ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদ-রচয়িতা বাঙালী কবিদের মধ্যে গােবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব একবাক্যে স্বীকৃত হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে কবিদের নামসাদৃশ্য এত বেশি লক্ষ্য করা যায় যে কোন নির্দিষ্ট কবিকে পৃথকরূপে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বৈষ্ণব কবিতার ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস এবং জ্ঞানদাসকে নিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, গােবিন্দদাসকে নিয়েও আমাদের অনুরূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু যােড়শ শতাব্দীতেই ‘গােবিন্দ’ নামধারী অন্তত ৪ জন বৈষ্ণব কবির সন্ধান পাওয়া যায়। চৈতন্যপার্যদ- গােষ্ঠীর অন্তর্গত গেবিন্দ আচার্য এবং গােবিন্দ ঘােষও পদ রচনা করতেন। এ ছাড়া ছিলেন গােবিন্দদাস কবিরাজ যিনি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনার সামর্থে বিদ্যাপতির সমকক্ষতা দাবী করতে পারেন। ‘গােবিন্দদাস’ ভনিতায় বাঙলা ভাষায় পদ পাওয়া যায়—এদের সঙ্গে গােবিন্দদাস কবিরাজের কোন সম্পর্ক আছে কিনা জানা সম্ভব নয়। এই চারজন গােবিন্দদাসের রচনার জট পাকিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়—কোন এক গােবিন্দদাসের সমস্ত রচনা সুনির্দিষ্টভাবে অপর সকল গােবিন্দদাসের রচনা থেকে পৃথক করে নেওয়া বােধ হয় এখন অসম্ভবই।

সম্ভবতঃ ১৫৭৭ খ্রীঃ বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ড গ্রামে মাতামহ ‘সঙ্গীত দামােদর গ্রন্থ-প্রণেতা দামােদর-গৃহে গােবিন্দদাস কবিরাজের জন্ম হয়। তার পিতার নাম চিরঞ্জীব, মাতা সুনন্দা। প্রথম জীবনে কবি শাক্ত মাতামহের প্রভাবাধীন থাকলেও পরে দেবীর স্বপ্নাদেশেই শ্রীনিবাস আচার্যের নিকট বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। যােড়শ শতকের শেষদিকে খেতরীর মহােসবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। বৃন্দাবনের শ্রীজীব গােস্বামী তাকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সম্ভবতঃ ১৬১৩ খ্রীঃ কবিরাজ গােবিন্দদাস দেহত্যাগ করেন।

বিদ্যাপতির অনুগামী গােবিন্দদাস শুধু ব্রজবুলি ভাষারই শ্রেষ্ঠ পদ-রচয়িতা নন, ভাবের দিক থেকেও বিদ্যাপতির সঙ্গে তার সাদৃশ্যহেতু তাকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্যরূপে অভিহিত করা হয়।

মিথিলার কবি বিদ্যাপতির রচনার ভাষা ও ভাবের সঙ্গে গােবিন্দদাসের রচনার ভাষা ও ভাবের সাদৃশ্যহেতুই যে বাইরের সমালােচকরা গােবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলে প্রচার করে থাকেন, তা নয়, স্বয়ং গােবিন্দদাসও অতিশয় সজ্ঞানেই বিদ্যাপতির অনুসরণ করতেন। বেশ কয়েকটি পদে বিদ্যাপতির সঙ্গে গােবিন্দদাসেরও ভণিতা পাওয়া যায়। পদামৃত-সমুদ্র’ নামক প্রাচীন বৈষ্ণব পদাবলী সঙ্কলনের সঙ্কলয়িতা রাধামােহন ঠাকুর এ থেকে অনুমান করেছিলেন যে বিদ্যাপতির অসম্পূর্ণ পদগুলির পূর্ণতা সাধন করেছিলেন বলেই কবি গােবিন্দদাস তাতে যুগ্ম ভণিতা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ডঃ সুকুমার সেন এই অনুমানের যৌক্তিকতায় আস্থা স্থাপন করতে না পেরে স্বয়ং অনুমান করেন, “গােবিন্দদাস কতকগুলি পদ বিদ্যাপতির পদের প্রত্যুত্তর-স্বরূপ রচনা করিয়াছিলেন এবং সেইগুলিতে তিনি বিদ্যাপতির নাম করিয়া গিয়াছেন।”

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে শ্রীখণ্ডের কবি কবিরঞ্জন ছিলেন বিদ্যাপতি উপাধিধারী। তাকে সাধারণতঃ ছােট বিদ্যাপতি’ নামে অভিহিত করা হয়। এর ব্রজবুলি ভাষায় রচিত বহু পদই বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত রয়েছে।

‘গােবিন্দদাস’ ভণিতাযুক্ত বাঙলা ভাষায় রচিত যে সকল পদ পাওয়া যায়, সেগুলি গােবিন্দদাস চক্রবর্তীর রচনা ধরে নিয়ে শুধু ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদগুলির কর্তৃত্বই গােবিন্দদাস কবিরাজকে দেওয়া হয়। এ জাতীয় পদ-নির্বাচন বিজ্ঞানসম্মত না হওয়া সত্ত্বেও এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই আনুমানিক নির্বাচনের ভিত্তিতেই গােবিন্দদাসের পদগুলি বিচার করে সাহিত্য-সমালােচকগণ গােবিন্দদাস কবিরাজকে চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ পদকর্তার মর্যাদা দান করে থাকেন। গােবিন্দদাস ব্রজবুলি ভাষায় যে সকল পদ রচনা করেছেন তাদের ভাষা অবিমিশ্র ব্রজবুলি ; অন্য অনেকের রচনার মতাে তার রচনায় বাঙলা ভাষার মিশ্রণ ঘটেনি। গােবিন্দদাস তদ্ভব শব্দের ব্যবহার করেছেন অপেক্ষাকৃত কম—তৎসম এবং অর্ধতৎসম শব্দের সংখ্যাই তাঁর রচনায় অনেক বেশি।

কবিতার আঙ্গিক তথা বহিরঙ্গের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, সমালােচকগণ গােবিন্দদাস কবিরাজকে বৃথাই শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা দান করেন নি। ভাষায় ছন্দে ও অলঙ্কার ব্যবহারে গােবিন্দদাস অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভাষার স্থাপত্যশিল্পে গােবিন্দদাসের দক্ষতা অতুলনীয়। পদের লালিত্য, ছন্দের ঝঙ্কার ও অলঙ্কারের সুষ্ঠু প্রয়ােগে বিদ্যাপতি-শিষ্য গােবিন্দদাস স্বীয় গুরু বিদ্যাপতির সার্থক উত্তরসূরী। তাঁর রচনার প্রধান গুণ যে শুতিমাধুর্য, তা’ কবি নিজেও উল্লেখ করেছেন

রসনা রােচন শ্রবণ বিলাস।

রচই রুচির পদ গােবিন্দদাস ॥

গােবিন্দদাসের পদ বিচার করে ডঃ সেন মন্তব্য করেছেন, “ইহার লেখায় ছন্দের বৈচিত্র্য যথেষ্ট আছে। অনুপ্রাসের ও উপমা রূপকাদি অর্থালঙ্কারের প্রয়ােগ কবিরাজের মত আর কোন পদকর্তাই করিতে পারেন নাই। শব্দের ঝঙ্কারে এবং পদের লালিত্যে গােবিন্দদাস কবিরাজের গীতিকবিতাগুলি বাঙলা সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”

গােবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্য রসিক রূপ-দক্ষ কবি। যে ধরনের পদ বিলাস-বিভ্রম-সৃষ্টির অনুকূল, কবি সাধারণতঃ ঐ ধরনের পদ রচনায়ই বিশেষ আগ্রহ এবং অধিকারবােধের পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর অভিমত উদ্ধারযােগ্য। তিনি বলেন “সংযম বুদ্ধির ফলে গােবিন্দদাসের কাব্যে যে বিশেষ বস্তুটির আবির্ভাব ঘটেছে, তাকে কাব্যে স্থাপত্যবিদ্যা বলা চলে। তার অধিকাংশ পদ যেন কুঁদে তৈরী কুন্দে যেন নিরমাণ’। প্রতিভার আলােড়নক্ষণে অর্ধবাহ্যদশায় আত্মসংবিতের বিলয় মুহূর্তে প্রেরণার হাত ধরে কবি তাঁর কাব্য সৃষ্টি করেন নি। তার কবিভাবনা কাব্যের সব কটি প্রয়ােজনীয় বস্তুর সমাবেশ করে অপরিসীম রসবােধ ও তীক্ষ্ণ শিল্পদৃষ্টির সহায়ে একটির পর একটি পদ রচনা, করে গিয়েছেন। ফলে … কাব্যের রূপসম্পূর্ণ যাকে বলে, সেই finish-এর অসৌন্দর্য কোথাও ঘটে নি।”

গােবিন্দদাসের সৌন্দর্যপ্রীতি ছিল অসাধারণ। তার রাধিকাকে তিনি তিল তিল সৌন্দর্যের সমাহারে তিলােত্তমা করে তুলেছেন ; এ রাধা যেন মর্ত্যলােকের কোন নারী নয়, গােবিন্দদাসের কল্পলােকেই তার আশ্রয়ভূমি। গােবিন্দদাসের কাব্যসাধনার মূলে যে রূপাসক্তি, তারই জন্য তিনি কখনও রূপের প্রতি যত্নহীন হতে পারেন নি।

ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কারের বাইরে গােবিন্দদাসের রচনার আর একটি বড় গুণ-সঙ্গীতময়তা। এখানে তিনি বিদ্যাপতির শিষ্য নন, তিনি বৈষ্ণব কবিতার আদি পুরুষ জয়দেব গােস্বামীর কাছ থেকেই যেন সুরের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে। কোন কোন বিদগ্ধ সমালােচক মনে করেন, সূক্ষ সঙ্গীতবােধ তথা কাব্যের সুর-চেতনা একান্তভাবেই বাঙালীর নিজস্ব, ভারতের অন্যত্র এ বস্তু সহজপ্রাপ্য নয়।

গােবিন্দদাসের রচনার আরও বিশেষ গুণ-নাটকীয়তা ও চিত্রধর্মিতা। বিভিন্ন পর্যায়ের যে সমস্ত পদে গােবিন্দদাসের কৃতিত্ব সন্দেহাতীত, সে সমস্ত পদেই এই দটি গুণের কোন একটির উপস্থিতি অবশ্যই লক্ষ্য করা যায়, কখন কখন এদের যুগপৎ উপস্থিতি কাব্যসৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।

এই সমস্ত গুণাবলীর কারণে গােবিন্দদাসের পদগুলি বাঙলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং সর্বকালের কবিদের মধ্যে গােবিন্দদাসের স্থানও উচ্ছেই অবস্থিত।

গােবিন্দদাস যদিও কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন, তাদের সবকিছু কিন্তু সমান রসােত্তীর্ণ হয়নি। কবি যেখানে চিত্র রচনার সুযােগ পেয়েছেন, সেখানেই তার সার্থকতা ; হৃদয়ের আর্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে কবি নিজেকে যথােপযুক্তভাবে প্রকাশ করে উঠতে পারেন নি।

গৌরচন্দ্রিকার পদে গােবিন্দদাসের কৃতিত্ব অপর সকল কবির প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দেয়। এ বিষয়ে জনৈক সমালােচক বলেন, “গােবিন্দদাসের গৌরচন্দ্র-বিষয়ক পদাবলীতে ভক্তি অপেক্ষা কবি-আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত বূপসার্থকতাই বড় হয়ে উঠেছে। ধর্মবােধ পরিপূর্ণ বিশ্বাস তার এই বিষয়ক পদাবলীতে প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে চৈতন্যের ব্যক্তিমহিমা সমুন্নীত মনােমুগ্ধকর রূপের পরিচয় মেলে।”

মূলতঃ চিত্ররসের কবি বলেই গােবিন্দদাস রূপানুরাগের কবিতায় অতুলনীয় শিল্পচাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তবে রাধার দৃষ্টিতে কৃষ্ণের বিচিত্র রূপের মতাে কৃষ্ণের দৃষ্টিতে রাধার তেমন রূপ ফুটে উঠবার অবকাশ পায়নি। কবি গােবিন্দদাস অবশ্যই সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন অভিসার-পর্যায়ের বৈচিত্র্যসৃষ্টিতে। “কবি গােবিন্দদাসের দৃষ্টিতে প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য যথার্থভাবেই ধরা পড়েছিল বলেই তিনি রাধার চিত্ররচনায় প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন, তার অভিসারের পদগুলি এই কারণেই রসােত্তীর্ণ হয়ে উঠবার সুযােগ পেয়েছে।” (বৈষ্ণব পদাবলী ঃ পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য)। বিরহ ও প্রেমবৈচিত্ত্য সৃষ্টিতে কবি গােবিন্দদাস তার প্রতিভার যথােপযুক্ত পরিচয় দিতে পারেন নি- এইখানেই তার ব্যর্থতা।