বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবির সম্মান দেওয়া হয় মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতি ঠাকুরকে। অভিনব জয়দেব-এ বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় যে সকল পদ রচনা করেছিলেন, সেই পদের ভাষা ‘ব্রজবুলি’কে উনিশ শতকের বাঙালী মনীষীরা মনে করেছিলেন ‘ব্রজের’ ভাষা অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি ব্রজধামের ভাষা। বিদ্যাপতিকেও তারা বাঙালী কবি বলেই মনে করেছিলেন। পরবর্তীকালের গবেষণায় উভয় ধারণাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।
বিদ্যাপতির পরিচয় :
কবির আবির্ভাব ও তিরোভাবের সঠিককাল নির্ণয়ের সমস্যা আছে। ১৩৮০ খ্রীষ্টাব্দের বা অনতি পূর্ববর্তী সময়ে উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বংশে বিদ্যাপতির জন্ম হয়। পিতার নাম গণপতি, কৌলিক উপাধি ‘ঠক্কুর বা ঠাকুর। অনুমিত হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কবির তিরোভাব হয়। মিথিলায় প্রচলিত লোক মুখে দুলহা নামে কবির কন্যা, চন্দ্রকলা নামে কবিত্ব খ্যাতিসম্পন্না পুত্রবধূ এবং হরপতি, নরপতি, ও বাচ্যপতি নামে পুত্রদের কথা জানা যায়। মিথিলার কামেশ্বর বংশোদ্ভুত রাজা কীর্তিসিংহ, নরসিংহ, ভৈরবসিংহ, এবং দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা কবি বিদ্যাপতি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে লাভ করেছিলেন। এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি মৈথিলী, সংস্কৃত ও অবহট্ট ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
বিদ্যাপতির রচিত গ্রন্থ :
বিদ্যাপতি শুধু কবিতা নয়, পৌরাণিক এবং স্মৃতি গ্রন্থাদি রচনা করেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যেমন—ভূপরিক্রমা (১৪০০), পুরুষপরীক্ষা ও কীর্তিবিলাস (১৪১০), লিখনাবলী (১৪১৮), শৈবসর্বস্বসার, গঙ্গাবাক্যাবলী (১৪৩০-৪০), দানবাক্যাবলী ও গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী (১৪৪০-৬০) প্রভৃতি গ্রন্থ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ধর্মমতে তিনি কুলরীতি অনুযায়ী ছিলেন শৈব, তবু তাঁর অন্তরের নিবিড় আকুতি বৈব পদেই যেন বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছে। তবে দীর্ঘকাল রাজসভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে তাঁর মনের চারিদিকে একটা দরবারি-আদর্শের মার্জিত পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল। মন্ডলকলা সিদ্ধ যে সৌকুমার্য ও বাক নির্মিতির বিস্ময়কর পরিমার্জনা বিদ্যাপতির মুখ্য গুণ, তা এই রাজ সভারই পরিবেশ শাসিত রুচি নিষ্ঠার ফসল। ভাষা ভঙ্গিমাকে পালিশ করে ঘষে মেজে “রাজকণ্ঠের মণিমালার মত” দ্যুতিময় করে তোলা রাজসভার এই কবির বাকরীতি বৈশিষ্ট্য।
বিদ্যাপতির প্রধান পরিচয় তাঁর রাধাকৃষ্ণ পদাবলী। রাধাকৃষ্ণের স্পষ্ট উল্লেখ আছে তাঁর এমন পদের সংখ্যা ৫০০টিরও বেশি। সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রে বর্ণিত নায়ক-নায়িকার প্রকারণ অনুসারে তিনি রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, রাধার বয়োঃসন্ধি, বাসর সজ্জা, অভিসার, বিপ্রলম্বা, খণ্ডিতা, কলহান্তারিতা বা মান, বিরহ, পুনর্মিলন, বা ভাব সম্মেলন প্রভৃতি বিভিন্ন লীলা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের বিরহ ও মিলন লীলা বর্ণনা করেছেন। প্রসঙ্গ ও প্রকরণের সমন্বয়ে, কল্পনা ও বাক্রীতির সমন্বয়ে তাঁর সৃষ্ট পদগুলি হয়েছে দীপ্তিময়। জীবনরসের চিত্রণই তাঁর ধর্ম। তাই তাঁর পদাবলী প্রাণের গভীর রসে দ্রবীভূত। আর এই কারণেই তাঁর কাব্যপাঠে মহাপ্রভু শান্তি পেতেন। এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৈষ্ণুবদের গুরুস্থানীয় এবং রসিক বাঙালির “কবি সার্বভৌম।” তাঁর লেখনীতে বয়ঃসন্ধি থেকে মাথুরের আর্তি পর্যন্ত পদগুলির মধ্যে রাধাচরিত্রের যে স্বরূপটি পরিস্ফুট তার অভিনবত্ব বিদ্যাপতিকে দান করেছে অমরত্বের সিংহাসন। চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসকে ছাড়িয়ে একমাত্র বিদ্যাপতি রাধার অখন্ড জীবন প্রবাহকে বর্ণাঢ্য কল্পনার আলোকসম্পাতে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বয়সন্ধির নৃত্য চপল মুহূর্ত থেকে ভাব সম্মিলন পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর রাধা ধীরে ধীরে কোরক থেকে পূর্ণ যৌবন বিকশিত কমলিনীতে পরিণত হয়েছেন।
রাধার প্রথম যৌবনে ভীতি মিশ্রিত কৌতুক, অবাধ বাসনার প্রচ্ছন্ন উল্লাস, শৈশব স্রোতস্বিনীর কুলুকুলু ধ্বনির সঙ্গে যৌবন সমুদ্রের দূরাগত কল্লোল সংঘাত এমন চিত্র কল্পে ও মন্ডল কলায় বিদ্যাপতি চিত্রিত করেছেন যা বড়োই বিস্ময়কর। বায়েসন্ধির নবীন আলোক পাতে রাধার মনের উপরে যে চপল চিন্তার নৃত্য চলেছে রসিক শিল্পী চিত্রের পর চিত্র যোগ করে তাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে পূর্বরাগের পদে বয়সন্ধির পদের মতো বিস্ময়কর কবিত্ব শক্তি অনেকাংশে অনুপস্থিত; কিন্তু তা সত্ত্বেও কবি ব্যক্তিত্ব উপেক্ষনীয় নয়। বিদ্যাপতি এতদিন রূপের অন্দরমহলে বন্দি ছিলেন, অভিসার পর্বে এসে তাঁর মুক্তি ঘটলো অসীম রসলোকে। মাথুর পর্বে দেখি দুঃখ বেদনার অগ্নিতাপে কৃষ্ণ বিহনে রাধা চিত্তের ব্যাকুল ক্রন্দন বর্ষনমুখর প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বর্ণ কমলের মত ফুটে উঠেছে—“মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওত ছাতিয়া।” বাংলা কাব্যে এই পদের সমকক্ষ পদ বিরল। ভাব সম্মিলনের পদে বিদ্যাপতির একক প্রাধান্য। বিরহিনি রাধা কল্পনা করছেন কৃষ্ণ আসবেন। তিনি এলে রাধা তাঁকে বরণ করে নেবেন—
পিয়া যব আওয়র এ মঝু গেহে।
মঙ্গল যতহুঁ করব নিজ দেহে।।
বিদ্যাপতি-সমস্যা: বিদ্যাপতিই ব্রজবুলি ভাষায় প্রথম পদ রচনা করেন এবং তার পদগুলি গুণে ও মানে অতিশয় উন্নত বলে ব্রজবুলি ভাষায় রচিত উৎকৃষ্ট বহু পদই বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত। কবিশেখর, কবিবল্লভ-আদি রচিত বহু পদই বিদ্যাপতির নামে চলে আসছে। বাঙলাদেশে শ্রীখণ্ডের কবিরঞ্জন নামক এক পদকর্তাও বিদ্যাপতি উপাধিধারী ছিলেন। সাধারণতঃ তিনি ‘ছােট বিদ্যাপতি নামে পরিচিত। তার অনেক পদও বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত আছে। ফলতঃ বিদ্যাপতি-রচিত পদগুলিকে পৃথক চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিদ্যাপতি-সমস্যার হাত থেকে মুক্তির কোন উপায় হয়তাে আর নেই।
বিদ্যাপতির বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ:
বিদ্যাপতি যে বাঙালী নন, মিথিলার অধিবাসী—এই ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালে। স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদের রস আস্বাদন করতেন। চৈতন্যোত্তর যুগের অনেক বাঙালী বৈষ্ণব কবিই তাদের পূর্বসুরীরূপে বিদ্যাপতির নাম উল্লেখ করে গেছেন। এমন কি, কোন কোন ঐতিহাসিক এমন কথাও উল্লেখ করে গেছেন যে বিদ্যাপতির প্রকৃত নাম ‘বসন্ত রায় এবং তিনি ছিলেন যশােরের অধিবাসী। অতএব বাঙালী সাধারণের পক্ষে বিদ্যাপতিকে বাঙালী কবিরূপে গ্রহণ করাটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এর মধ্যে একটা সমস্যা হলো—বিদ্যাপতি বাঙলা ভাষায় কিছুই রচনা করেন নি ; তাঁর যাবতীয় রচনা সংস্কৃত, অবহটঠ, মৈথিলী ভাষাতে রচিত। তার মৈথিলী ভাষায় রচিত বৈষ্ণব পদগুলি পশ্চিমা হিন্দি ও বাংলার সংমিশ্রণে রূপান্তরিত হয়ে কৃত্রিম ব্রজবুলি পদে পরিণত হয়েছে। তাই তাকে বাঙলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি উঠতে পারে। কিন্তু এখানে কথা হলাে বিদ্যাপতি যে সংস্কৃত, অবহটঠ ও মৈথিলী ভাষায় কিছু রচনা করেছেন, তা এতকাল ছিল বাঙালীর অজ্ঞাত। সাম্প্রতিক গবেষণায়ই এটি প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে বহুকাল থেকেই বিদ্যাপতির ব্রজবুলি পদগুলির জনপ্রিয়তা ছিল। ব্রজবুলির ধ্বনিমাধুর্যের প্রভাবও ছিল অসামান্য। বহু বাঙালী কবিও ব্রজবুলিতেই শুধু পদ রচনা করেছেন। বাঙলায় করেননি, এমনকি বাঙালীদের মধ্যেও ‘বিদ্যাপতি’ উপাধিধারী এবং বিদ্যাপতির অনুসরণকারী অনেকে রয়েছেন, অতএব পূর্ব থেকেই বিদ্যাপতিকে যে বাঙালী কবিরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল, আধুনিক কালের ঐতিহাসিকগণও সসম্মানে বিদ্যাপতির সেই অন্তর্ভুক্তিকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। অনুমান করতে দোষ নেই, স্বদেশে অর্থাৎ মিথিলায় কবি বিদ্যাপতির বৈষ্ণবপদাবলীর জনপ্রিয়তা যতখানি, বাঙলাদেশে তার পরিমাণ নিশ্চয়ই কয়েক গুণ বেশি। বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে?
মহাপ্রভু স্বয়ং বিদ্যাপতির পদের রসাস্বাদ করতেন বলে তার জীবনীকারগণ উল্লেখ করে গেছেন বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার একটি অখণ্ডনীয় প্রমাণরূপেই এই তথ্যটিকে গ্রহণ করা চলে। বিদ্যাপতি সম্ভবতঃ জয়দেবের অনুকরণেই ‘মধুর কোমল কান্ত’ পদ রচনা করেন, অন্ততঃ তার অভিনব জয়দেব’-উপাধি থেকে এ কথা মনে হয়। কাব্যের আভ্যন্তর বিচারেও কিন্তু উভয়ের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। তারা দু’জনেই দেহবিলাস এবং সম্ভোগ বর্ণনার কবি। সম্ভবতঃ সৌন্দর্য প্রীতির জন্যই তাঁরা দেহবর্ণনার উপর এত বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তাদের রচনায় রূপাসক্তি বহু ক্ষত্রেই ভােগাসক্তিকে অতিক্রম করে গেছে। তাদের রচিত সম্ভোগ বর্ণনাও কল্পজগতের বস্তু বলে অনুভূত হয়। জয়দেব ও বিদ্যাপতি উভয়েই ছিলেন রাজসভার কবি। তাই তাদের রচনা মার্জিত, অগ্রাম্য শ্লীলতাপূর্ণ এবং কাব্যশ্রীমণ্ডিত। ছন্দে, অলঙ্কারে তাদের রচিত কাব্যদেহ যেন ঝলমল করতে থাকে।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিদ্যাপতির হাতে একটা সামগ্রিক রূপ লাভ করেছে। পদগুলিতে প্রেমের নবােদ্ভিন্ন রূপ থেকে আরম্ভ করে তার চরম পরিণতি পর্যন্ত স্থরে স্থরে লীলা-বৈচিত্র্যের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে। প্রেম তার নিকট একটি জৈবিক বৃত্তি মাত্র নয়। লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ-আদি মানসিক বৃত্তিগুলি তার অঙ্কিত প্রেমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে বিজড়িত। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির রাধাপ্রেমকে বিশ্লেষণ করেছেন নিম্নোক্তভাবে – “বিদ্যাপতির রাধা অল্পে অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢল ঢল করিতেছে। শ্যামের সহিত দেখা হয় এবং চারিদিকে যৌবনের কম্পনে হিল্লালিত হইয়া উঠে। খানিকটা হাসি, আড়চক্ষে দৃষ্টি … আপনাকে আধখানা প্রকাশ ও আধখানা গােপন, কেবল উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা উন্মেষিত হইয়া পড়ে।” রবীন্দ্রনাথ আরাে বলেছেন, ছন্দ, সঙ্গীত এবং বিচিত্র রঙে বিদ্যাপতির পদ এমন পরিপূর্ণ, এইজন্য তাহাতে সৌন্দর্য সুখ-সম্ভোগের এমন তরঙ্গলীলা।”
বিদ্যাপতি প্রধানতঃ সম্ভোগরসের কবি ; তাঁর কাব্যে প্রেমের যে রসঘন জীবন্ত রূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা ব্যক্তিসত্তার উর্ধ্বে সার্বজনীন অনুভূতিলােকে উন্নীত হবার দাবি রাখে ফলতঃ এই কারণেই বিদ্যাপতি-বর্ণিত প্রেম একান্তভাবে বৈষ্ণবীয় না হওয়া সত্ত্বেও যেমন একদিকে বৈষ্ণবজনের প্রাণের বস্তু, অপরদিকে তেমনি এর সর্বজনীন রসাবেদন যে কোন সাধারণ পাঠককেও অভিভূত করে থাকে। যথার্থই, বিদ্যাপতি নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব ছিলেন না। পুর্বেই বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন পঞ্চোপাসক। শাক্ত বা শৈব পদেও তিনি হর-গৌরী প্রেমের বর্ণনা করেছেন অপূর্ব ভাষায়। তাছাড়া তার রাধাকৃষ্ণ প্রেমরসবর্ণনার আধার বা অবলম্বন মাত্র। রাধা বা কৃষ্ণের নাম বর্জন করে কোনাে প্রাকৃত নর-নারীর নাম সংযােজন করলেও সেই সম্ভোগরসের কোনাে হানি ঘটে না। বরং লৌকিক প্রেমের প্রকীর্ণ কবিতাবলীর সঙ্গে বিদ্যাপতির প্রেমবর্ণনার বহু সাদৃশ্য যে কোনাে সাহিত্য রসিক সহজেই আবিষ্কার করতে সমর্থ হবেন। বিদ্যাপতি যেমন সম্ভোগরস-সৃষ্টিতে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি বিরহ এবং ভাবােল্লাসের বর্ণনায়ও যেন আপনাকে আপনি অতিক্রম করেছেন। যে ভাবাবেগকে গীতিকাব্যের প্রাণ-রূপে গ্রহণ করা হয়, এখানে তার গভীরতাই বিশেষভাবে উপলব্ধিগম্য হয়ে থাকে। বিদ্যাপতির কাব্যে এই বিচিত্র ধরনের ভাবসমাবেশ ঘটেছিল বলেই মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির কাব্য থেকে অকৃপণভাবে রস-গ্রহণের সুযােগ লাভ করেছিলেন।
পরিশেষে বিদ্যাপতি বিষয়ে আর একটি কথা না বললে তার প্রতি অবিচার করা হবে। বিদ্যাপতি সাধারণভাবে রসস্ভোগ এবং ভাবােল্লাসের কবি-বুপে পরিচিত হওয়াতে তাঁর জীবনানুভূতির লঘু দিকটিই আমাদের নজরে পড়ে। কিন্তু তিনি যে পদ রচনার শেষ পর্যায়ে এসে দেহধর্মের উর্ধ্বলােকে অনির্বচনীয় শান্তরসে আশ্রিতচিত্ত হয়েছিলেন—এ সংবাদটা না জানালে বিদ্যাপতি বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর শান্তরসাশ্রিত ‘প্রার্থনা’ পদাবলী সাহিত্যকীর্তিরূপে এবং ভাবুকচিত্তে অপার্থিব রসের উদ্বোধনে পদাবলী সাহিত্যে একক ও অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। বিদ্যাপতির রচনায় সর্বত্র ঐশ্বর্যরসের প্রকাশ ঘটলেও অন্ততঃ এ জাতীয় প্রার্থনার পদগুলিতে যে আত্মদৈন্য, আত্মনিবেদন এবং ঈশ্বরভক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তা একমাত্র রসিকচূড়ামণি চণ্ডীদাসের সঙ্গেই তুলনীয়। রূপের আরাধনা করতে এক সময় বিদ্যাপতি অরূপের সন্ধান লাভ করলেন। রূপরসিক কবি সাধক চূড়ামণি পদে উন্নীত হলেন।
রাধাকৃষ্ণের প্রেম-কাহিনী-অবলম্বনে রচিত নয় বলেই প্রার্থনা পদাবলীগুলিকে যথার্থ বৈষ্ণব পদরূপে অভিহিত করা চলে না। তাই বৈষ্ণব পদে তার কৃতিত্ব-প্রসঙ্গে প্রার্থনাবহির্ভূত পদের উল্লেখ সমীচীন। ‘রসসন্ভোগ নয়, ভাবােল্লাস’ নয়, অথচ রূপ-রসের কবি বিদ্যাপতির অসাধারণ অপূর্ব প্রকাশ পেয়েছে তার রচিত ‘বিরহ বা মাথুর বিষয়ক পদগুলিতে। অলঙ্কৃত এবং অনলঙ্কত উভয় প্রকার বাক্যেই বিদ্যাপতি বিরহের চিত্র অঙ্কন করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে “বেদনারও একটা ঐশ্বর্যের দিক আছে, সেখানে সে একা নয়, বিশ্বপ্রকৃতির বিরাট পটভূমির সঙ্গে তাঁর যােগ।”
‘শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।’ -কৃষ্ণ বিরহিত জীবনের শূন্যতা যেন এখানে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যাপতির ‘ঈ ভরা বাদর/মাহ ভাদর/শূন মন্দির মাের’ পদে কৈসে গােঙায়ব হরি বিনু দিন রাতিয়ার অনলঙ্কৃত বাক্যেও কি রাধার হৃদয় বিদীর্ণ করা হাহাকার ধ্বনি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েনি?
অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর ‘বৈষ্ণব পদাবলী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “বিরহের পদে বিদ্যাপতি রাজাধিরাজ; তার কবিত্বশক্তি বিরহের পদেই যেন শ্রেষ্ঠত্বের সীমায় এসে পৌঁছেছে। পূর্ববর্তী পদগুলিতে বিদ্যাপতি যে প্রগল্ভ বাচাতুর্য, মার্জিত রুচি বৈদগ্ধ্য, নাগরবিলাসের পরিচয় দিয়েছেন শ্রীমতী রাধিকার আচার-আচরণে, সেই রাধিকাই বিরহ পর্যায়ে যে প্রেমের গভীরতায় নিমজ্জিত হলেন, তাতে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি না থাকলেও কবির মনােভঙ্গিতে যে একটা মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই।”
বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বন করেই পদ রচনা করেছেন। বিশ্লেষণে এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও দুটি স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম স্তরে মনে হয় সৌন্দর্য সাধনাই ছিল কবির ঈঙ্গিত। এই স্তরে পড়ছে বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ ও অভিসার পর্যায়ের পদ। বয়ঃসন্ধি এবং পূর্বরাগের রাধা বাস্তব, অভিসারে যেন বাস্তবাতীতের ছায়াপাত ঘটেছে। পরবর্তী স্তরে-বিরহে এবং ভাবােল্লাসের পদে বিদ্যাপতি যেন স্বধর্মকে অতিক্রম করে একটা মানসলােকে উত্তীর্ণ হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাই বিদ্যাপতিকে সম্ভোগের বিপরীত জগৎটি সম্বন্ধেও গাঢ়ভাবে পরিচিত করেছিল বলে মনে হয়।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণগুলি সাজালে দাঁড়ায় :
(১) তৎকালীন মিথিলা ও বাংলার মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য বর্তমান ছিল। (২) তৎকালীন মিথিলা ও বাংলা উভয়েই ছিল সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান, সে কারণে মিথিলার ছাত্র বাংলায় এবং বাংলার ছাত্র মিথিলায় গমনাগমন করতেন। ফলে উভয় দেশের মধ্যে একটি আত্মিক যোগ গড়ে ওঠে। (৩) শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলী আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভ করতেন। (৪) চৈতন্য যুগে বৈশ্বব সাধক ও রসঙ্গণ বিদ্যাপতি পদাবলীর রস আস্বাদন করতেন। (৫) বাঙালি কবি বিশেষ করে গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতিকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে পদ রচনা করেন এ কারণে গোবিন্দদাস ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। বস্তুত বাংলা দেশে বিদ্যাপতি পদাবলীর নবজন্ম হয়েছে।
বিদ্যাপতির সঙ্গে বাঙালির চারশ বছরের সম্পর্ক। কৌতুক করে সমালোচক দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন- আমরা “বিদ্যাপতির কুর্তা পাগড়ী খুলিয়া ধুতি চাদর পরাইয়াছি।” কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মৈথিলি কবি হিসাবে বিদ্যাপতির কবি কর্মের আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন নেই। যে বিদ্যাপতি বাঙালির জীবনে জড়িত হয়ে গেছেন তাঁর সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যের একান্ত আত্মীয়তা। সুতরাং পদ সংকলন গ্রন্থে যেভাবে ও যে ভাষায় তাঁকে পেয়েছি সেই বিদ্যাপতি আমাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন, যাঁর পদাবলী বৈষ্ণব পদ সাহিত্যকে প্রভাবিত এবং মহাজনদের মুদ্ধ করেছিল, যাঁর গান বাংলাদেশে প্রচারিত না হলে ব্রজবুলি পদ সাহিত্য এত ঐশ্বর্যবান হতে পারত কিনা সন্দেহ, তাঁকেই আমাদের প্রয়োজন। অসিতবাবুর ভাষায়— “বিদ্যাপতির পদের যেটুকু ব্রজবুলির মধ্য দিয়ে চোলাই হয়ে এসে বাঙালীকে মুগ্ধ করেছে, সুখে, দুঃখে উদ্বেল করেছে, শুধু সেটুকুতেই আমাদের অধিকার। তাঁর আসল পদ নিয়ে মিথিলা বাসীরা সন্তুষ্ট থাকুন, আমরা বরং ধুতিচাদর পরিহিত বিদ্যাপতিকে আত্মার আত্মীয় বলে গ্রহণ করে ধন্য হই।”
সর্বশেষ, বিদ্যাপতির অপর একটি কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন। বিভিন্ন পর্যায়ে রস সৃষ্টি করতে গিয়ে বিদ্যাপতি এমন কিছু বাক্য রচনা করেছে, যেগুলি প্রবচন বা প্রৌঢ়োক্তির মর্যাদা লাভ করতে পারে।
ব্রজবুলি: বাঙালীর প্রথম ব্রজবুলি ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটে বিদ্যাপতি-রচিত পদের মাধ্যমে। তৎকালীন বাঙালীর নিকট বিদ্যাপতিও বাঙালীবৃপেই পরিচিত ছিলেন—যে অপরিচিত ভাষায় বিদ্যাপতি পদ রচনা করেছিলেন, তাকে বাঙালীরা বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনের ভাষা বলে মনে করে, একে ‘ব্রজবুলি’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। ‘ব্রজবুলি’ শব্দটির ব্যবহার বাঙলা ভাষায় খুব প্রাচীন নয়—সম্ভবতঃ উনিশ শতকে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই সর্বপ্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন। ব্রজ-সম্বন্ধীয় এই অর্থে ব্রজাওলি থেকে এর উৎপত্তি ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়। যখন প্রমাণিত হলাে যে এর ভাষা ব্রজভূমির নয়, তখন অনুমান করা হয় যে, ব্রজবুলির মূল ভিত্তি কবি বিদ্যাপতির মাতৃভাষা মৈথিলি এর সঙ্গ কালক্রমে হিন্দী-বাঙলা-আদি শব্দের অবহট্ঠজাত একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা—অবশ্যই আঞ্চলিকতার প্রভাব এতে বর্তমান।
বিদ্যাপতিরও পূর্ববর্তী মিথিলার কবি উমাপতি সম্ভবতঃ ব্রজবুলির প্রথম রূপকার। প্রায় সমসময়ে অথবা সামান্য পরেই যে এই ব্রজবুলি ভাষা সমগ্র পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাঙলায় ব্রজবুলির প্রথম রূপকার চৈতন্যসমকালীন কবি যশােরাজ খান। তার রচিত পদ এ পয়ােধর চন্দনে লেপিত। আরে সহজই গাের। উড়িষ্যার রায় রামানন্দ রচিত ‘পহিলহি রাগ নয়ন ভঙ্গ ভেল।’ পদটি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত প্রথম পদ। আসামে শঙ্করদেব এবং ত্রিপুরার রাজপণ্ডিত জ্ঞান প্রথম ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন, জানা যায়।
বাঙলাদেশে বহু কবিই ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বোত্তম গােবিন্দদাস কবিরাজ এবং সর্বশেষে বাঙলা ভাষার সর্বোত্তম কবি রবীন্দ্রনাথ—যিনি ‘ভানুসিংহ ঠাকুর’ ছদ্মনামে প্রথম জীবনে কয়েকটি পদ রচনা করেছিলেন।
Leave a comment