রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে সুভদ্র নিছকই কিশােরসুলভ কৌতূহলে অচলায়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলেছিল। কিন্তু এই ঘটনা অচলায়তনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, কারণ অচলায়তনের সংস্কার অনুযায়ী উত্তর দিকে ছিল একজটা দেবীর অধিষ্ঠান। বস্তুতপক্ষে অচলায়তনে প্রথার সঙ্গে প্রাণের যে দ্বন্দ্ব বহুকাল ধরে বয়ে চলেছে তা তীব্রতর হয়েছে সুভদ্রের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। আয়তনের বালকেরা এই ঘটনাকে ‘ভয়ানক পাপ বলে মনে করেছে। অচলায়তনের উপাধ্যায়ও শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন এই ভেবে যে ‘কী সর্বনাশ হবে’। উপাধ্যায় এবং মহাপক চিন্তিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, জানলা খােলার ফলে আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসে এসে মিশেছে বাইরের বাতাস, ফলে অশুচি হয়ে গেছেন সকলেই। তাই শুচিতা রক্ষার জন্য প্রায়শ্চিত্তের সন্ধান করেছেন তারা। ভগবান জুলনানন্তকৃত আধিকমিক বর্ষায়ণ উদ্ধৃত করে মহাপঞ্চক সুভদ্রের জন্য ছ-মাস মহাতামস সাধনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে অন্যমতও তৈরি হয়েছে। পঞ্চক সুভদ্রকে আলিঙ্গন করেছিল এই বলে যে সে “তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল” ঘুচিয়েছে। আর সুভদ্রকে শাস্তি বিধানের মুহূর্তে তাকে আশ্বস্ত করেছেন, আশীর্বাদ জানিয়েছেন স্বয়ং অচলায়তনের আচার্য। বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার এইসব ধরন থেকেই তীব্র হয়ে উঠেছে অচলায়তনের নাট্যদ্বন্দ্ব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকে অচলায়তনের পুথিনির্ভর যে জীবনসাধনা, সেখানে শাস্ত্র আচরণই একমাত্র পালনীয় বিষয়। কিন্তু অচলায়তনের দৃষ্টিতে ‘অস্পৃশ্য যূনকরা ছিল নিছকই কর্মজীবী! তারা মন্ত্র জানে না, গুরুবাদ মানে না। সারাদিন ধরে নানারকম মন্ত্র আওড়ানাের পরিবর্তে যুনকেরা জীবনের সার্থকতা খোঁজে কাজের মধ্যে। তাই মাঠে চাষ করে তারা আনন্দ পায়—সেই কাজের মধ্যেই তারা প্রাণের গানের সুর ও ভাষা খুঁজে পায়। চষা মাটির গন্ধে তারা বাতাস ভরিয়ে তােলে। রােদ বা বৃষ্টি, কোনাে কিছুই তাদেরকে এই কর্মমুখর দিনযাপন থেকে বিরত করতে পারে না। কাকুড়ের চাষ, খেসারি ডালের চাষ—যাকে অচলায়তনের দৃষ্টিকোণ থেকে গহিত কাজ বলে মনে করা হয়, তার মধ্যে খাদ্য জোগানাের আনন্দকেই খুঁজে নেয় খুনকেরা। যুনকেরা বজ্রবিদারণ মন্ত্র পড়েনি, মরীচী, মহাশীতবতী বা উয়ীষবিজয় মন্ত্রও জানে না। কিন্তু তারা লােহার কাজ করে, ক্ষৌরকর্মের সময় গাল কেটে রক্ত বেরােলেও খেয়া নৌকোয় উঠে নদী পেরােতে ভয় পায় না। এইভাবে অচলায়তনের অন্ধকার কক্ষে নয়, যূনকরা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায় তাদের‌ কাজের মধ্যে, মুক্ত পৃথিবীতে। কাজের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে‌ নিজেদের নিবিড় যােগাযােগকেই তারা প্রশ্নোষ্ধৃত মন্তব্যের সাহায্যে বােঝাতে চেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকে কর্মপাগল যুনকরা পককে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যটি করে।

পঞ্চক অচলায়তনের নিয়মতান্ত্রিকতা না মানলেও অচলায়তনের যাবতীয় সংস্কার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে যূনকদের কর্মধারা, জীবনদর্শন তার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। কাঁকুড় কিংবা খেসারি ডালের চাষ, লােহার কাজ বা মন্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা, অথবা ক্ষৌরকর্মের সময় গাল কেটে গেলেও খেয়া নৌকোর সাহায্যে নদী পেরােতে ভয়হীনতা-সবকিছুই পঞ্চকের কাছে কখনও আপত্তিকর, কখনও অদ্ভুত মনে হয়। অচলায়তনের নিয়ম এবং শাস্ত্রবচন প্রতি মুহূর্তে পঞ্চকের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাই পঞ্চক প্রাথমিকভাবে যূনকদের নিষেধ করে তাকে স্পর্শ করতে, শূনকদের মুখদর্শন করাও পাপ বলে সে উল্লেখ করে। কিন্তু পঞ্চকের ভিতরে সহজাতভাবেই ক্রিয়াশীল ছিল নিয়ম ভাঙার প্রতি আকর্ষণ। তাই পঞক শেষপর্যন্ত শূনকদের সহজ সরল এবং মুক্ত জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্টই হয়। সে শূনকদের বুকে জড়িয়ে নেচে উঠতে চায়। সে এক অপ্রতিরােধ্য আকর্ষণ অনুভব করে যূনকদের আচারসর্বস্বতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত জীবনধারার প্রতি। পঞ্চক তাই বলেই ফেলে—“আমার সর্বনাশ করলে! আমার আর ভদ্রতা রাখলে না। এদের তালে তালে আমারও পা দুটো নেচে উঠছে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে দেখা যায়, সবরকম ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাইরে ছিল দাদাঠাকুরের অবস্থান।

পঞ্চকের মুখে অচলায়তনে গুরুর আগমন বার্তা শুনে দাদাঠাকুর বলেন, “ভারি উৎপাত করবে তা হলে তাে।” গুরুবাদের নামে সমাজে যে গােষ্ঠীবদ্ধতা এবং আচরণ-নির্ভরতা তৈরি হয় তার বিরােধিতা করেন দাদাঠাকুর। প্রথম যূনক তাই যথার্থই বলেছে—“উনি আমাদের সব দলের শতদল পদ্ম।” দাদাঠাকুরের মূল লক্ষ্যই হল জীবনের যথাযথ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে, অচলায়তন জীবনকে দ্যাখে শাস্ত্রের আবদ্ধতায়, আচরণ আর নিয়মের শৃঙ্খলে। সুভদ্রের উত্তর দিকে জানলা খােলা তাই সেখানে ‘অপরাধ, পঞ্চকের গান গাওয়া মতিভ্রম’ বলেই গণ্য হয়। বাইরের আলাে-হাওয়ারও সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই। তাই যুনকরা মনে করে সেখানে মুক্ত জীবনের প্রতীক দাদাঠাকুর প্রবেশ করলে এক বিপুল পরিবর্তন আসবে। খুলে যাবে অচলায়তনের বদ্ধ কপাট। রুদ্ধ অচলায়তনের পাথরগুলােও নৃত্যপর হয়ে উঠবে। জীর্ণ আচারের সংকলন পুথিগুলাের মধ্যে বাঁশির সুর শােনা যাবে। অর্থাৎ, দাদাঠাকুর যদি অচলায়তনে যান, তা হলে সেখানে ভেঙে যাবে প্রথার প্রাচীর, ঢুকে পড়বে প্রাণের অপ্রতিরােধ্য প্রবাহ।