সূচনা: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে ব্রিটেনের শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে ভারতে শিল্পায়নের সুযোেগ আসে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে।
[1] সুতিবস্ত্র: ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত বস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্রশিল্পে মূলধন বিনিয়ােগের পরিমাণ অন্তত ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বােম্বাইয়ে ৮৫টি এবং আমেদাবাদে ৪৯টি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মােট ৩৩৫টি সুতােকলের মধ্যে ৩২২টিই ছিল ভারতীয় মালিকানাধীন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্রশিল্পে অন্তত ৪৬ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
[2] লৌহ-ইস্পাত:
-
[i] জামশেদপুরের টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (TISCO)-তে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়। এই কোম্পানিতে ইস্পাতের উৎপাদন ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩১ হাজার টন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এই কারখানার সম্প্রসারণ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে এই সংস্থার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৮ লক্ষ টন।
-
[ii] আসানসােলের বার্ণপুরের কাছে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (IISCO) প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উৎপাদন শুরু হয়।
-
[iii] এ ছাড়া এই সময় মহীশূর আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস (১৯২৩ খ্রি.) এবং ‘দ্য স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল’ (১৯৩৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।
[3] পটি:
-
[i] ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাটকলের সংখ্যা ছিল ৬৪। এগুলিতে প্রায় ২ লক্ষ ১৬ হাজার কর্মী কাজ করত। ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে পাটকলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩টি।
-
[ii] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রয়ােজনে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ২ কোটি ৫ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের পাট এদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়।
[4] বাগিচা শিল্প
-
চা শিল্প: আসাম, বাংলা, কাছাড়, তরাই অঞ্চল, ডুয়ার্স, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের কাংড়া, দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি ও অন্যান্য অঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চা বাগিচার মােট আয়তন ছিল ৭ লক্ষ ৭ হাজার ৭৩৩ একর।
-
কফি: দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক, কেরালা ও তামিলনাডুতে যথেষ্ট কফি উৎপাদিত হত। ১৯১০-১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রায় ২ লক্ষ ৩ হাজার একর জমিতে কফি চাষ হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।
-
আখ: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের ৩০টি চিনিকলে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টন চিনি উৎপন্ন হত। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চিনি শিল্প সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ায় তা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে চিনিকলের সংখ্যা ছিল ১৬১টি।
[5] কয়লা: ভারতে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে রানিগঞ্জে সর্বপ্রথম কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। বাংলা, বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন কয়লা খনি নিয়ে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন’ গড়ে ওঠে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মােট উৎপাদিত কয়লার প্রায় ৫৪.০৫ শতাংশ পূর্ব ভারতের কয়লা খনিগুলি থেকেই উৎপাদিত হত।
[6] কাগজ শিল্প: বিংশ শতকের প্রথমদিকে কাগজ শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় এবং নতুন নতুন কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভদ্রাবতীর মহীশূর পেপার মিল (১৯৩৭খ্রি.) এবং হায়দ্রাবাদের ‘শিরপুর পেপার মিল (১৯৩৮ খ্রি.)। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ভারতে ১৬টি কাগজের কল ছিল। তাদের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২০ লক্ষ হন্দর।
[7] জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহণ: লােহা ও ইস্পাত এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের প্রসার ঘটলে তার ওপর ভিত্তি করে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতি ঘটে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মালিকানায় ‘সিন্ধিয়া নেভিগেশন কোম্পানি’ গড়ে ওঠে। বিশিষ্ট গুজরাটি শিল্পপতি ওয়ালচাঁদ হীরাচঁাদ জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহণে প্রচুর মূলধন বিনিয়ােগ করেন।
[8] সিমেন্ট শিল্প: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে সিমেন্টের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনও বাড়ে। ভারতে সিমেন্টের উৎপাদন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ছিল লক্ষ ৬৪ হাজার টন। এই উৎপাদন বেড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দাঁড়ায় ১২ লক্ষ টন। ১০টি সিমেন্ট কোম্পানি একত্রিত হয়ে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাসােসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানি (ACC) গড়ে তােলে। ফলে এই শিল্পের পরিচালনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: আলােচ্য সময়কালে ভারতে চর্বি, পশম, মদ, দেশলাই, রাসায়নিক, অ্যালুমিনিয়াম ও বিভিন্ন যন্ত্রশিল্প প্রভৃতিরও অগ্রগতি ঘটে।
Leave a comment