সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শােষণের ফলে অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দে) এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করে। প্রায় এক বছর ধরে সারা বাংলায় দাপিয়ে বেড়িয়ে এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। অনাহারে ও অপুষ্টিতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল বলে এই মন্বন্তর ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত।

[1] খাদ্য উৎপাদন হ্রাস: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলস্রোতে বাংলার আমন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ধানের উৎপাদন ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যায়। মানুষের হাতে সঞ্চিত খাদ্য ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শেষ হয়ে গেলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে খাদ্য সংকট চরমে ওঠে।

[2] বাণিজ্য গণ্ডি: ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য গণ্ডি প্রথা চালু করায় ব্যবসায়ীরা অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারেনি। বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারগুলিও তাদের ক্ষমতা প্রয়ােগ করে নিজ প্রদেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করে।

[3] খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় গ্রামীণ রাস্তাগুলি ভেঙ্গে যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় বাংলার দূরদূরান্তের গ্রামগুলিতে খাদ্য, ত্রাণ ও চিকিৎসার সুযোেগ পৌঁছে দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।

[4] বার্মা থেকে চাল আমদানি ব্যাহত: জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের হাত থেকে বার্মা দখল করে নিলে বার্মা থেকে বাংলায় পূর্বপ্রচলিত চাল আমদানি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র জাপানের সহযােগিতায় বার্মা থেকে বাংলায় চাল পাঠানাের প্রস্তাব দিলেও সরকার এতে সাড়া দেয়নি।

[5] জাপানের আক্রমণের আশঙ্কা: জাপান কর্তৃক বার্মা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল যে, জাপান হয়তাে বাংলা হয়ে ব্রিটিশ ভারতে অভিযান চালাতে পারে। এজন্য পােড়ামাটির নীতি অনুসারে বার্মার নিকটবর্তী চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় সরকার সেখানকার মানুষের মাছ ধরার সামগ্রী, নৌকা, মােটর যান, গােরুর গাড়ি প্রভৃতি বাজেয়াপ্ত করে সেখানকার যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। জাপানিরা সাগরপথে বাংলার উপকূলে এসে নামতে পারে- এই আশঙ্কায় সরকার কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে উপকূল অঞ্চলের সব নৌকা ধ্বংস করে। ফলে বাংলার সীমান্তে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

[6] চার্চিলের ভূমিকা: বাংলার মন্বন্তরের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যথেষ্ট দায়ী ছিলেন। বাংলার চরম খাদ্যাভাবের সময় অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা কানাডা জাহাজে করে বাংলায় খাদ্যশস্য পাঠাতে চাইলেও চার্চিল যুদ্ধের কাজে জাহাজ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে খাদ্য পরিবহণে কোনাে জাহাজ ছাড়তে রাজি হননি। তিনি জাহাজে করে বাংলায় খাদ্য পাঠানাের পরিবর্তে গ্রিসের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন।

[7] সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি: বাংলায় খাদ্যাভাব সত্ত্বেও সরকার যুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য বাইরে রপ্তানি করে। প্রয়ােজনের তুলনায় অতিরিক্ত শস্য সরবরাহ করে সেনাদের চাহিদা নিশ্চিত করতে গিয়ে সেখানে বহু খাদ্যের অপচয় হত। ফলে খাদ্য সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।

[8] মজুতদারি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলায় জাপানি আক্রমণের আশঙ্কার পরিস্থিতিতে সরকার সেনাবাহিনীর জন্য বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণ চাল মজুত করে। কলকাতার বােটানিক্যাল গার্ডেনে মজুত করা ৯০ হাজার টন চাল দুর্ভিক্ষের পরে পচে যাওয়ায় তা জলে ফেলে দিতে হয়েছিল। খাদ্য সংকটের আঁচ করে ব্যবসায়ীরাও প্রচুর চাল কিনে গুদামে মজুত করে এবং দুর্ভিক্ষের সময় বহুগুণ বেশি দামে তা বিক্রি করে। বাংলার দরিদ্র মানুষ আকাশছোঁয়া দামে এই খাদ্য কিনতে ব্যর্থ হয়।

[9] সরকারের অবহেলা: বাংলার নেতা ফজলুল হক খাদ্য সংকটের বিষয়ে সরকারকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে হুঁশিয়ারি দিলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্য সংকট শুরু হলে বাংলার প্রাদেশিক সরকার এর মােকাবিলায় মােটেই তৎপরতা দেখায়নি। যখন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় সরকার তখন অতি ধীর গতিতে ত্রাণকার্য শুরু করে।

[10] ড. অমর্ত্য সেনের অভিমত: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন মনে করেন যে, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে যখন দুর্ভিক্ষ ছিল না তখনকার তুলনায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যের জোগান বেশি ছিল। কিন্তু এই সময়কার মুদ্রাস্ফীতির ফলে একশ্রেণির মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। তারা বেশি করে খাদ্য ক্রয় করলে বাজারে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়। অবশ্য ড. সেনের ব্যাখ্যার সঙ্গে অনেকেই একমত নন।

উপসংহার: পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ফলে গ্রামবাংলা একেবারে শ্মশানে পরিণত হয়।