সূচনা: ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোট ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় যা প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ (First Gulf War) বা প্রথম খাঁড়ি যুদ্ধ নামে পরিচিত।
[1] প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ইরাক তার প্রতিবেশী কুয়েত আক্রমণ ও দখল করলে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়।
-
আর্থিক সমৃদ্ধির চেষ্টা: প্রতিবেশী কুয়েতের তৈল সম্পদ দখল করে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন নিজ দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি আনতে চেয়েছিলেন।
-
কুয়েতের তৈলভাণ্ডার: সমগ্র বিশ্বের তেল ভাণ্ডারের ৯.৪ শতাংশ কুয়েতে রয়েছে। এজন্য সাদ্দাম হুসেন কুয়েত দখল করে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির লােভ দমন করার উদ্যোগ নেন।
-
ইরাকের অংশ: কুয়েত অতীতে ইরাকেরই অংশ ছিল। এজন্য সাদ্দাম হুসেন দাবি করেন যে, হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে হলেও তিনি কুয়েত পুনরুদ্ধার করবেন।
-
কুয়েতে আমেরিকার আধিপত্য: সাদ্দাম কুয়েতের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেন যে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় কুয়েত তার তেলের খনিগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরিকার হাতে ছেড়ে দিয়ে মার্কিন আধিপত্যের সুযােগ করে দিয়েছে। কুয়েতের এই কাজের ফলে ওপেক (OPEC) নামে তেল সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলির যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল।
-
ক্ষতিপূরণ দাবি: সাদ্দাম হুসেন কুয়েতের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছিলেন যে, কুয়েত ইরাকের রুইমালা খনি থেকে চুরি করে তেল উত্তোলন করার ফলে ইরাকের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য তিনি কুয়েতের কাছে ১৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কুয়েত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করলে সাদ্দাম হুসেন কুয়েত আক্রমণ করেন।
[2] প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের গতি
-
কুয়েত দখল: ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট কুয়েতে প্রায় দুই লক্ষ সেনা পাঠালে দুর্বল কুয়েত তার কোনাে প্রতিরােধই করতে পারেনি। সাদ্দাম কুয়েত দখল করে কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা করেন।
-
আমেরিকার নেতৃত্ব: আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলি আতঙ্কিত হয়েছিল যে, তৈল সমৃদ্ধ আরব দুনিয়া এভাবে সাদ্দাম হুসেনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তাদের প্রভূত ক্ষতি হবে। এজন্য আমেরিকা সক্রিয়ভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার কাজে নেতৃত্ব দেয়।
-
জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ইরাকের সঙ্গে সব দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব দেয়। জাতিপুঞ্জ ইরাককে একটি চরমপত্র দিয়ে জানায় যে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে কুয়েত থেকে ইরাক সরে না এলে ইরাকের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
-
আমেরিকার অভিযান: জাতিপুঞ্জের সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ১৫ জানুয়ারি (১৯৯১ খ্রি.) ইরাক আক্রমণ করে। সাত মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে নির্বিচারে প্রচুর বােমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। শীঘ্রই কুয়েত থেকে ইরাকের বাহিনী সরে আসতে বাধ্য হয় এবং যুদ্ধে ইরাক শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
[3] প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলাফল
-
সাদ্দাস-বিরােধী বিদ্রোহ: যুদ্ধ চলাকালে সাদ্দামের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে তীব্র গণ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাদ্দাম নির্মমভাবে বহু মানুষকে হত্যা করেন।
-
ইরাকের ক্ষয়ক্ষতি: বহুজাতিক বাহিনীর আক্রমণে ইরাকের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বাগদাদ-সহ ইরাকের বিভিন্ন স্থানের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং বহু রাস্তাঘাট, সৌধ প্রভৃতি ধ্বংস হয়েছিল।
-
মার্কিন নিয়ন্ত্রণ: আমেরিকার লক্ষ্য ছিল কুয়েতের মুক্তি ঘটিয়ে এবং ইরাকের ক্ষমতা থেকে সাদ্দাম হুসেনকে সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তৈল সম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। বলা বাহুল্য, এ কাজে আমেরিকা অনেকটাই সফল হয়েছিল।
-
[a] ইরাকের মজুত করা পরমাণু এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র নষ্ট করতে হবে,
-
[b] পরমাণু অস্ত্র গবেষণা বন্ধ রাখতে হবে,
-
[c] কুর্দ জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল উড়ানমুক্ত অঞ্চল বলে ইরাক মেনে নেবে।
[1] দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
-
কুর্দ অঞ্চলে ইরাকি সেনা: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে কুদ অঞ্চলের উড়ানমুক্ত অঞ্চলে ইরাকি সেনা পাঠান।
-
পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার: আমেরিকা দাবি করে যে, সাদ্দাম ইরাকে প্রচুর মারাত্মক পারমাণবিক ও রাসায়নিক মারণাস্ত্র মজুত করেছে।
-
আল-কায়দার সঙ্গে সাদ্দামের যোগ: আমেরিকা অভিযােগ করে যে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেন এবং তার সংগঠন ‘আল-কায়দা’-র সঙ্গে সাদ্দাম হুসেনের যােগ আছে। আমেরিকা বেশির ভাগ অভিযােগই প্রমাণ করতে না পারলেও একপ্রকার গায়ের জোরে ইরাককে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকার প্রতিটি সিদ্ধান্তে ইংল্যান্ড সম্মতি জানায়।
[2] দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত: এইসব অভিযােগে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ (জুনিয়র) উপসাগরীয় অঞ্চলে সেনা সমাবেশ করেন (২০০৩ খ্রি.)।। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের তৈলসম্পদের ওপর আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন। লৌহ-দৃঢ় সাদ্দাম হুসেনকে ধ্বংস করতে আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে অবরােধ ঘােষণা করে এবং ২০ মার্চ ইরাকের ওপর আক্রমণ শুরু করে। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ (Second Gulf War) বা দ্বিতীয় খাঁড়ি যুদ্ধ নামে পরিচিত।
[3] দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলাফল
-
ইরাকের ক্ষয়ক্ষতি: ইরাকের ওপর মার্কিন আক্রমণে ইরাকের অগণিত মানুষের মৃত্যু হয় এবং বহু অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষতি হয়।
-
সাদ্দামের পলায়ন: যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন পালিয়ে এক ভূগর্ভস্থ গৃহে আশ্রয় নেন। কিন্তু মার্কিন সামরিক শক্তি এই গােপন আশ্রয়স্থল থেকেও সাদ্দাম হুসেনকে খুঁজে বের করে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচার শুরু করে।
-
সাদ্দামের ফাঁসি: বিচারে সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর অভিযােগ আনা হয় এবং তার ফাঁসির সাজা ঘােষণা করা হয়। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে (৩০ ডিসেম্বর) তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
Leave a comment