বর্তমান বিশ্বে বিশেষভাবে আলােচিত ও সমালােচিত বিষয় হল মানবাধিকার (Human Rights)। সাধারণভাবে মানবাধিকার বলতে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য অধিকারগুলিকে বােঝায়।

মানবাধিকার হল মানুষের অধিকার, যা জাতি-ধর্মবর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। মানুষ বা মানবিক সত্তার অস্তিত্ব রক্ষা ও কল্যাণসাধন এবং মানুষের মর্যাদা ও তার মনুষ্যসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানাের সঙ্গে মানবাধিকার সম্পর্কিত। শুধুমাত্র মানবসমাজের সদস্য হিসেবেই প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম কিছু অধিকার ভােগ আবশ্যিক। এই ন্যূনতম অধিকারই হল মানবাধিকার।

আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী মানবাধিকার বলতে সংবিধানগতভাবে সকলের আত্মমর্যাদা নিয়ে জীবনধারণের অধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার এবং সকলের সমানাধিকারকে বােঝায়। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের মাননীয় বিচারপতি নগেন্দ্র সিংহ বলেন, বিশ্বের যেকোনাে অংশে বসবাসকারী প্রতিটি পুরুষ অথবা নারী একজন মানুষ হিসেবে যেসব মৌলিক অধিকার ভােগ করতে পারে, সেগুলিকে মানবাধিকার বলে। ভারত সরকার প্রণীত ‘মানবাধিকার রক্ষা আইন’ (The Protection of Human Right Act, 1993)-এ বলা হয়েছে, “মানবাধিকার হল ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সাম্য ও মর্যাদা সংক্রান্ত সেইসব অধিকার, যেগুলি সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত অথবা আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রের অঙ্গীভূত এবং ভারতের আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য।”

মানবাধিকার সম্পর্কিত ধারণার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বস্তুত, অতি প্রাচীন প্রাকৃতিক অধিকার থেকে মানবাধিকারের সূচনা। তবে .নিঃসন্দেহে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় গৃহীত বিখ্যাত মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশ্বজনীন ঘােষণাপত্র মানবাধিকারের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তরফলক। এই ঘােষণাপত্রের ৩০টি ধারায় মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়ােজনীয় পৌর, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্থান পেয়েছে। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে বৈষম্য ছাড়াই বিশ্বের যে-কোনাে অংশের মানুষ ওই অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে। মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে—“মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা এবং অভিন্ন ও অপরিহার্য অধিকারের স্বীকৃতি হল স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং বিশ্বশান্তির মূলভিত্তি”।

জাতিপুঞ্জের ঘােষণাপত্রে বিবৃত মানবাধিকারসমূহ

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশ্বজনীন ঘােষণাপত্রে মােট ৩০টি অনুচ্ছেদে মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। মূলত ব্যক্তির পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে। (প্রথম ২১টি অনুচ্ছেদ)

  • [1] জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার, 

  • [2] দাসত্ব ও অত্যাচার থেকে মুক্তি, 

  • [3] আইনের চোখে সমানাধিকার, 

  • [4] চিন্তা-বিবেকধর্ম-মতামত বক্তব্য প্রকাশের মৌলিক অধিকার, 

  • [5] যথেচ্ছ গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি লাভের অধিকার ইত্যাদি।

দ্বিতীয় অংশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে

  • [1] কাজ করার ও পাওয়ার অধিকার, 

  • [2] সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার, 

  • [3] ভদ্রস্থ জীবনযাপনের অধিকার,

  • [4] শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি।

এ ছাড়া মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিপুঞ্জের কিছু আন্তর্জাতিক দলিলও রয়েছে। এইসব দলিলে লিপিবদ্ধ অধিকারের মধ্যে রয়েছে। বাঁচার অধিকার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মৌল অধিকার, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও শরণার্থীদের মানবিক অধিকার, শিশুদের অধিকার, আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি।

মানবাধিকারের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ

মানবাধিকার হল এমন এক অধিকার যা জন্মসূত্রে সব মানুষের সমানাধিকার ও সমমর্যাদার নীতি ঘােষণা করে। আবার জাতিপুঞ্জের সনদের ভাষা অনুযায়ী, মানবাধিকার হল সেই সমস্ত অধিকার যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তিকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবনধারণের অধিকার ও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার প্রদান করে। এই আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকারের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলি হল一

  • [1] মানবাধিকার মানুষের জন্মগত ও সহজাত অধিকার, 

  • [2] মানবাধিকারের মাধ্যমেই মানুষ নিজের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, 

  • [3] মানবাধিকার একটি বিশ্বজনীন অধিকার, 

  • [4] মানবাধিকারের আদর্শ ব্যক্তির কল্যাণ নয়, সমষ্টির কল্যাণ, 

  • [5] সদাজাগ্রত জনমত মানবাধিকারের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ,

  • [6] নৈতিক মূল্যবােধ মানবাধিকারের মূল ভিত্তি, 

  • [7] মানবাধিকারের কোনাে আইনগত ভিত্তি নেই।

আপাতদৃষ্টিতে মানবাধিকার ও অন্যান্য অধিকার, উভয়ই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববিকাশের পক্ষে সহায়ক। সেদিক থেকে এই দুই অধিকারকে অভিন্ন বলে ধরা যেতে পারে। তবে মানবাধিকারের সঙ্গে অন্যান্য অধিকারের কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেগুলি হল-

মানবাধিকার

  • মনুষ্যত্নের অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে মানবাধিকারের ধারণার ওপর গুরুত্ব আরােপিত হয়। এই কারণে মানবাধিকারের প্রকৃতি সর্বজনীন।

  • মানবাধিকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক—এই দুই স্তরেই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি অর্জন করে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশ্বজনীন ঘােষণা’-য় ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

  • মানবাধিকার সুরক্ষিত করার জন্য আন্তর্জাতিক নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৯৩ সালে মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলনে গৃহীত। ভিয়েনা ঘােষণাপত্র ও কর্মসূচিতে বলা হয় মানবাধিকারকে উৎসাহ দেওয়া ও তার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক মহলের একটি দায়িত্ব।

  • মানবাধিকারের বাস্তব রূপায়ণে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে মানবাধিকার কমিশন উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতিপুঞ্জের অধীনে মানবাধিকার হাইকমিশনারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় স্তরেও বিভিন্ন দেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে।

  • মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সেই সংক্রান্ত অভিযােগ সরাসরি আদালতে পেশ করা যায় না। এজন্য মানবাধিকার কমিশন বা কমিটির কাছে আবেদন জানাতে হয়।

অন্যান্য অধিকার

  • রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সংরক্ষিত সাধারণ অধিকার শুধুমাত্র সেই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট জনসমষ্টির পক্ষেই ভােগ করা সম্ভব। তাই সাধারণ অধিকারকে কোনােভাবেই সর্বজনীন আখ্যা দেওয়া যায় না।

  • সাধারণ অধিকারের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনাে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেখা যায় না। সাধারণ অধিকার কেবল জাতীয় ক্ষেত্রে নিজের রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের সীমানার মধ্যেই স্বীকৃতি পায়।

  • অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে কোনাে আন্তর্জাতিক নজরদারির কথা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কারণে কল্পনা করা যায় না। সাধারণ অধিকারের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র নিজেই নজরদারি করে থাকে।

  • রাষ্ট্রীয় এক্তিয়ারের অধীন মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধান কর্তৃক বিধিবদ্ধ থাকে বলে তার আইনগত বাধ্যবাধকতা লক্ষ করা যায়। নাগরিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে আইননির্ভর।

  • যেসব সাধারণ অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ হওয়ার কারণে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা লাভ করেছে, তা লঙ্ঘিত হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ বা শীর্ষ আদালত প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, মানবাধিকার ও অন্যান্য অধিকারের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। তবে মানবাধিকার সভ্য দুনিয়ায় মনুষ্যত্বের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে এক মহত্তম বিশ্বজনীন আদর্শের অঙ্গীকার।