[1] পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রজোট ও সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী রাষ্ট্রজোটের দ্বন্দ্বের ফলে বিশ্বে এক উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। এমতাবস্থায়, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ এই রাজনৈতিক দ্বিমেরুকরণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায় এবং এই দুই পরস্পরবিরােধী রাষ্ট্রগােষ্ঠীর কোনােটিতেই যােগনা দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে চায়। জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযােগ্য কিছু দেশ হল ভারত, মিশর, যুগােশ্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি। এই আন্দোলনের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন ভারতের জওহরলাল নেহরু, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, যুগােশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো,ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ঘানার নকুমা প্রমুখ। এই নীতি অনুসরণের ফলে ভারত এই দুই রাষ্ট্রের জোট এবং সেগুলির তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

[2] বান্দুং সম্মেলন: ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এশিয়ার ১৪টি দেশ নিজেদের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ়করণে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে মিলিত হন যা বান্দুং সম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনের মূল উদ্যোগকারী দেশগুলি ছিল ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, পাকিস্তান, সিংহল ও ভারত এবং এই সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান জওহরলাল নেহরু। বান্দুং সম্মেলনে জওহরলাল নেহরু ঘােষিত দশশীল নীতি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল বলে মনে করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে জোটনিরপেক্ষ নীতির শর্তাবলি আলােচনা করার জন্য বেলগ্রেড-এ প্রথম জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আয়ােজিত হয়। ৫ থেকে ১২ জুন মিশরের রাজধানী কায়রােতে একটি Preparatory Conference অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ২২টি দেশের বিদেশমন্ত্রী এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলির জন্য নির্ধারিত নিয়মাবলি ও যােগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত করা হয়। এগুলি হল —

  • [ii] জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আদর্শকে সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন দেশের উপনিবেশবিরােধী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানাতে হবে।

  • [iii] পরস্পরবিরােধী রাষ্ট্রজোটগুলির অন্তর্বর্তী সংঘাত বা প্রভাবকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঠান্ডা যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এমন কোনাে পারস্পরিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যাবে না।

  • [iv] রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানগত ভিন্নতা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে পারস্পরিক সহাবস্থান নীতি মেনে চলতে হবে।

  • [v] কোনাে সদস্য দেশ আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কোনাে বৃহৎ শক্তিশালী দেশের সাথে যদি সামরিক সমঝােতা করে, তবে সেটিকে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

  • [vi] জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণকারী কোনাে দেশ তার ভূখণ্ডকে বিদেশি শক্তির সামরিক স্বার্থে প্রদান করলেও সেই ভূখণ্ডকে ঠান্ডা যুদ্ধের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না।

[1] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়

  • কোরিয়া সমস্যা: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে ভারত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে কোনাে পক্ষই ভারতকে আমল না দিলেও পরে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগকে উভয় শক্তিই স্বাগত জানায়। যুদ্ধবিরতির পর বন্দি বিনিময় নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে ভারতের মধ্যস্থতায় জেনারেল থিমাইয়ার নেতৃত্বে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়।

  • ভিয়েতনাম সমস্যা: ইন্দোচিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও পরে ভিয়েতনাম সমস্যা সমাধানেও ভারতের ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযােগ্য। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রামকে ভারত খােলা মনে সমর্থন করে। এ ব্যাপারে সম্মেলনের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য তিনটি কমিশন নিযুক্ত হয়। সেগুলির সভাপতি নিযুক্ত হন জে.এম. দেশাই, জে.এন. খালা এবং জে.পার্থসারথী।

  • চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য মনােনয়ন: ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে সাম্যবাদী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলে মার্কিনজোট প্রজাতন্ত্রী চিনকে জাতিপুঞ্জে স্বীকৃতি দেয়নি। বিবাদ থাকা সত্ত্বেও চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য করার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে ভারত জোরালাে বক্তব্য রাখে। অবশেষে কমিউনিস্ট চিনকে জাতিপুঞ্জ বা রাষ্ট্রসংঘের সদস্যরূপে গ্রহণ করা হয়।

[2] পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায়

  • মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপন: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তি ভারত অগ্রাহ্য করে।

  • পশ্চিম এশিয়ার মুক্তি আন্দোলন: পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।

  • সুয়েজ সংকটের সমাধান: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ সংকট এবং মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি ও ইজরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানায়। নেহরু মিশরকে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনা পাঠানাের হুমকি দেন। জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে আক্রমণকারীরা মিশর ত্যাগ করে।

  • কঙ্গোতে শান্তি স্থাপন: কঙ্গােকে ঐক্যবদ্ধ রেখে সেখানে শান্তি স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রসংঘ বাহিনীকে সাহায্য করতে ভারত সেনাদল পাঠায়।

[3] তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বদানে: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত ও চিনের মধ্যে পঞ্চশীল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিস্থাপনে বিশ্ব এক নতুন পথনির্দেশ পায়। পরের বছরই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া-আফ্রিকার ২৯টি রাষ্ট্রের এক সম্মেলনে ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বে নির্জোট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। পরে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগােশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ভারত ছিল মধ্যমণি। এইভাবে ভারত ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে নির্জোট তৃতীয় বিশ্ব গঠনের পথে এগিয়ে যায়।

[4] হাঙ্গেরি সমস্যায়: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ হাঙ্গেরিতে সােভিয়েত আক্রমণ এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কয়েকজন হাঙ্গেরীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় ভারত প্রতিবাদ জানায়।

[1] ভারত-চিন বিরােধে; ভারতের নির্জোট নীতি কিন্তু চিন ও ভারতের মধ্যে বিরােধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতীয় ধর্মগুরু দলাই লামাকে ভারতে আশ্রয়দান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে ভারত-চিন বিরােধ সৃষ্টি হয়।

[2] পাক-ভারত বিরােধে: কাশ্মীর প্রশ্ন, পাক-ভারত আন্তর্জাতিক সীমানা-বিরােধ ইত্যাদি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে তিক্ত করে তােলে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নেহরু নুন চুক্তি (Nehru-Noon Treaty) দ্বারা ভারত বেরুবাড়ি অঞ্চলের একটা অংশ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলেও সীমানা বিরােধ থামেনি। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান কচ্ছ সীমান্তের কিছু অঞ্চল অধিকার করলে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধে।