চর্যার ধারা:

সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ বহু দেশে বহু জাতির মধ্যেই দেখা যায়। বাঙলা সাহিত্যের উদ্ভবলগ্নে আমরা যে চর্যাপদগুলির সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি সেই চর্যাপদগুলি যে গানও ছিল, তার প্রমাণ তার সর্বাঙ্গে চিহ্নিত। বাঙালী জীবনে এই সঙ্গীত-প্রিয়তা পরবর্তীকালে দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, একটি পদাবলী সাহিত্যের ধারা, অপরটি লােকসঙ্গীতের ধারা। পদাবলী সাহিত্যের ধারায় বৈষ্ণব পদাবলী এবং শাক্ত পদাবলী রচিত হয়েছিল। লােকসঙ্গীতের ধারায় কালে কালে যে সকল গীত রচিত হয়েছিল, সম্ভবতঃ সেগুলি মুখে মুখে চলতাে বলেই হয়তাে এক সময় কাল-কবলিত হয়েছিল। বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মধ্যে একমাত্র নাথপন্থীরাই তাদের সঙ্গীতগুলিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল বলে তার কিছু কিছু এখনাে অবশিষ্ট আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতেই কিঞ্চিৎ পার্থক্যসহ বর্তমান, তা হলাে ‘বাউল গান’—এরি একটু রকমফের ‘মারফতী গান’ ও ‘মুর্শিদী গান’।

সহজ পন্থা: বাউল বাঙলার এক জাতীয় সাধক সম্প্রদায়। তাদের রচিত গানই বাউল গান। কিন্তু কবে এই বাউল সম্প্রদায় বা বাউল গানের উদ্ভব ঘটেছিল, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সপ্তদশ শতাব্দীতেই সর্বপ্রথম এদের আবির্ভাব ঘটে, এমন অনুমান অযৌক্তিক না হওয়াই সম্ভব বাউল গান-বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, আনুমানিক ১৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৬৭৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার বাউল ধর্ম এক পূর্ণরূপ লইয়া আবির্ভূত হয়। বাউলরা মরমীয়া সাধক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তারা নিজেদের ‘সহজিয়া’ বা ‘সহজপন্থী’ বলে মনে করেন। কোনপ্রকার প্রচলিত ধর্মমতে তারা বিশ্বাসী নয়, তাই যে কোনপ্রকার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই তারা বিরােধী। তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই, হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যথেষ্ট রয়েছে। কোনপ্রকার সাম্প্রদায়িক বন্ধনকেই তারা স্বীকার করেন না, তারা নিজেদের মনে করেন মুক্ত পুরুষ। ডঃ অরবিন্দ পােদ্দার মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ গ্রন্থে বলেছেন- “নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে থেকে বাউলরা জীবনের আর্তি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করেছেন। তাদের আকাঙ্ক্ষার পথ হলাে প্রেমের পথ। সহজিয়াদের মত তাদের লক্ষ্য হলাে সহজ হওয়া। শাস্ত্রীয় আচার বিধিবিধান সহজ মানুষের সৃষ্টি নয়, ভেদবিদ্বেষে জর্জরিত বিষয়কর্মে নিয়ােজিত স্বার্থান্ধ মানুষের সৃষ্টি। সেই স্বার্থান্ধ মানুষের পথ বর্জন করে তারা প্রেমের পথে অগ্রসর হলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই প্রেমের আয়ু সামগ্রিক ক্রিয়ার, সমবেতভাবে প্রয়ােগ করার আয়ুধ নয়। আদর্শটা এখানে ব্যক্তিগত বড় জোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে অন্য এক মানুষ লুক্কায়িত রয়েছেন যিনি মনের মানুষ’, যিনি প্রেমময় কল্যাণস্বরূপ আনন্দস্বরূপ। সেই মনের মানুষের সঙ্গে মিলনের জন্যই বাউলদের আকৃতি।”

দেহাত্মবাদ: বাউল সাধকগণ দেহাত্মবাদী—দেহকে কেন্দ্র করেই তাদের যােগ-সাধনাদি যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দেহের ঊর্ধ্বে অপর শক্তিতে বাউলদের কোন আস্থা নেই। হিন্দু সাধনায়ও দেহভাণ্ডকে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক বলে গ্রহণ করা হয়, কিন্তু হিন্দুরা দেহবাদী নয়। কারণ হিন্দু শাস্ত্রে দেহের ঊর্ধ্বে মন, মনের উর্ধ্বে বুদ্ধি এবং বুদ্ধির উর্ধে আত্মার স্থান। বাউলদের দেহসাধনা ইহযােগের সাধনা—বৌদ্ধ সহজিয়া এবং নাথধর্মের সঙ্গে এর মিল রয়েছে, কিন্তু এটি হিন্দু সাধনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

গুরুবাদ: বাউলগণ গুরুবাদী বলেই পরিচয়স্বরূপ তাদের ‘সাঁই, দরবেশ, কর্তাভজা প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। বাউলগণ মনের মানুষের সন্ধানেই জীবনপাত করেন, তাদের মতে, মানুষই একমাত্র সাধনযােগ্য। মনীষী অধ্যাপক ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত এই ‘মনের মানুষ’ সম্বন্ধে বলেন, “In the conception of the ‘men of the heart of the Bauls, we find a happy mixture of the conception of the Paramatman of the Upanisads, the sahaja of the sahajiyas and Sufi-istic conception of the Be loved.” অর্থাৎ ডঃ দাশগুপ্তের মতে উপনিষদের পরমাত্মা, সহজিয়াদের সহজ এবং প্রেমিক বিষয়ে সুফী ধারণার মিলনেই বাউল ধর্ম ও সাধনার উৎপত্তি।

বাউল সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য:

বাউল’ শব্দের উৎপত্তি বিষয়ে মতান্তর থাকলেও অনুমান করা হয় যে ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই এর উৎপত্তি। বাউল শব্দের সঙ্গে আরবী আউল’ শব্দটি অনেক সময়ই যুক্তভাবে ব্যবহৃত হয়-অর্থের দিক থেকে এই দুটি শব্দের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। আশ্চর্যের বিষয় অসামাজিক ব্যবহারের জন্য অন্যেরা এদের পাগল বা উন্মাদ বলে যেমন অভিহিত করে থাকে, তেমনি এরা নিজেরাও এদের নিজেদের অত্যন্ত হীনভাবে চিত্রিত করে থাকে। বাউল সঙ্গীত এদের সাধনার এক অপরিহার্য অঙ্গ। সাধারণতঃ একতারা নামক বাদ্যযন্ত্র সহযােগে নৃত্যসহ বাউলরা বাউল সঙ্গীত গেয়ে থাকে। এ কারণে বাউল সঙ্গীতের মধ্যে একটা নৃত্যচ্ছন্দও অনুভব করা যায়। বাউল সঙ্গীত-বিষয়ে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “বঙ্গীয় সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে বাউল সঙ্গীত। ভাষা ভঙ্গী ও সুরের এতখানি সরলতা, সাবলীলতা ও বাঙালীর ভাব বাংলার অন্য কোন সঙ্গীতে দেখা যায় না। বাউল-সুর মৌলিক ও বঙ্গজ। ইহা লঘু, তরল ও দ্রুতলয়-বিশিষ্ট, স্বভাবধর্মে গ্রাম্য .বাউল সঙ্গীত সর্বাধিক ভার হইতে মুক্ত, ইহার সুর সহজ প্রাণের সুর, অমার্জিত পল্লীভাষার নিত্য-সহচর, তাছাড়া নৃত্য-সহচরও বটে।”

মরমিয়া সাধনা: যে কোন সহজিয়া সাধনসঙ্গীতের মতােই বাউল সঙ্গীতও দুর্বোধ্য এবং রহস্যময়। এ বিষয়ে উঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন- “এই রহস্য বুদ্ধিগত, অতীন্দ্রিয় মিষ্টিক কবিতার রহস্যের ন্যায় ভাবগত নহে। সেইজন্য ইহাকে রােমান্টিক কবিতাই বলা উচিত। অর্থের দিক দিয়া মিষ্টিক কবিতাও অস্পষ্ট বটে, তবে তাহার কারণ স্বতন্ত্র। মিষ্টিক কবিতার ভাবগত অর্থ অনির্বচনীয়, কিন্তু বাউল কবিতার অর্থ ‘অকথ্য’। অবশ্য ইন্দ্রিয়সর্বস্ব বাউল কবিতায় স্পষ্টতাই স্বাভাবিক। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ইহাতে থাকিতে পারে না, তথাপি কবিতায় সাধনা-সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাষণ বাউল কবির পক্ষে নিরাপদ নহে।…..দ্বিতীয়তঃ রােমান্টিক কবি কল্পনার দ্বারা কবিতা রহস্যমণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে। বাউল কবি মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া বিচিত্র স্বপ্ন সৃষ্টি করিয়াছেন।” বাইরের দিক থেকে দেহতত্ত্ব-বিষয়ক গানগুলির একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া গেলেও এর গুহ্যতত্ত্ব একমাত্র মরমীয়া-পন্থীরাই উপলব্ধি করতে পারেন। শিক্ষিত ভদ্রসমাজে বাউল গানগুলির বিশেষ কোন মর্যাদা না থাকলেও অশিক্ষিত গ্রাম্য সমাজে বাউল গানগুলি অতি সুপরিচিত এবং জনপ্রিয়। এর আধ্যাত্মিকতাও ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীদের সহজেই আকর্ষণ করে থাকে।

বাউল গান: সপ্তদশ শতক থেকে আরম্ভ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত সুদীর্ঘকালে বাউল গান যে পরিণতি লাভ করেছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তার ক্রমবিবর্তনটি যথাযথভাবে ধরা যাচ্ছে না। কারণ, যথার্থ প্রাচীন বাউল গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। বিভিন্ন বাউল গানের ভণিতা থেকে অসংখ্য বাউলের নাম জানা যায়, কিন্তু এদের প্রায় সকলেরই পরিচয় অজ্ঞাত। গবেষকদের সঙ্কলন থেকে বিশেষভাবে এই নামগুলি পাওয়া যায়—লালন শাহ, পাঞ্জ শাহ, পদ্মলােচন, যাদুবিন্দু, হাউড়ে গোঁসাই, রসিক গোঁসাই, গােপাল, লালশশী, এরফান শাহ, অনন্ত বাউল, মদন বাউল, কৈবর্ত প্রভৃতি। অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীর বাউলরা সম্ভবতঃ গােপনতা রক্ষা করে চলতেন বলেই তাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় না। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউল সঙ্গীতের প্রতি সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং পরে এ বিষয়ে সঙ্কলন ও গবেষণায় অগ্রসর হন আচার্য ক্ষিতিমােহন সেন, মনসুরউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রভৃতি মনীষী।

লালন শাহ:- রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের বাউল গান শুনেই প্রথম মুগ্ধ হয়ে তার বাউল গান সংগ্রহ করেন। লালন ফকিরের আগে পরে আরাে অনেক বাউল সাধকই গান রচনা করলেও এর নামই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। লালনের কবিত্ব, ভক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের জন্যই তিনি বস্তুতঃ বাউলসমাজে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদা লাভ করে থাকেন। লালন-সম্বন্ধে প্রামাণিক তথ্য খুব বেশি পাওয়া না গেলেও অনুমান হয়, ইনি দীর্ঘজীবী ছিলেন। অনুমান ১৭৭৪ খ্রীঃ ইনি কুষ্টিয়ার ভাড়রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেউরিয়া গ্রামে সম্ভবতঃ আখড়া স্থাপন করে এখানেই তিনি বসবাস করতেন। তার ব্যক্তিগত পরিচয় কুয়াশাচ্ছন্ন হলেও অনুমান করা হয় তিনি কায়স্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যৌবনে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে তিনি পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক মুসলমান দম্পতি তাকে স্বগৃহে নিয়ে গিয়ে সেবা-শুশ্রুষা দ্বারা সুস্থ ক’রে তােলেন। অতঃপর তিনি গৃহে ফিরে এলেও তাকে আর সমাজে গ্রহণ করা হয়নি। তিনি ফকিরি গ্রহণ ক’রে লালন শাহ ফকির নামে পরিচিত হন। তিনি বাউল সাধক ছিলেন এবং বহু হিন্দু ও মুসলমান তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন, লালন ফকির এক মুসলমান-কন্যাকে বিবাহ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু লালন ফকিরের গানে রাধাকৃষ্ণ বা গৌর-বিষয়ক গানে যে আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় না যে, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য মুসলিম ধর্মীয় বিষয়েও তিনি সমান আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ থেকে অন্ততঃ বােঝা যায় যে লালন ফকিরের মনােভাব ছিল সম্পূর্ণ অসাস্প্রদায়িক। যে কোন ধর্মের মূল তত্ত্ব বিষয়ে বাউলদের শ্রদ্ধাবােধ থাকলেও যে কোন ধর্মের বাহ্য আচার-অনুষ্ঠানের তার নিন্দাই করেছেন। 

অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী মনে করেন— “লালনের গানগুলি সমাজ সচেতন এক প্রগতিবাদী শিল্পীরই উচ্চারণ বলে মনে হয়। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, ঘরের কাছে আরশি নগর’, ‘চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি’ ইত্যাদি গানগুলির রসাবেদন আজও অম্লান। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন বর্তমান যুগেও সমাজ-রাজনীতিকে কলুষিত করছে; যখন বাহ্যাড়ম্বরের ঝলসানিতে যথার্থ মানবতা ও সত্যের বাণী মূল্যহীন হয়ে উঠছে, তখনও লালনের গানগুলি বাউল তত্ত্বদর্শনের উর্ধে এক নূতনতর ব্যঞ্জনা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। সেক্ষেত্রে জাত গেল জাত গেল’, ‘সােনার মান গেলােরে’ইত্যাদি গানগুলি বাংলার বর্তমান যুগ-জীবনের পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।” 

লালনের বাউল গানগুলি- বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “সীমা-অসীম বা জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কও তিনি অতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের সাহায্যে ব্যক্ত করেছেন। তার ভাষা স্নিগ্ধ গীতি-মুর্ছনায় পূর্ণ; উপমারূপকে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের ব্যঞ্জনা এবং ভাবের গভীরতা এ যুগেও বিস্ময়কর। মূলতঃ তিনি বাউল সাধনার সঙ্কেত দিয়ে গানগুলি লিখেছিলেন। কিন্তু তত্ত্বকথাও তার ভাষায় বিচিত্র কাব্য্রী লাভ করেছে। সর্বোপরি আধুনিক মনের সঙ্গে তাঁর গানগুলির কেমন যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সেইজন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন (যদিও তাদের দেখাশুনা হয়নি) এবং আধুনিক শিক্ষিত সমাজে এখনও স্মরণীয় হয়ে আছেন।”

রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন। লালন গীতিকা’ নামক সঙ্কলন-গ্রন্থে লালনের ৪৬২টি গান সংগৃহীত হয়েছে। সম্ভবতঃ ১৮৯০ খ্রীঃ প্রায় ১১৬ বৎসর বয়সে লালন দেহত্যাগ করেন। সেঁউড়িয়া আখড়ায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

পাঞ্জশাহ:- বাউল গান-রচয়িতাদের মধ্যে লালন ফকিরের পরই সর্বাধিক উল্লেখযোেগ্য নাম পাঞ্জশাহ-এর। বাংলা ১২৫৮ সনে ইনি যশােহর জেলার শৈলকুপা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুফী-সাধক হেরাজতুল্লা খােন্দকারের নিকট বাউল সাধনায় দীক্ষিত হন; জন্মগতভাবে মুসলমান হলেও এর মনােভাব ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। ইনি যেমন ইসলামী অধ্যাত্মশাস্ত্রে কৃতবিদ্য ছিলেন, তেমনি হিন্দু যােগশাস্ত্রেও তার পারঙ্গমতা ছিল। তার জীবন-যাপন পদ্ধতি ছিল হিন্দু সন্ন্যাসীর মতাে। মুসলমানের মতাে অনেক হিন্দুও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাউল ও অধ্যাত্মার্গের একজন অগ্রগামী সাধক এবং স্বভাবকবি ছিলেন।

অন্যান্য:- ‘গগন হরকরা’ ছিলেন লালনের শিষ্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে বহু প্রসঙ্গে এই কথা উল্লেখ করেছেন। আমি কোথায় পাবাে তারে গানটি এঁরই রচনা। শ্রীহট্টের ‘হাসন রজা চৌধুরী’ও একজন উৎকৃষ্ট বাউল সঙ্গীত-রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ এঁর রচনারও সমজদার ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণ-সন্তান মতিনাথ সান্যাল ‘হাউড়ে গোঁসাই’ ভণিতায় কয়েকটি উৎকৃষ্ট বাউল সঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি চণ্ডীদাস-রজকিনী-আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘গােপাল গোঁসাই’-ও বাউল সঙ্গীত রচনা করে আধ্যাত্মিকতার পরিচয় দান করেন।