রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের যেসব গুণ রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল一
[1] স্থায়িত্ব: আইনসভার আস্থা বা অনাস্থার ওপর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের অস্তিত্ব নির্ভর করে না। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এই ধরনের সরকারের পতনের আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। এর ফলে সরকারের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়।
[2] প্রতিশ্রুতি পূরণ: রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত থাকে বলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে নির্বিঘ্নে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করা সম্ভবপর হয়।
[3] জরুরি অবস্থার উপযােগী: প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে বলে তিনি নিজে এককভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ করে তা কার্যকর করতে পারেন। তাই দেশ যখন বৈদেশিক আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গােলযােগ বা গৃহযুদ্ধ ইত্যাদির মতাে সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন রাষ্ট্রপতি তৎপরতার সঙ্গে তার মােকাবিলা করতে পারেন।
[4] ক্ষমতাস্তবতন্ত্রীকরণের সুফল: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের নীতি বলবৎ থাকায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযােগ পায়। ফলে শাসনব্যবস্থায় অযথা জটিলতার সৃষ্টি হয় না।
[5] দলব্যবস্থার কুফলমুক্ত: রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার সংকীর্ণ দলব্যবস্থার কুফল থেকে মুক্ত। কারণ রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের স্থায়িত্ব আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল নয়।
[6] প্রশাসনিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি: রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে দলমতনির্বিশেষে যােগ্য ব্যক্তিদের নিয়ােগ করার সুযােগ পাওয়া যায়। রাষ্ট্রপতিও তাঁর পছন্দমতাে, এমনকি নিজের দলের বাইরে থেকেও, যােগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে থাকেন। ফলে প্রশাসনিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়।
[7] দায়িত্বশীল প্রশাসন: রাষ্ট্রপতি-শাসিত প্রশাসনে সরকারের বিভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্বের এলাকা সুনির্দিষ্ট থাকায় প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে। তা ছাড়া এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন বলে তাঁর পক্ষে কোনাে জনবিরােধী কাজকর্ম করা সম্ভব হয় না।
[8] দলসর্বস্ব মানসিকতার অনুপস্থিতি: ব্রাইসের মতে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থার তুলনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় আইনসভায় দলীয় মানসিকতার প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কারণে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হওয়া সম্ভব হয়।
[1] ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের কুফল: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ পরস্পর স্বাধীনভাবে কাজ করায় উভয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সহযােগিতা গড়ে ওঠে না। শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগের মধ্যে আধিপত্য কায়েম নিয়ে একটা রেষারেষি লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক গেটেলের মতে, যখন আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন দলের অধীনে থাকে, তখন প্রশাসনিক সংকটের আশঙ্কা দেখা যায় (When legislature and executive are of different parties, there is constant danger of deadlock)
[2] স্বৈরাচারিতার সম্ভাবনা: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সরকারের সমগ্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে। এই ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি আইনসভার নেই। কারণ রাষ্ট্রপতি আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ নন। তিনি সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীনভাবে নিজের ক্ষমতা প্রয়ােগ করার অধিকারী। তা ছাড়া নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতিকে সহজে পদচ্যুতও করা যায় না। এইসব কারণে রাষ্ট্রপতি তাঁর কার্যকালে অনিয়ন্ত্রিত এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়ােগের সুযােগ পান। এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।
[3] দায়িত্বহীনতা: রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বাস্তবে একপ্রকার। দায়িত্বহীন সরকার আইনসভায় রাষ্ট্রপতির কোনােরকম দায়দায়িত্ব না থাকায় তাকে জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্যও করা যায় না।
[4] বিচার বিভাগের অত্যধিক প্রাধান্য: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ সত্ত্বেও বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতার পরিধির ব্যাখ্যা এবং কাজকর্মের বৈধতা বিচারের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকে। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ এই ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায়, সরকারি প্রশাসন ও আইন বিভাগের ওপর এই বিভাগ অত্যধিক প্রাধান্য বজায় রাখার সুযােগ পায়।
[5] জনমত প্রতিফলনে অন্তরায়: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় জনগণের সঙ্গে সরকারের কোনাে প্রত্যক্ষ সংযােগ স্থাপিত না হওয়ায়, গণমাধ্যমগুলির সাহায্যে পরােক্ষভাবে এই কাজ করতে হয়। এতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে।
উপসংহার: রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার গুণ-দোষ বিশ্লেষণ করে পরিশেষে বলা যায় যে, এই ধরনের শাসনব্যবস্থার সাফল্য ও ব্যর্থতা রাষ্ট্রপতির পদাধিকারী ব্যক্তির বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
Leave a comment