কবিওয়ালাদের আবির্ভাব: বাঙলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটেছে, অথচ আধুনিক যুগের উদ্বোধন ঘটেনি, এমন একটা যুগসন্ধিকালে বাঙলার সাহিত্য-প্রাঙ্গণকে মুখর করে রেখেছিল ‘কবিগান’—যাঁরা এই গান গাইতেন ও রচনা করতেন, তাদের বলা হতাে কবি নয়—কবিওয়ালা’। কবিওয়ালা শব্দটার সঙ্গে যে কিছুটা সন্ত্রমহীনতা যুক্ত রয়েছে, তারও কারণ আছে। কবিগানের উদ্ভব যুগটা ছিল সবদিক থেকে দেশ ও জাতির জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের বিশ্বাসভাজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হয়েছে এবং কার্যতঃ দেশের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছে এক বণি কোম্পানীর উপর। সামাজিক ঐতিহ্য ও মর্যাদাবিহীন তাবেদাররাই সমাজজীবনে প্রভুত্ব বিস্তার করে চলেছে। এই সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটে কবিওয়ালাদের। এদের আবির্ভাব যেমন আকস্মিক, তিরােভাবও তেমনি। রবীন্দ্রনাথ এদের গােধূলিমুহূর্তে অকস্মাৎ-দৃষ্ট সপক্ষ পতঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিক্ষা-সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিকৃতরুচি অথচ অর্থবান এক তাবেদার গােষ্ঠীর তুষ্টিসাধনে তৎপর এই কবিওয়ালারা শিক্ষাদীক্ষায় বিশেষ অগ্রসর না হলেও এদের দুটি বিশেষ গুণ ছিল—
-
পদ্য রচনায় অশিক্ষিত পটুত্ব,
-
উপস্থিতবুদ্ধি।
কবিগানের বিবরণ: সাধারণতঃ আসরে দুটি কবির দল উপস্থিত থাকে। গানে এবং ছড়ায় এরা প্রায় প্রশ্নোত্তরের আসর জমিয়ে রাখেন। দেবতার বন্দনা এবং পুরাণ প্রসঙ্গ নিয়েই সাধারণতঃ আসর আরম্ভ হয়। শেষ পর্যন্ত অশ্লীলতার মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবিগানের একটি জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। দু’দলে প্রথমে ঠাকুর-দেবতার গান দিয়ে শুরু করতেন, ক্রমে রাত বাড়ত, চাদোয়ার তলে রেড়ীর তেলের প্রদীপ-শিখা স্নান হয়ে আসত, কবিওয়লাদের সুর দুন থেকে চৌদুনে পৌছাত, ঠাকুর-দেবতাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে তখন তারা নিজ মূর্তি ধারণ করতেন, সরস্বতীপ্রদত্ত যৎকিঞ্চিৎ শক্তিকে চরম অশ্লীল ও অশিষ্টতায় ব্যবহার করতেন। শ্রোতাদের নেশা লেগে যেত, চূড়ান্ত অশ্লীল জায়গায় এসে ঢােল-কাসি তারস্বরে চীৎকার করে উঠত, পৃষ্ঠপােষক ধনী-ভূস্বামী বাহবা দিয়ে জয়ী পক্ষকে প্রচুর খেলাত দিতেন। শাল-দোশালার তাে কথাই নেই, দরিদ্র কবিওয়ালাদের ভাগ্যে বহু টাকাকড়িও জুটে যেত। প্রতিভায় এঁরা যে স্তরেরই হােক না কেন, উপস্থিত বুদ্ধি, পুরাণের জ্ঞান, ভাষা, ছন্দ ও সঙ্গীতে অসাধারণ দখলের জন্য এরা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণের যােগ্য।
-
কবিগান: কবিগানের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গেলে একে জনসাহিত্য না বলে উপায় নেই। উঠতি বড়লােক বা ভূস্বামীরা এর পৃষ্ঠপােষক হলেও আপামর জনসাধারণই ছিল এর শ্রোতা এবং রসভােক্তা। এই জনসাহিত্য কবিগানের সঙ্গে প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আরাে কিছু এ জাতীয় গান। অনেকে মনে করেন ‘মালসী’ বা ‘উমাসঙ্গীত’ অর্থাৎ ‘আগমনী-বিজয়া’ও মূলত কবিগান এবং এগুলি কবিগানের পূর্ব অঙ্গ আর খেউড়’ গান কবিগানের পশ্চাৎ অঙ্গ। অর্থাৎ উমাসঙ্গীত দিয়ে কবিগানের আরম্ভ, আর খেউড়ে তার সমাপ্তি। প্রারম্ভে দেবতার কথা, সমাপ্তিতে অশ্লীলতার চূড়ান্ত। যাত্রা, তরজা, পাঁচালী প্রভৃতি কবিগানেরই রূপ।
উমাসঙ্গীত মালসী বা ভবানী-বিষয়ক গানের স্রষ্টা সাধক কবি রামপ্রসাদ হলেও রাম বসু প্রভৃতি কবিওয়ালারাই এর প্রধান পােষ্টা। কবিওয়ালাদের রচনা হলেও এতে কবিগানের উত্তেজনা নেইবরং একে বলা চলে সামাজিক জীবনের বিষাদ সঙ্গীত। পুরাণে উমাসঙ্গীতের সঙ্গে দুর্গাপূজার কোন সম্পর্ক না থাকলেও বাঙালী কবির কল্পনা এদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপন করেছে। এগুলি শ্যামাসঙ্গীতের মতাে সাধন-সঙ্গীত নয়, এতে কোন গুঢ় ইঙ্গিতও নেই, এই সঙ্গীতগুলিতে একপ্রকার মধুর রসাত্মক বাৎসল্য রসের আস্বাদন লাভ করা যায়।
-
যাত্রা: এই জনসাহিত্য ধারায় সর্বাধিক জনপ্রিয়তা যাত্রাগানের। উন্মুক্ত মঞ্চে অভিনীত এই নাটগীতে থাকে সঙ্গীতেরই প্রাধান্যএইদিক থেকে এগুলি ‘অপেরা’-গােত্রীয়। কৃষ্ণলীলা বা কালীয়দমন, রামলীলা এবং বিদ্যাসুন্দর পালা ছিল প্রধানতঃ যাত্রার বিষয়। প্রাচীন যাত্রায়ও ছিল উমাসঙ্গীতের মতাে গান-এমন কি উক্তি-প্রত্যুক্তিও ছিল গদ্যে রচিত। অবশ্য যাত্রাগানের রঙ্গ-তামাসাও যথেষ্ট ছিল-কালুয়া-ভুলুয়া, কেশাে-বেশাে, মেথর-মেথরাণী সেজে নাচগান করার প্রথা প্রচলিত ছিল। শতবর্ষ পূর্বে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন- “এক্ষণকার যাত্রায় নৃত্যই করে। কি মেহতর, কি ভিত্তি, কি মালিনী, কি বিদ্যা সকলেই নৃত্য করে।..বাঙ্গালা এক্ষণে নূতন। বাঙালা এক্ষণে বালক। সেইজন্য এত নৃত্য।”
-
পাঁচালী: জনসাহিত্যগােষ্ঠীর মধ্যে পাচালীই সর্বাধিক পরিণতি লাভ করেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, রামায়ণ-মহাভারত প্রভৃতিও পাঁচালী নামে পরিচিত হলেও এই অর্বাচীন পাঁচালী কিন্তু সেরূপ বৃহদায়তন নয়। এগুলিতে ক্ষুদ্রাকার উপকাহিনীর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, যেমন- শাক্ত বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব, বিধবা-বিবাহ, নলিনী-ভ্ৰমরােক্তি প্রভৃতি। পাঁচালী গানে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার হালচাল, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি প্রভৃতি বিষয়ে শ্লেষাত্মক রঙ্গরসিকতা আধুনিকতারই পরিচায়ক। আবার কোন কোন পাঁচালী গানে যুক্তিসিদ্ধ ভক্তিবাদেরও অভাব নেই।
-
টপ্পা: জনসাহিত্য শাখার অপর একটি পুষ্ট ধারা ‘টপ্লাগান’। টপ্পাগান ছিল একজাতীয় হাল্কা চালের মার্গসঙ্গীত। হিন্দী টপ্পার উদ্ভাবনার সঙ্গে লক্ষ্ণৌ-এর নাম জড়িত রয়েছে। সেই হিন্দী টপ্পা ভেঙেই বাঙলা টপ্পা প্রবর্তন করা হয়। এই টপ্পার উপাদান বিশুদ্ধ মানবীয় প্রণয়, অবশ্য টপ্পার ঢঙে ভক্তিমূলক গানের রীতিও প্রচলিত ছিল। টপ্লাগানের বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, একদা এই টপ্পা গানের খুব কদর ছিল। প্রথমতঃ এই সমস্ত গানে বিশেষ কোন সুরুচিপূর্ণ ব্যাপার থাকত না, দ্বিতীয়তঃ এর প্রণয়ঘটিত বর্ণনাও আবেগ-বিশিষ্ট লিরিকের পূর্বাভাস বলে গৃহীত হয়েছিল। তৃতীয়তঃ এতে মাের্গরীতি ও নানাপ্রকার বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতে বলে, ঈষৎ অভিজাত শ্রেণী ও মার্জিতরুচির বিলাসী-সম্প্রদায় এর খুব অনুরাগী ছিলেন। আখড়াই গানে বিশুদ্ধ রাগিণী, তালমান অনুসৃত হত, মার্গরীতি পদে পদে অনুসরণ করা হত, নানাপ্রকার জটিল বাদ্যযন্ত্রের কৌশলও এ গানকে বড়ই দুঃসাধ্য করে তুলেছিল। তখন এই আখড়াই গানকে কিছু সহজসাধ্য করে, মা্গরীতিকে কিছু লঘুচপল করে এবং বাদ্যযন্ত্রের সমারােহ কমিয়ে ফেলে হাফ আখড়াই গানের উৎপত্তি হল। যাঁরা হাফ আখড়াই গানের পৃষ্ঠপােষক ও উহার ভক্ত ছিলেন তারাই টপ্লাগানের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিলেন।
কবিওয়ালা- বাঙলা ভাষায় কে প্রথম কবিগান রচনা করেন, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা না গেলেও অনেকেই অনুমান করেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে আবির্ভূত গোঁজলা গুই ই সম্ভবতঃ আদি কবিওয়ালা। আসরে উপস্থিত দুই কবিওয়ালা যে মুখােমুখী দাঁড়িয়ে কবিতার লড়াই করতেন, এই কবির লড়াই বা ‘লহরে’র প্রবর্তক সম্ভবতঃ ‘রঘুনাথ দাস’। শােভাবাজারের নবকৃষ্ণের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন ‘হরঠাকুর’ বা হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী (১৭৩৮-১৮১২ খ্রীঃ)। ইনি সমস্যাপূরণে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবিওয়ালাদের মধ্যে রাম বসু একটি বিশিষ্ট নাম। তার রচিত ‘সখী-সংবাদ’ এবং ‘বিরহ সঙ্গীত’ অনেকের উচ্চ প্রশংসা অর্জন করেছে। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, “রাম বসুর ‘বিরহে’ বঙ্গবন্ধুর প্রেমপূর্ণ সলাজ হৃদয়টি অঙ্কিত হয়েছে।” ‘মালসী’ বা আগমনী-সঙ্গীত রচনাতেও রাম বসু যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অনেকে মনে করেন যে রাম বসুর গানে আধুনিক মন ও গীতিমূর্ছনার আবেশ বর্তমান রয়েছে। তবে গানে অনুপ্রাস-যমকাদির অতিশয়িত ব্যবহার কখনও কখনও রাম বসুর রচনাকে বিরক্তির পর্যায়েও তুলে দিয়েছে। যেমন—
গেল গেল কুল কুল, যাক কুল, তাতে নই আকুল,
লয়েছি যাহার মূল সে আমারে প্রতিকূল।
যদি কুলকুণ্ডলিনী অনুকুলা হন আমায়
অকূলের তরী কূল পাবে পুনরায়।
রবীন্দ্রনাথের মতেও এখানে কুলের কুল পাওয়া দুষ্কর। কবিগানের একজন প্রসিদ্ধ শিল্পী ‘ভােলা ময়রা’। ভােলা ময়রার সঙ্গে আন্টনি ফিরিঙ্গির বাগযুদ্ধ প্রায় ইতিহাসের মর্যাদা লাভ করেছে। ভােলা ময়রা ছিলেন বাগ্বাজারের বাসিন্দা, আন্টনি ফিরিঙ্গির জন্মস্থান পর্তুগাল। ‘ঠাকুর সিংহ’ নামক এক কবিয়ালের প্রশ্নের জবাবে আন্টনি ফিরিঙ্গি বলেছিলেন—
এই বাংলায় বাঙালীর বেশে আনন্দে আছি;
হয়ে ঠাকরে সিং-এর বাপের জামাই কুর্তি টুপি ছেড়েছি।
তিনি বাঙ্গালী পােষাক পরতেন, বাঙালী রমণীকে বিয়ে করেছিলেন এবং কালী প্রতিষ্ঠ করেছিলেন। ভােলা ময়রার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল অসাধারণ। কিন্তু তিনি কবির লড়াইয়ে অশ্লীলতার আমদানি করে অতিশয় কুরুচির পরিচয় দান করেন। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, “ভােলার যে সকল গান প্রসিদ্ধ, আন্টনি সাহেব অথবা অন্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে কুরুচিপূর্ণ গালাগালি। ভােলার নির্ভীকতার কিংবা প্রগৰ্ভতার সীমা ছিল না; দেশের বড় বড় ভূস্বামীদের সম্মুখে অম্লানবদনে নিঃসঙ্কোচে ভােলা অশ্লীল খেউড়ের সহিত এবং প্রয়ােজন হইলে তাহাদিগকেও দুকথা শুনাইয়া দিত।”
যাত্রাওয়ালা- যে সকল যাত্রাওয়ালা যাত্রাগান লিখে বা যাত্রার দল করে তৎকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের একজন গোপাল উড়ে। ইনি উড়িষ্যাবাসী হয়েও বাঙলা গান-রচনায় যথেষ্ট পটুত্ব দেখিয়েছেন। তার ‘বিদ্যাসুন্দর পালা এবং হীরামালিনী রূপে তার ব্যক্তিগত অভিনয় সেকালে যথেষ্ট উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। উনিশ শতকের প্রথম দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘কৃষ্ণগােপাল গােস্বামী’। এর ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘রাই উন্মাদিনী’ প্রভৃতি কৃষ্ণযাত্রার পালাগান এককালে যেন দিগ্বিজয় করেছিল। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি হিসাবে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পরেই নাকি তার স্থান, কিন্তু একালের সমালােচকগণ তাকে এতটা সম্মান দিতে রাজি নন। তৎকালে যাত্রাওয়ালাদের অনেকেই ছিলেন ‘অধিকারী’ পদবীধারী। এঁদের মধ্যে আছেন— ‘কৃষ্ণযাত্রা’র প্রথম যুগে লােচনদাস অধিকারী, পরমানন্দ অধিকারী, শ্রীদাম দাস ও সুবল দাস। কৃষ্ণনগরের গােবিন্দ অধিকারী, কাটোয়ার পীতাম্বর অধিকারী এবং ঢাকার কালাচাদ পালও কৃষ্ণযাত্রায় বেশ নাম করেছিলেন। রামযাত্রায় পাতাইহাটের প্রেমচাঁদ অধিকারী, আনন্দ অধিকারী এবং জয়চাদ অধিকারী উল্লেখযােগ্য।
পাঁচালীকার- পাঁচালীকারদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ নাম দাশরথি রায় বা দাশু রায় তিনি পাঁচালী রচনা করে সমকালে জনমানসে যে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, তাকে এককথায় অতুলনীয় বলা চলে। সমকালে তিনি শুধু সাধারণ লােককেই মুগ্ধ করে রাখেন নি, বিশিষ্ট নৈয়ায়িক পণ্ডিতগণ পর্যন্ত তার গুণবত্তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সাময়িক জীবন-সত্য এবং সাময়িক সমস্যাকে দাশু রায় তাঁর পাঁচালীর বিষয় করে নিয়েছিলেন বলেই তিনি সমকালে যেমন প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন তেমনি কালাতিক্রমে তিনি হলেন উপেক্ষিত। তিনি শুধু যুগের দাবিকেই মেটাতে পেরেছিলেন, যুগকে অতিক্রম করে যেতে পারেন নি। এ ছাড়াও তিনি সভার মনােরঞ্জনেই সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন, প্রতিভার যথার্থ ব্যবহারে স্থায়ী কীর্তি অর্জনে সচেষ্ট হন নি বলেই দাশু রায় অকৃত্রিম ও অবিমিশ্র বাঙলা ভাষায় এবং বাঙালী মনােভাবের সর্বশেষ কবি হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরবর্তী কালের বাঙলা সাহিত্যে প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেলেন। দাশরথি রায়ের প্রতিভার বিচার বিশ্লেষণ করে ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন “ইনি ইংরেজ-পূর্ব আধুনিক যুগের যুগন্ধর কবি। এই যুগের সমস্ত কবির সমগ্র শক্তির কেন্দ্রীভূত বিগ্রহ দাশরথি। তাহার প্রাণশক্তি বিপুল, রচনাশক্তি অসামান্য।..কেবল প্রাচুর্যে নহে, ঐশ্বর্যেও দাশরথির কবি-প্রতিভা অসামান্য। একদিকে প্রাচীন পদাবলীর মতাে ভাবােদ্দীপদ গানে এবং মঙ্গলকাব্যের মতাে নানা জ্ঞাতব্য বস্তুতালিকায়, অপরদিকে অর্বাচীন তর্জার বাগবিতণ্ডায় কবিগানের রসকলহে, যাত্রার অভিনয়ে, খেউড়ের কৌতুকে তিনি পাচালীকে করিয়া তুলিয়াছেন সম্পূর্ণ ঐশ্বর্যময়। দাশরথির পাঁচালীতে ভক্তের ভক্তি, সমাজসেবীর লােকশিক্ষা, সংস্কারকের সমালােচনা, বিদুষকের রঙ্গকৌতুক এবং সভাসদের বাগবৈদগ্ষ্য একত্র দেখা যায়।”
পাঁচালীকারদের মধ্যে অপর উল্লেখযােগ্য নাম ‘মধুকান’ বা ‘মধুসূদন কিন্নর’। তিনি ‘ঢপ’ পাঁচালীর প্রবর্তক—ঢপ পাঁচালীর ভাষণ অংশ গদ্যে রচিত হয়ে থাকে।
টপ্পাওয়ালা- বাঙলায় টপ্লাগানের প্রবর্তক ‘নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত। ১৭৪১ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করলেও দীর্ঘজীবী, নিধুবাবু ১৮৩৭ খ্রীঃ পর্যন্ত বর্তমান ছিলেন। নিধুবাবুর টপ্পা গানে মাঝে মাঝে রাধাকৃষ্ণের নাম উল্লেখ করা হলেও আসলে এগুলি একেবারেই secular বা মানবীয় প্রেমের দৃষ্টান্ত। এগুলি গান করা হতাে। বলে এর ভাষা এবং ছন্দে ততােটা মনােযােগ দেওয়া হয়নি, নতুবা বিষয়বস্তু এবং মনােভাবের দিক্ থেকে টগ্লাগানগুলি খাঁটি গীতিকবিতা হায়ে উঠতে পারতাে। নিধুবাবুর টপ্লাগানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযােগ্য। নিধুবাবু প্রেমকে রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক রােমান্স থেকে মুক্ত করে মানবিক আধারে স্থাপন করেন। প্রেম যে সহজ সাধারণ বস্তু—কোন কঠিন সাধনা নয়, তাও প্রমাণিত হয়েছে নিধুবাবুর টপ্পায়, টপ্পায় বর্ণিত প্রেমে বৈষ্ণবপ্রেমের গভীরতা না থাকলেও এতে ঔদার্য অনেক বেশি।
ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য নিধুবাবুর টপ্পা বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেছেন, “নিধুবাবুর টপ্লার প্রধান বৈশিষ্ট্য ইহার মননশীলতা। এই মননশীলতা তৎকালিক নাগরিক জীবনের ফল। এইখানেই টপ্পা আধুনিক। ইহা প্রেমের কবিতা বটে, কিন্তু ভাবসর্বস্ব সরল ও কোমল কবিতা নহে। ইহা জটিল চিন্তায় সবল এবং বুদ্ধির দ্বারা সুসংহত। আধুনিক মানের কবি বলিয়া নিধুবাবুর দৃষ্টিও রিয়্যালিষ্টিকতাহার কবিতা প্রাচীন রােমান্টিক মনােবিলাসের প্রবল প্রতিবাদ।”
টপ্পা রচয়িতাদের মধ্যে নিধুবাবু ছাড়া অপর দুই কবির নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় শ্রীধর কথক ও কালী মীর্জা। এঁদের গানগুলিও বিশুদ্ধ লিরিক কবিতার সূচনারূপে প্রশংসিত হবার যােগ্য।
Leave a comment