করে। এই নিষ্ঠুর দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে। এই আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাব বারুদের স্তূপে পরিণত হয়।
[3] নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার: ‘পিপল্ কমিটি’ নামে একটি গণসংগঠন লাহাের ও অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলে। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে মদত দেওয়ার অভিযােগে। সরকার অমৃতসরের দুই নেতা ড. সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে (১০ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রি.) গ্রেপ্তার করে। ফলে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এদিকে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহােরে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। উত্তেজিত জনতা সরকারি অফিস-আদালত, টেলিগ্রাফ লাইন ও অন্যান্য সরকারি সম্পত্তিতে আক্রমণ চালায়।
[4] অমৃতসরে সামরিক শাসন: রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। এই বাহিনী অমৃতসরে সামরিক আইন জারি করে ১১ এপ্রিল শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
Leave a comment