বাঙলাদেশের উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের ইতিহাস যাদের মনীষায় উজ্জ্বল হয়েছে। রমেশচন্দ্র তাঁদের অন্যতম। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়ই তার নিরলস পরিশ্রমনিষ্ঠ অনুসন্ধিৎসা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের অনুপ্রেরণায়ই তিনি বাঙলা সাহিত্যের চর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন। বঙ্কিমের মত রমেশচন্দ্রও ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের অনুরাগী। এই সুগভীর ইতিহাসপ্রীতির জন্যই রমেশচন্দ্র বঙ্কিম-প্রবর্তিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারাটিকে অনুসরণ করেছিলেন এবং এখানেই তিনি সার্থকতা অর্জন করেছিলেন; তার পরই তার সাহিত্য-প্রতিভা যেন নিঃশেষিত হয়ে যায়।
রমেশচন্দ্র সর্বসমেত চারখানা ঐতিহাসিক এবং দুটো সামাজিক উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তার ‘বঙ্গবিজেতা’ (১৮৭৪) ও ‘মাধবীকঙ্কণ’ (১৮৭৭), ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ (১৮৭৮) ও ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যার’ (১৮৭৯) উপজীব্য হল যথাক্রমে আকবর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের ঘটনা। মুঘল সাম্রাজ্যের শতবর্ষের ইতিহাসের ঘটনাবলী এই চারটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু বলে সেগুলি একত্রে ‘শতবর্ষ’ নামে সংকলিত হয়েছিল, এই চারটি উপন্যাসে পরিণতির দুটো স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিকের রচনা ‘বঙ্গবিজেতা’ ও ‘মাধবীকঙ্কণ’-এ ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠা অপেক্ষা কল্পনার প্রাধান্যই সর্বাপেক্ষা বেশী, এখানে বর্ণনীয় বিষয় ও প্রধান চরিত্রগুলাে মূলতঃ তাদের ঐতিহাসিক পরিবেশের মধ্যে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে মাত্র। আকবরের রাজত্বকালে বাঙলাদেশের শাসনকর্তা টোডরমল্লের বিরুদ্ধে জমিদার অমরসিংহের বিদ্রোহই ‘বঙ্গবিজেতা’র ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু। উপন্যাসটির ঐতিহাসিক অংশে অবশ্যই লেখকের ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় আছে, কিন্তু মানব-জীবন ও মানবহৃদয়ের গুঢ় অন্তলীন ভাব সম্বন্ধে ইতিহাস এখানে সজীব হয়ে উঠতে পারে নি, সেই প্রাণময় সম্বন্ধের অভাবে কাহিনী শুষ্ক তথ্য সমাবেশে পর্যবসিত হয়েছে। রাজা টোডরমল্লের মত ঐতিহাসিক চরিত্র যেমন, তেমনি ইন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ, সতীশচন্দ্র, বিমলা প্রভৃতি কাল্পনিক চরিত্রগুলােও ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের প্রাণময়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে নি। আকবর টোডরমলের ঐতিহাসিক পটভূমির সঙ্গে নায়ক ইন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবনের সম্বন্ধ ক্ষীণ, অস্পষ্ট। ‘মাধবীকঙ্কণ’-এ ঐতিহাসিক তথ্যবিলাস অপেক্ষাকৃত পরিণত। তার কাহিনীর পটভূমি সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল। এই উপন্যাসটিতে আমরা দেখি, জমিদারপুত্র নরেন্দ্রনাথ কর্মচারীর চক্রান্তের ফলে জমিদারি হারিয়ে কর্মচারী-কন্যা হেমলতার সঙ্গে প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে গৃহত্যাগী হয়, অবশেষে সে রাজমহলে সূজার দরবারে উপস্থিত হয় এবং সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বের শেষভাগে তার পুত্রদের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে যে তুমুল-কলহ বাধে, তার আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। ‘মাধবীকঙ্কণ’ মূলতঃ পারিবারিক উপন্যাস হলেও তার ঐতিহাসিক পরিবেশ বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
‘মহারাষ্ট্র-জীবনপ্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কল্পনা এখানে ইতিহাসকে আচ্ছন্ন বা অতিক্রম না করে তার শূন্য স্থানগুলােকে পূর্ণ করে তাকে সঞ্জীবিত করেছে। ঔরংজেবের রাজত্বকালে শিবাজীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মহারাষ্ট্রের জাতীয় জীবনের জাগরণ এবং জাহাঙ্গীরের সময় অস্তোন্মুখ রাজপুত জাতির শেষ গৌরবময় দিনগুলাের বিষাদময় বিবরণ এই দুটো উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মহারাষ্ট্র-জীবনপ্রভাত’ এবং বিশেষ করে রাজপুত জীবনসন্ধ্যায় আমরা রমেশচন্দ্রের দেশাত্মবােধের আবেগকে অনুভব করি।
ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, “মহারাষ্ট্রের উত্থান ও রাজপুতের পতন ভারতের ইতিহাসে দুটি কীর্তিভাস্বর পৃষ্ঠা; এই দুইটি পৃষ্ঠাতে যত উচ্চ ও পবিত্র যত গৌরবময় অনুভূতি লইয়া ইতিহাসের তুষারশীতল পাষাণফলকে নিশ্চল হইয়া ছিল, রমেশচন্দ্র সেগুলিকে কল্পনার শিখায় দ্রবীভূত করিয়া মানবমনের সজীব ভাবপ্রবাহের সহিত তাহাদের পুনর্মিলন সাধন করিয়া দিয়াছেন। শিবাজীর কর্মব্রত ও মহত্বদীপ্ত চরিত্র, তাহার রাজনৈতিক কুশলতা, লােমহর্ষক সংগ্রাম, নবজাগ্রত মহারাষ্ট্রীয় জাতির বিপুল উদ্দীপনা—এ সমস্তই মহারাষ্ট্রীয় জীবনপ্রভাতে এক একটি বর্ণোজ্জ্বল দৃশ্যে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে।”
‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’য় রাঠোর চন্দাবতের মধ্যে চিরকালীন গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে এই দ্বন্দ্ব স্থগিত রেখে বীরত্বধর্ম পালন, বীরদের গৌরবময় জীবনাচরণ, প্রতাপসিংহের দেশরক্ষায় অটল সংকল্প, তার সামন্তগণের অবিচলিত দেশভক্তি, পার্বত্য ভীল জাতির আচার ও জীবন-চেতনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অবশ্য এখানেও ইতিহাসের পটে কোনও গভীর মনস্ত্ত্ব- বিশ্লেষণ ও মানবচরিত্রের সূক্ষ, জটিল দিক পাই না, বহির্জগতের নিগূঢ় সমন্বয়ের দিক থেকে আলােচ্য রচনা দুটোর কল্পনাদৈন্য আমাদের স্বীকার করতেই হয়।
‘সংসার’ (১৮৮৬) ও ‘সমাজ’ (১৮৯৪) রমেশচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাস, বিধবা বিবাহ এবং অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনের উদ্দেশ্যেই রচিত। কিন্তু এই উদ্দেশ্য-সচেতনতা উপন্যাস দুটোর শিল্পশ্রীকে একেবারে আচ্ছন্ন করতে পারে নি। দুটো উপন্যাসই বর্ণনাপ্রধান। দুটোতে, বিশেষতঃ ‘সংসার’-এ পল্লী অঞ্চলের পারিবারিক ও প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-হাসি-কান্নার সহানুভূতি-সিঞ্চিত, প্রত্যক্ষ, বাস্তব ও সরস চিত্র লেখক পরিবেশন করেছেন। তার অঙ্কিত চরিত্রগুলাের গভীরতা ও জটিলতা না থাকলেও সহজ বাস্তবতায় ও স্বাভাবিকত্বে তারা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। লেখকের সমাজ সংস্কারের উৎসাহ সমাজ-এর শিল্পমূল্যকে কিছুটা পরিমাণে ক্ষুন্ন করেছে।
আমরা এইবার সামগ্রিকভাবে রমেশচন্দ্র দত্তের শিল্পকর্মের মূল্য নিরূপণ করে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার স্থানটি নির্দেশ করতে পারি। সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে ইতিহাসের গভীর ও জটিল সম্পর্কের চিত্রণ—ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই বিশেষ গুণটা তার রচনায় না থাকলেও বাঙলা উপন্যাসে ইতিহাসের রস পরিবেশণে তার কৃতিত্ব আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের বৈচিত্র্য, যুগের পটভূমির বিস্তৃত চিত্রণে সমুন্নত ভাবাদর্শের বিকাশে এবং বীররসের স্ফুরণে ঐতিহাসিক উপন্যাস আমাদের সম্মুখে এক বিচিত্র সৌন্দর্যের জগৎ উদ্ঘাটিত করে- “অন্য সাহিত্যের পক্ষে যাহা হউক, বঙ্গসাহিত্য-সম্বন্ধে ইহা একটি অবিসংবাদিত সত্য যে, ঐতিহাসিক উপন্যাস বাস্তব জীবনের শূন্যতা পূর্ণ করিয়া আমাদিগকে এক বিচিত্র রসের আস্বাদ দেয়; এবং রমেশচন্দ্র এই রস আমাদিগকে প্রচুর পরিমাণেই দিয়েছেন। তিনি বঙ্গসাহিত্যের একটি বিশেষ অভাব মােচন করিয়াছেন, এক শূন্যতা পূর্ণ করিয়াছেন।” রমেশচন্দ্রের কৃতিত্ব সম্বন্ধে সমালােচকের ভাষায় বলতে পারা যায়- “ঐতিহাসিক উপন্যাসে তিনি সমধিক কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন—তাহার ‘জীবন-প্রভাত’ ও ‘জীবনসন্ধ্যা’ বঙ্গসাহিত্যে খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে।…সামাজিক উপন্যাসে রমেশচন্দ্রের বিশেষ গুণ তাহার সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি ও পল্লীগ্রামের দুঃখদারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের প্রতি করুণ ও অকৃত্রিম সহানুভূতি প্রকাশ পায়।”
Leave a comment