সূচনা: স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে গঠিত হয় ভারতের গণপরিষদ বা সংবিধান সভা।

[1] গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা অনুসারে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ভারতীয় গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা হয়। এই চারটি মূলনীতি হল—

  • [i] ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্য নির্বাচিত হয়ে গণপরিষদে আসবেন।

  • [ii] গণপরিষদের সব আসন সাধারণ (General), মুসলমান, শিখ এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে।

  • [iii] প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। 

  • [iv] দেশীয় রাজ্যগুলি ৯৩ জন প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। এদের ৫০ শতাংশ নির্বাচিত ও ৫০ শতাংশ মনােনীত সদস্য হবেন।

[2] উদ্দেশ্য: স্বাধীনতালাভের মধ্যে দিয়ে জাতীয় বিপ্লবের কাজ সম্পূর্ণ হলেও সামাজিক বিপ্লবসাধনের কাজ বাকি রয়ে যায়। গণপরিষদ গঠনের মধ্যে দিয়ে ভারতে দুঃখদারিদ্র্যের অবসান ঘটানাে, যাবতীয় বৈষম্য লােপ ও শােষণের অবসান ঘটাতে চাওয়া হয়।

[3] সদস্যদের নির্বাচন: গণপরিষদের মােট আসন সংখ্যা ছিল ৩৮৯ জন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা পরােক্ষভাবে গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে গণপরিষদের ২৯৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দলগত বিচারে কংগ্রেস ৭০ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয়। গণপরিষদে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসেন। তারা হলেন বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, বি. আর. আম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারী, কৃষ্মস্বামী আয়ার প্রমুখ।

[4] গণপরিষদের কার্যাবলি

  • সভাপতি নির্বাচন: গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের প্রথম স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন।

  • বিভিন্ন কমিটি গঠন: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সেখানে কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন হয়, যেমন-কার্যনির্বাহক কমিটি, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কিত কমিটি, মৌলিক অধিকার বিষয়ক কমিটি ইত্যাদি।

  • খসড়া সংবিধান প্রণয়ন: গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে) মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল নিয়ােগ করা হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রথম অধ্যক্ষ (Speaker) হিসেবে জি. ভি. মাভলঙ্কর নির্বাচিত হন। গণপরিষদই প্রথম আইনসভা হিসেবে কাজ শুরু করে। পঞ্চম অধিবেশনে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. বি. আর. আম্বেদকর খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মােট ১৬৫ দিন ধরে ১১টি অধিবেশনে খসড়া সংবিধান রচনার কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। বিভিন্ন সংশােধনী প্রস্তাব আলােচনার পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়।

  • নতুন সংবিধান গ্রহণ: গণপরিষদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি। এই অধিবেশনে নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ।

[5] গণপরিষদের প্রকৃতি

  • জনপ্রতিনিধিত্বহীন: ভারতীয় গণপরিষদকে কোনােভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বলা চলে না। কেননা সদস্যগণ ভারতীয়দের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদের সদস্যগণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত হননি। তাই প্রকৃতিগত বিচারে গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন এক পরিষদ।

  • আইনবিদদের প্রাধান্য: গণপরিষদ ছিল আইনবিদদের প্রাধান্যবিশিষ্ট এক পরিষদ। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মূলত যে ২১জন সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার মধ্যে ১১ জনই ছিলেন বিশিষ্ট আইনবিদ। এই আইনবিদগণ সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন ধারা উপধারাগুলির বিচারবিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আইভর জেনিংস তাই গণপরিষদকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

  • একদলীয়: সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না থাকায় ভারতীয় গণপরিষদ সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। দেশবিভাগের ফলে লিগের সদস্যরা পাকিস্তানে চলে গেলে ভারতীয় গণপরিষদ সম্পূর্ণরূপে একটি একদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়। সােমনাথ লাহিড়ি কমিউনিস্ট দলের তরফে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও দেশবিভাগজনিত কারণে তাকে সদস্যপদ খােয়াতে হয়।