মীর মশাররফ হােসেন বাঙলা ভাষার একজন বিশিষ্ট লেখক। ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ১৩ই নভেম্বর নদীয়া জেলার লাহিড়ীপাড়া গ্রামে তার জন্ম। তার কালে বাঙলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা-সম্বন্ধে মুসলমান সমাজ বিশেষ আগ্রহ বােধ করেন নি। ছাত্রাবস্থায়ই মশাররফ হােসেন বাঙলা ভাষায় রচনার সম্পর্কে উৎসাহী হন। তিনি এই সঙ্গে তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছেন- “কলিকাতার সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র গুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সহকারি সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের সহিত পত্রে পত্রে দেখাশুনা যেরূপ হইতে পারে তাহা আছে। আমি অনেক সংবাদ তাহাদের কাগজে লিখিতাম। তাঁহারাও দয়া করে ছাপাইতেন। আমাকে নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন- আমাদের কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা, কেউ জানিত না যে আমি প্রভাকর পত্রিকায় কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা। সাদাসিদাভাবে লিখিতাম। ভুবনবাবু কাটিয়া ছাঁটিয়া প্রকাশের উপযুক্ত করিয়া দিতেন।” কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্ত্তা’র সঙ্গেও তাঁর যােগাযােগ ছিল। মশাররফ হােসেন ‘আজীবন নেহার’ নামে একটি মাসিকপত্রও কিছুদিন সম্পাদনা করেছিলেন।

মীর মশাররফ হােসেন প্রায় ছাক্বিশটির মত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার উপন্যাস ‘রত্নাবতী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। লােককাহিনী থেকে ‘রত্নাবতী’র উপাদান সংগৃহীত হয়েছিল। ‘বসন্তকুমার নাটক’ (১৮৮৩), ‘জমিদার দর্পণ’ (১৮৭৩) নাটক এবং প্রহসন এর উপায় কি?’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে। তিন অঙ্কে বিভক্ত ‘জমিদার দর্পণের বিষয়বস্তু গ্রামের এক মুসলমান জমিদারের অত্যাচার কাহিনী নাট্যকার মধুসূদনের ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র অনুসরণ করেছিলেন। নামকরণে বােঝা যায় ‘নীলদর্পণে’র প্রত্যক্ষ প্রেরণাও ছিল। সমাজের বাস্তবচিত্র হিশেবে নাটকটির কিছু মূল্য আছে। ‘গােজীবনে’ (১৮৮৯, ৮ই মার্চ) লেখক হিন্দু মুসলমান-সম্প্রীতির জন্য মুসলমানদের গরু না খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। ভারতী ও বালক পত্রিকায় (চৈত্র, ১২৯৫) এই রচনাটি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছিল, “লেখক মুসলমান হইয়া এ বিষয়ে যেরূপ উদারতার পরিচয় দিয়াছেন, যেরূপ অপক্ষপাতিভাবে তাহার পক্ষ সমর্থন করিয়াছে তাহা পড়িয়া কেবল আনন্দ নহে আমাদের আশ্চৰ্য্যও জন্মিল। ভরসা করি, অন্য মুসলমানগণ তাহার অনুসরণ করিবেন।”

তিনি দুটি উপন্যাসও লিখেছিলেন—‘উদাসীন পথিকের কথা’ (১৮৯০) ও ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। প্রথমটিতে পাই চা-করদের বৃত্তান্ত, নীলাচাষ- বিরােধী আন্দোলনের প্রসঙ্গও আছে। দ্বিতীয়টিতে পাই মফঃস্বল অঞ্চলের সমাজচিত্র, ইংরেজের আইন আদালতের প্রচ্ছন্ন সমালােচনাও উল্লেখযােগ্য। ১২ খণ্ডে সম্পূর্ণ আমার জীবনী (১৯০৯- ১০)-তে লেখক তার প্রথম বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত ঘটনা চিত্তাকর্যকভাবে বর্ণনা করেছেন। তার গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনার মধ্যে ১৩১৪ সালের বৈশাখ শ্রাবণ সংখ্যা ভারত মহিলা য় প্রকাশিত কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত আমলা-সদরপুরের ভূম্যধিকারিণীর সহিত নীলকর কেরী সাহেবের সংঘর্ষ কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘প্যারী সুন্দরী’ উল্লেখযােগ্য।

মীর মশাররফ হােসেনের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘মহররম-পর্ব’, উদ্ধার পর্ব ও এজিদবধ পর্ব এই তিন পর্বে বিভক্ত ‘বিষাদসিন্ধু’ (১২৯১-৯৭) গ্রন্থটি কারবালার শােচনীয় বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত। প্রাঞ্জল ও মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখক মহররমের বিষাদময় ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। বিষাদসিন্ধুই মীর মশাররফ হােসেনকে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে। রচনাটি সেই সময় উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছিল। ১২৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় এই মন্তব্য তার প্রমাণ- “ইহা মহররমের একখানি উপন্যাস ইতিহাস। ইহার বাঙ্গলা যেমন পরিষ্কার, ঘটনাগুলি যেমন পরিস্ফুট, নায়ক-নায়িকার চিত্রও ইহাতে তেমনি সুন্দরভাবে চিত্রিত হইয়াছে। ইতিপূর্বে একজন মুসলমানের এত পরিপাটী বাঙ্গলা রচনা আর দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।”

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৩০৮ সালের পৌষ সংখ্যা ‘প্রদীপ’-এ মশাররফ হােসেনের কৃতিত্ব সম্বন্ধে বলেছিলেন- “তদকালে একজন মুসলমানের পক্ষে ভাল বাঙ্গালা রচনা করিবার বহু বাধাবিঘ্ন বর্তমান ছিল। তাহা অতিক্রম করিয়া মীর মশাররফ হােসেন যে সাহিত্য-শক্তি লাভ করিয়াছেন, তাহা অল্প শ্লাঘার বিষয় নহে।” মশাররফ হােসেনের কাব্যগ্রন্থ ‘গােরাই ব্রিজ’ অথবা ‘গৌরী-সেতু’-সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের ১২৮০ সালের পৌষ সংখ্যায় যে মন্তব্য করেছিলেন সেটিও স্মরণীয় ঃ “তাহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না। ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়। বাঙ্গালা, হিন্দুমুসলমানের দেশ—একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান এক্ষণে পৃথক, পরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালীর প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দুমুসলমানে ঐক্য জন্মে, কতদিন উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমন গর্ব থাকিবে, যে তাহারা ভিন্নদেশীয়, বাঙ্গালা তাহাদের ভাষা নহে, তাহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু ফারসীর চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। কেন না, জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষায় একতা। অতএব মীর মশাররফ হােসেন সাহেবের বাঙ্গালা ভাযানুরাগিতা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় প্রীতিকর।”