মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলার সাহিত্য ও সমাজজীবনে এক যুগান্তকারী ঘটনা। লােকোত্তর প্রতিভা ও চরিত্রের অধিকারী চৈতন্যদেব সমকালীন জীবনধারায় যে পরিবর্তনের স্রোত এনে দিয়েছিলেন, তার প্রভাব একালেও মন্দীভূত হয়নি। তাই তার সমকালেই তার লৌকিক জীবন কাহিনী অলৌকিকতায় মণ্ডিত হয়ে ভক্তজনের হৃদয়ে গভীর আবেগের সৃষ্টি করেছিল এবং তারি ফলােদয় ঘটেছিল বিভিন্ন সাহিত্যকৃতিতে। চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছেন অথবা তার সহচরদের সাহচর্যে এসেছেন, এমন অনেকেই চৈতন্যজীবনী এবং চৈতন্যভাবধারার পরিচয়-দানের জন্য তার প্রায় সমকালেই লেখনী ধারণ করেছিলেন। বহুশ্রুত চৈতন্য-জীবনকাহিনীর প্রামাণিক উপাদান-সংগ্রহ তৎকালীন কোন দুঃসাধ্য কর্ম ছিল না; কিন্তু চৈতন্যচরিতকারগণ সকলেই ছিলেন নৈষ্ঠিক চৈতন্যভক্ত; ফলে ভক্তের দৃষ্টিতে তারা প্রভু-জীবনকে নিরীক্ষণ করেছিলেন বলেই চৈতন্য জীবনীগুলি খাঁটি ‘জীবনীসাহিত্য’ হয়ে উঠতে পারেনি। অলৌকিকতায় মণ্ডিত চৈতন্যজীবনীগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘সন্ত-সাধক-জীবনী’ বা Hagiography-রূপেই অভিহিত হবার যােগ্য।


চৈতন্যজীবনী রচনার প্রথম প্রচেষ্টার সূত্রপাত হয়েছিল হয়তাে বা চৈতন্যদেবের জীবক্কালেই। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, চৈতন্যদেবের বয়ােজ্যেষ্ঠ সহাধ্যায়ী মুরারি গুপ্ত সম্ভবতঃ ১৫২০ থেকে ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই রচনা করেছিলেন চৈতন্যজীবনী ‘শ্রীশ্ৰীকৃষ্ণটচৈতন্য চরিতামৃত’। গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং এটি সাধারণভাবে মুরারি গুপ্তের কড়চা নামেই পরিচিত। এটি ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় চৈতন্য জীবনীমূলক আরাে অন্ততঃ তিনখানি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এই তিনখানি গ্রন্থই কবিকর্ণপূর’ পরমানন্দ সেন কর্তৃক রচিত। তন্মধ্যে ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ একখানি নাটক—এতে চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পরবর্তী পর্যায় বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থখানি মহাকাব্য-জাতীয়, এটির নাম ‘শ্রীচৈতন্যচরিতাম্’। এতে চৈতন্যদেবের সমগ্র জীবনকাহিনীই স্থানলাভ করেছে। তৃতীয় গ্রন্থখানি মূলত বৈষ্ণব দর্শন বিষয়ক হলেও এতে চৈতন্যদেব ও তার ভক্তদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ১৫৪২ খ্রীঃ, ‘গৌরগণােদেশ দীপিকা’ ১৫৭৬ খ্রীঃ এবং চৈতন্যচন্দ্রোদয় লেখকের পরিণত বয়সের রচনা। গৌড়বঙ্গে সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই গ্রন্থগুলি যথােপযুক্তভাবে সমাদৃত না হলেও বহির্বঙ্গে চৈতন্য-জীবনে এবং মহিমা প্রচারে এদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। গ্রন্থগুলি আকরগ্রন্থরূপে বিবেচিত হলেও এবং গ্রন্থকারদ্বয় প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যদেব বা তার পার্ষদদের সাহচর্য লাভ করলেও ভক্তের দৃষ্টিতে চৈতন্যজীবনী রচনা করেছেন বলেই ঐতিহাসিক জীবনী লেখকের মর্যাদা লাভ করতে পারেন না।


বাঙলা ভাষায় রচিত চৈতন্য-জীবনীর সংখ্যা অপরিমিত না হলেও এদের প্রত্যেকটিই সুলিখিত এবং প্রত্যেকটিই কোন-না-কোন কারণে উল্লেখযােগ্য। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও এদের মধ্যে বৃন্দাবনদাস-রচিত চৈতন্যভাগবত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ বৈষ্ণব সমাজে শুধু বিশিষ্টতাই লাভ করেনি, একেবারে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদায়ও অভিষিক্ত হয়েছে। অপর গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে লােচনদাসের ‘চৈতন্য মঙ্গল’, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, ‘গােবিন্দদাসের কড়চা’ এবং চূড়ামণিদাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’।


বাঙলা ভাষায় রচিত চৈতন্যজীবনীগুলির মধ্যে বৃন্দাবনদাস রচিত চৈতন্যভাগবত ই সম্ভবতঃ প্রাচীনতম। বৃন্দাবনদাসের মাতার নাম নারায়ণী, পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত; তবে প্রভু নিত্যানন্দ ছিলেন বৃন্দাবনদাসের গুরু। কবি গুরুপ্রমুখাৎ চৈতন্যজীবনীর উপাদান জ্ঞাত হয়েছিলেন বলে তাঁর বর্ণিত তথ্যে আস্থা স্থাপন করা চলে। গ্রন্থরচনাকাল-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা না গেলেও পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই হয়তাে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল। চৈতন্যভাগবত তিনখণ্ডে বিভক্ত। এর আদিখণ্ড চৈতন্যদেবের গয়া থেকে প্রত্যাবর্তন, মধ্যখণ্ডে সন্ন্যাসগ্রহণ এবং অন্তাখণ্ডে চৈতন্যদেবের নীলাচলে গুণ্ডিচাযাত্রা পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কবিরাজ কৃষ্ণদাস মনে করেন যে, নিত্যানন্দ-লীলা বর্ণনায় আবিষ্ট হয়ে পড়ায় বৃন্দাবনদাস চৈতন্যদেবের শেষলীলা বর্ণনা করে উঠতে পারেন নি। বৃন্দাবনদাস মােটামুটিভাবে ভাগবতপুরাণের অনুসরণেই চৈতন্যলীলা বর্ণনা করেছেন বলে তাকে ‘চৈতন্যলীলার ব্যাস’ বলে অভিহিত করা হয়। কৃষ্ণলীলার অনুসরণ হেতু চৈতন্য-ভাগবতে বহু অলৌকিক এবং অপ্রাকৃত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। তৎসত্ত্বেও গ্রন্থটি অতিশয় উপাদেয় বলে বিবেচিত হয়। এর সহজ সরল ভাষা এবং বিভিন্ন চরিত্রচিত্রাঙ্কনে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়া সমকালীন নবদ্বীপ সমাজের যে তথ্যনিষ্ঠ বাস্তব চিত্র তিনি অঙ্কন করেছেন, তার ঐতিহাসিক মূল্যও যথেষ্ট। এই সমস্ত কারণে সাধারণ পাঠকের নিকট বৃন্দাবনদাস রচিত ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থটিই চৈতন্যজীবনীর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন-রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে।


যারা নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বিষয়েও জিজ্ঞাসু তাদের নিকট কৃষ্ণদাস কবিরাজ গােস্বামী বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থটিই সর্বাধিক মূল্যবান বিবেচিত হয়। কবিরাজ গােস্বামী প্রত্যক্ষভাবে বৃন্দাবনের ষড়ুগােস্বামীদের সাহচর্যে এসে তাদের আদেশ-নির্দেশ শিরােধার্য করেই গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থে প্রদত্ত পুষ্পিকা অনুযায়ী গ্রন্থরচনাকাল ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দ, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় গ্রন্থটি অনেক পূর্বেই রচিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। চৈতন্যচরিতামৃত আদি, মধ্য ও অন্ত্যলীলা—এই তিনখণ্ডে বিভক্ত। বৃন্দাবনদাস চৈতন্যজীবনের যে সমস্ত কাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন, কবিরাজ গােস্বামী পূর্বসূরীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন-হেতু ঐ সমস্ত অংশ অতি সংক্ষেপে সেরে চৈতন্যদেবের শেষ-জীবনকাহিনী বিস্তৃতভাবে পরিবেষণ করেছেন; কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি চৈতন্যদেবের তিরােধান ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কবিরাজ গোস্বামী ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত মনীষী, তিনি চৈতন্য-জীবনী বর্ণনা অপেক্ষাও অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করেছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপনা ও ব্যাখ্যায়। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে কয়েক শ’ শ্লোক উদ্ধার করেছেন। তার স্বরচিত শ্লোকের সংখ্যাও শতাধিক। বস্তুতঃ বৈদগ্ধ্যে ও মননশীলতায় সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কোন দোসর নেই। তার গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে পদ্যে রচিত ধর্ম-দর্শন-বিষয়ক প্রবন্ধ সাহিত্য।


লােচনদাস এবং জয়ানন্দ উভয়ই ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে চৈতন্যজীবনী রচনা করেন। লােচনদাস বৃন্দাবনদাসের পরবর্তীকালে বর্তমান ছিলেন। তিনি মােটামুটিভাবে মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা রচনা করে অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন। জয়ানন্দও একই পথের পথিক, তিনি অধিকন্তু অনেক পৌরাণিক কাহিনীও এতে যুক্ত করেছেন। লােচনদাস মােটামুটি মুরারি গুপ্তের অনুসরণ করেছেন এবং অন্তাখণগুটি অসম্পূর্ণ রেখেছেন। গৌরপারম্যবাদ বা নদীয়া নাগরবাদের প্রবক্তা নরহরি সরকার ঠাকুরের শিষ্য লােচনদাসও গৌরাঙ্গলীলাকে কৃষ্ণলীলার অনুকরণে সাজিয়ে নদীয়ার কুলবধূদের কামােন্মত্তরূপে বর্ণনা করেছেন। বস্তুতঃ লােচনদাসের কাব্য পল্লবিত কবিতাংশে অতিশয় উপাদেয় হলেও এতে ঐতিহাসিকতার পরিচয় নেই, এটি আগাগোড়া চমৎকার একটি রােমান্টিক কাব্যে পরিণত হয়েছে। নয়খণ্ডে জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলের কাহিনীতে নানাদিক থেকেই যথেষ্ট স্বাতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়। তিনি মূলতঃ ছিলেন গায়েন, পালাগানের আকারে কাব্যটি রচনা করেছেন। একমাত্র এর গ্রন্থেই চৈতন্যদেবের মহাপ্রয়াণ কাহিনী বিশ্বাসযােগ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। এতে অলৌকিকত্ব না থাকাতেই হয়তাে বৈষ্ণবমহলে গ্রন্থটি তেমন সমাদর লাভ করেনি। তবে গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকৃতি লাভের যােগ্য।


‘গােবিন্দদাসের কড়চা’ নামে যে চৈতন্যজীবনীটি প্রচারিত হয়েছে, এর প্রামাণিকতায় যথেষ্ট সংশয়ের কারণ রয়েছে। একমাত্র জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল’ গােবিন্দ কর্মকার নামক এক চৈতন্য সঙ্গীর উল্লেখ পাওয়া যায়, অন্যত্র কোথাও এর সন্ধান পাওয়া যায় না। গ্রন্থে গােবিন্দ কর্মকার নিজেকে ‘হাতা-বেড়ি-গড়া’ ‘নি্গুণ মুখ’ কর্মকার বলে উল্লেখ করেও যেভাবে বিভিন্ন বৈষ্ণব তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন এবং ইংরেজি ও পর্তুগীজ আমলের বস্তু বা স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, তাতে পণ্ডিতগণ এটিকে প্রামাণিক গ্রন্থের মর্যাদা দান করেন। ন। চূড়ামণি দাস রচিত ‘গৌরাঙ্গ-বিজয়’ নামক একটি চৈতন্য জীবনী খন্ডিত আকারে পাওয়া গেছে। এতে কোন পরিচ্ছেদ বিভাগ নেই। গ্রন্থকার চৈতন্যদেবকে ‘অবতার’ বলে বিশ্বাস করলেও বাস্তবতাবােধের পরিচয় রেখেছেন সর্বত্র। গ্রন্থটি সম্ভবতঃ ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই রচিত হয়েছিল। এ ছাড়া জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে পূর্ববর্তী কয়েকটি চৈতন্য জীবনীর উল্লেখ আছে, কিন্তু গ্রন্থগুলির কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে আছে—গৌরীদাস পণ্ডিত রচিত একটি গ্রন্থ, পরমানন্দ কৃত ‘গৌরাঙ্গ বিজয়’ এবং গােপাল বসু রচিত ‘চৈতন্যমঙ্গল’।


অনার্স বাংলা প্রথম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা দ্বিতীয় পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা তৃতীয় পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা চতুর্থ পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা ষষ্ঠ পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা সপ্তম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা অষ্টম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর