মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশে মাহার নামে এক অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর হরিজন হিন্দু সম্প্রদায় বসবাস করত। তাদের অধিকাংশই ঝাড়দার, জুতাে তৈরি প্রভৃতি নিম্নস্তরের পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেউ কেউ চাষের কাজ করত। এই অনগ্রসর শ্রেণি বৰ্ণহিন্দুদের দ্বারা নানা সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল, যেমন—
-
তারা সমাজে পশুর চেয়েও অধম জীব বলে গণ্য হত।
-
তারা সর্বসাধারণের ব্যবহার করা জলাশয় বা কুয়াে থেকে পানীয় জল নিতে পারত না।
-
হিন্দু মন্দিরে প্রবেশেও তাদের অধিকার ছিল না।
-
তাদের জন্য ধােপা-নাপিতও বন্ধ ছিল।
-
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলিত হিন্দুদের সন্তানরা বর্ণহিন্দুদের আধিপত্যকারী বিদ্যালয়ে ভরতি হওয়ার সুযােগ পেত না।
-
যেসব বিদ্যালয়ে হরিজন শিক্ষার্থীরা ভরতির সুযােগ পেত, সেখানে তারা বর্ণহিন্দু শিক্ষার্থীদের পাশে বসতে পারত না।
-
তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোনাে সুযােগ পেত না।
[1] মাহাদ মার্চ: অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে জনসাধারণের জলাশয় থেকে জল নেওয়ার অধিকার দেওয়া হত না। এর প্রতিবাদে মাহার সম্প্রদায়ভুক্ত ড. ভীমরাও আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬ খ্রি.) ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইয়ের কোলাবায় চৌদার জলাশয়ে মাহাদ মার্চ (Mahad March)-এ নেতৃত্ব দেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণবৈষম্যের ভিত্তি মনুস্মৃতি গ্রন্থটির কয়েকটি কপি আম্বেদকরের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে আগুনে পােড়ানাে হয়। এভাবে বর্ণহিন্দুদের প্রাধান্য ও বর্ণভেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয়।
[2] মন্দিরে প্রবেশের আন্দোলন: হরিজন ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পেত না। এর প্রতিবাদে আম্বেদকর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করেন। আম্বেদকর বলেন, “ইউরােপীয় ক্লাবগুলিতে একদা লেখা থাকত যে, ভারতীয় ও কুকুর প্রবেশ নিষেধ। এখন হিন্দু মন্দিরে অস্পৃশ্যদের প্রবেশ নিষেধ করে কি একই ধরনের অবজ্ঞা করা হচ্ছে না?” তার ডাকে নিম্নবর্ণের মাহার সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়। তারা মন্দিরের জলাশয় থেকে জলপান করলে মন্দিরের পুরােহিত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জোরদার আন্দোলন আরম্ভ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ড. ভীমরাও আম্বেদকর।
[3] কলারাম মন্দিরে আন্দোলন: মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ড. আম্বেদকরের নেতৃত্বে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নাসিকের কলারাম মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। নিম্নবর্ণের অন্তত ১৫ হাজার হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক এই মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহে পুজো দেওয়ার দাবি জানায়।
[4] সত্যাগ্রহ আন্দোলন: ড. আম্বেদকর হিন্দু মন্দিরে দলিত হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে নাসিকে এক সম্মেলনে (২ মার্চ, ১৯৩০ খ্রি.) সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করার কথা ঘােষণা করেন। মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবিতে তাঁর নেতৃত্বে নাসিকে আন্দোলনকারীদের দীর্ঘ এক মাইল লম্বা মিছিল হয়, যা সেই সময়ের নিরিখে নাসিকের সবচেয়ে দীর্ঘ মিছিল ছিল। মিছিল এগিয়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখে যে মন্দিরের সমস্ত ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা প্রধান ফটকের সামনে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন।
[5] আক্রমণ: আম্বেদকরের নেতৃত্বে কলারাম মন্দিরের সামনে প্রায় ১ মাস ধরে দলিত হিন্দুদের সত্যাগ্রহ চলে। ৯ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা। মন্দিরের রথ স্পর্শ করলে উগ্র বর্ণহিন্দুরা সত্যাগ্রহীদের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক সংখ্যায় ইট ও পাথর ছােড়া হয়। ফলে সারা শহরে দলিত ও বর্ণহিন্দুদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। গােলমালের ফলে মন্দিরটি অন্তত এক বছর বন্ধ থাকে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই উত্তেজনা চলে।
[6] আইন প্রণয়ন: মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সহানুভূতি লাভ করে। নাসিকে আন্দোলন চলার সময়ই বােম্বাই-এর প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার ‘মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত বিল’ (Temple Entry Bill, 1933) পাস করে। ফলে দলিত ও অস্পৃশ্যরা হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের আংশিক অধিকার পায়। কিছুদিন পর মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য আইনসভায়ও এবিষয়ে আইন পাস করে।
Leave a comment