সমাজজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রাজনীতি। মানুষ যেদিন থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, সেদিন থেকে তার জীবনধারার অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে রাজনীতি।
[1] রাজনীতি শব্দের উৎপত্তি: ‘রাজনীতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পলিটিক্স। শব্দটি তিনটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। এগুলি হল ‘পােলিস’ (Polis বা City State), পলিটি’ (Polity বা Government) এবং পলিসিয়া (Politeia বা Constitution)। প্রাচীন গ্রিসে রাজনীতি বলতে নগররাষ্ট্র ও তার শাসনব্যবস্থার বস্তুগত ও দর্শনগত দিকগুলির অধ্যয়নকে বােঝাত।
[2] রাজনীতির সংকীর্ণ অর্থ: সাধারণভাবে রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখলের লড়াই ও কৌশলকে বােঝায়। একে রাজনীতির সংকীর্ণ অর্থ বলা হয়। কেউ কেউ আবার ন্যায়নীতিবর্জিত উপায়ে ব্যক্তিগত সুযােগসুবিধা লাভ’কে রাজনীতি বলে অভিহিত করেন।
[3] রাজনীতির ব্যাপক অর্থ: আধুনিক যুগে ‘রাজনীতি’ বলতে শুধু ক্ষমতা দখলের লড়াই, দলীয় নেতানেত্রীদের কৌশল বা দলীয় রাজনীতিকে বােঝায় না। আজকের দিনে মানবসমাজ ও মানবজীবনের কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতি। রাষ্ট্রীয় কাঠামাে ছাড়াও রােজকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেমন পরিবার, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, খেলার মাঠ, ক্লাব, সংঘ বা প্রতিষ্ঠান-সব ক্ষেত্রেই রাজনীতির অস্তিত্ব বিদ্যমান।
[4] রাজনীতির সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি: অ্যারিস্টট্ল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে ‘রাজনীতি’-কেই বুঝিয়েছিলেন। তাঁর মতে, রাজনীতি হল নগররাষ্ট্র পরিচালনা এবং নাগরিক সম্পর্কিত জ্ঞান বা শৃঙ্খলা-বিশেষ। এভাবে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনীতির রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধ্যানধারণার উদ্ভব ঘটে। বস্তুত রাজনীতির সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাষ্ট্রকাঠামাের মধ্যেই এর অস্তিত্ব সন্তব। কাজেই সরকার, আইনসভা, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, স্বার্থগােষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচনি কাজকর্ম ইত্যাদির মধ্যেই রাজনীতির অস্তিত্ব রয়েছে। সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গিতে এও মনে করা হয় যে, রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই যখন রাষ্ট্রের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না তখন রাজনীতিও ছিল না।
[5] রাজনীতির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি: আধুনিক কালে রাজনীতি সম্পর্কিত ধারণা অতীতের ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রে গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহৎ জাতীয় রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সমাজের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিক থেকে রাজনীতিকে বিচার করা হয়। রাজনীতি এখন আর শুধু রাজ্য বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কাজকর্মের মধ্যে সীমিত নেই। এখন রাজনীতি সমাজের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সংযুক্ত একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
[6] রবার্ট ডাল, ম্যাকেঞ্জি ও অ্যালান বলের অভিমত: অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির মতে, রাজনীতি শুধু রাজ্য বা রাষ্ট্রকাঠামােকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না, সমাজে সর্বত্র তা পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক রবার্ট ডালের বক্তব্য অনুসারে, রাজনীতি হল মানব-অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য দিক। প্রত্যেক ব্যক্তি কোনাে না কোনাে সময়ে কোনাে না কোনােভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন, প্রত্যেকের জীবনেই রাজনীতির প্রভাব বিদ্যমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বলের মতে, রাজনীতি হল এক ধরনের কার্যকলাপ, কোনাে নৈতিক নির্দেশ নয়।
[7] লাসওয়েল ও ডেভিড ইস্টনের অভিমত: আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে প্রভাব, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাসওয়েল সমাজে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পর্যালােচনাকে রাজনীতি বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হল রাজনীতির মূল আলােচ্য বিষয়। ডেভিড ইস্টন রাজনীতি বলতে ‘মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বণ্টন’-কে বুঝিয়েছেন।
[8] মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে রাজনীতি: মার্কসবাদীদের মতে, প্রতিটি যুগের রাজনীতি হল সেযুগের শাসকশ্রেণির আধিপত্যের ধারণা মাত্র। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাজনীতির কোনাে আলাদা সত্তা নেই। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা উৎপাদন ব্যবস্থা হল সমাজের মূল কাঠামাে। এই মূল কাঠামাের ওপর ভিত্তি করে যে উপরি কাঠামাে দাঁড়িয়ে আছে, রাজনীতি তার অংশ-বিশেষ।
[9] নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: রাজনীতি সম্পর্কে নারীবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে আলাদা। নারীবাদীরা ‘রাজনীতি বলতে সাবেকি পুরুষপ্রাধান্যের রাজনীতিকে বুঝিয়েছেন। তারা এই ধরনের রাজনীতিকে মেনে নিতে চান না।রাজনীতিতে পুরুষপ্রাধান্য উৎখাত করে নারীর যােগ্য মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করাই হল নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল উদ্দেশ্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, রাজনীতির অর্থ ও প্রকৃতি বহুমাত্রিক। কোনাে একটি দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আধুনিক যুগের রাজনীতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। যে-কোনাে মানুষের সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের সবই রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত।
Leave a comment