ক্ষমতা বস্টনের নীতির ভিত্তিতে সরকার বা শাসনব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাকে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। অন্যদিকে, যে শাসনব্যবস্থায় সংবিধান কর্তৃক বণ্টিত ক্ষমতার মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ই নিজ নিজ প্রশাসনিক এলাকায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম, তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বলা হয়। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্যগুলি হল一

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা

  • এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার শীর্ষে থাকে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সরকারের অস্তিত্ব থাকলেও, তাদের তেমন কোনাে স্বাতন্ত্র্য থাকে না।

  • এককেন্দ্রিক সরকারে জাতীয় বা আঞ্চলিক—সব ক্ষমতাই কেন্দ্রীভূত থাকে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।

  • এককেন্দ্রিক সরকারে সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকার করা হয় না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার যথেষ্ট সুযােগ থাকে।

  • এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায়। বিচার বিভাগ অত্যন্ত দুর্বল হয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও রক্ষাকর্তা হিসেবে আদালতের কোনাে গুরুত্বই থাকে না।

  • এককেন্দ্রিক প্রশাসনে কোনাে দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা থাকে না, একনাগরিকত্বের নীতি অনুসৃত হয়। জনগণের আনুগত্য শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি থাকে।

  • এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে যেসব আঞ্চলিক সরকার থাকে, তাদের কোনাে স্বতন্ত্র সংবিধান থাকে না। আঞ্চলিক সরকারগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।

  • এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত বা অলিখিত যাই হােক না কেন, তা কিন্তু , সুপরিবর্তনীয়। এই ধরনের সংবিধানকে সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে খুব সহজেই পরিবর্তন করা যায়।

  • এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় একটিমাত্র আইনসভা ও প্রশাসনিক কাঠামাে থেকে সমগ্র দেশের জন্য একই আইন প্রণয়ন করা হয়।

  • এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র দেশের জন্য একটি জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকায়, এখানে জাতীয় ঐক্যের মনােভাবের প্রতিফলন ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য দুধরনের সরকার থাকে। উভয় সরকারই নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, মুদ্রাব্যবস্থার মতাে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে এবং আঞ্চলিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি, যেমন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি রাজ্য সরকারের হাতে থাকে।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত হয়ে থাকে এবং সংবিধানের প্রাধান্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংবিধান বিরােধী কোনাে আইন, আদেশ বা নির্দেশ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি প্রণয়ন করতে পারে না। এখানে সব ক্ষমতার উৎস হল সংবিধান।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের অস্তিত্ব। সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও অভিভাবক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবিধান- বিরােধী আদেশ, নির্দেশ বা আইন যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বাতিল করতে পারে।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেখা যায়, এখানে জনগণের আনুগত্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিভক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মার্কিন নাগরিকরা একই সঙ্গে কেন্দ্রের ও অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্ব পেয়ে থাকেন।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য স্বতন্ত্র সংবিধানের অস্তিত্ব থাকে। কেন্দ্রের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে রাজ্যগুলির সংবিধানরচিত হয়।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান প্রকৃতিগতভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভার পাশাপাশি অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য পৃথকভাবে আইনসভা থাকায় সমগ্র দেশে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে দুধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়।

  • একাধিক স্বতন্ত্র সরকারবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে পৃথক সরকার থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদ ও প্রাদেশিকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

উপসংহার: বর্তমানে কেন্দ্রপ্রবপতা বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মৌল কাঠামাের রূপান্তর ঘটছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের রূপরেখারও নতুন বিন্যাস ঘটেছে।