বাংলা কথাসাহিত্যে আশাপূর্ণা দেবী যে অসামান্য প্রতিভায় আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনকে জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন, তার সম্যক পরিচয়টি লিপিবদ্ধ করাে।

বাংলা কথাসাহিত্যে একটি বহু উচ্চারিত এবং জনপ্রিয় নাম আশাপূর্ণা দেবী। চিত্তচমৎকারিণী কাহিনী রচনা করে আজ মুষ্টিমেয় যে ক’জন সাহিত্যিক আমাদের সাহিত্যের আসর আলােকিত করে রেখেছেন আশাপূর্ণা তাঁদের অন্যতম। একদা বাঙালী পাঠক সমাজে শরৎচন্দ্র এবং পরবর্তীকালে তারাশংকর এবং বিভূতিভূষণ যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, সাম্প্রতিক কালে আশাপূর্ণা দেবী সেই জনপ্রিয়তার অধিকারিণী। বলা বাহুল্য জনপ্রিয়তাই সার্থকতার একমাত্র প্রমাণ নয়। জনপ্রিয়তার সঙ্গে উৎকর্ষ যুক্ত হলে তবেই সে জনপ্রিয়তা স্থায়িত্ব লাভ করে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, রাজারাজড়ার জয়-পরাজয়, রাজত্বকাল, কর্মকাণ্ডের সন-তারিখের জটিলতায় প্রকৃত ইতিহাসের অনুসন্ধান নিষ্ফল। ঘরে বসে মানুষ যেখানে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় নিত্যদিনের জীবন যাপন করছে সেখানেই মানুষের সত্যিকার ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আমরা যাকে কথাসাহিত্য বলি তার উপকরণ সেই যথার্থ জীবনের ইতিহাস থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। সমালােচক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, “আমাদের সাহিত্যে ঐ ছন্দটিকে সর্বপ্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুচ্ছের গল্পের মধ্যে। … .. মনের এ্যালকেমি-গুণে চোখে দেখা, কানে শােনা সামান্যটুকু অসামান্য রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেখানেই প্রতিভার প্রকাশ। আমরা যাকে পঞ্চেন্দ্রিয় বলি তার প্রত্যেকটিই অশেষজ্ঞানের উৎস। যাঁরা জাত লিখিয়ে, জাত শিল্পী, তাঁদের শিক্ষা একদিকে ইন্দ্রিয়গত, অপরদিকে হুদয়গত।..একথা আশাপূর্ণা দেবীর বেলায় যতখানি সত্য এমন সকলের বেলায় নয়।”

সমালােচকের এ কথা সর্বাংশে সত্য। কেননা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তাে দূরের কথা, আশাপূর্ণা একটি দিনের জন্যও কোন ইস্কুলে পড়েন নি। তার নিজের কথায়,- “আমাদের বাড়ি খুব রক্ষণশীল ছিল। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পাট ছিল না। স্কুলে যাওয়ার সুযােগ হয়নি। তবে পড়েছি সর্বদাই। সেই পড়াটি বাড়িতে এবং শুধুই গল্প উপন্যাস।” তাঁর এই সাহিত্যপ্রীতির ব্যাপারে মায়ের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। কেননা আশাপূর্ণার মায়ের ছিল ভীষণ সাহিত্যপ্রীতি। তখনকার দিনে প্রকাশিত সমস্ত গ্রন্থাবলীই তাঁর ছিল এবং প্রতিনিধি-স্থানীয় সমস্ত পত্রিকাও তার বাড়িতে আসত। অতএব আশাপূর্ণা মায়ের দৌলতেই পেয়ে যেতেন অফুরন্ত মনের খােরাক।

অতি শৈশব থেকেই আশাপূর্ণার সাহিত্য চর্চায় হাতেখড়ি। মাত্র তেরাে কি চোদ্দো বছর বয়সেই নিতান্ত কৌতূহলের বশে কাউকে কিছু না বলে লুকিয়ে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত শিশুসাহিত্য পত্রিকা ‘শিশুসার্থী’ র দপ্তরে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, প্রথম লেখা সেই কবিতা অপ্রত্যাশিতভাবেই ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। এর পরের লেখাটিও ‘শিশুসাথী’তেই পাঠিয়েছিলেন। এটি একটি গল্প। অর্থাৎ ছােটদের জন্য গল্প দিয়েই কথা সাহিত্যের জগতে কিশােরী আশাপূর্ণার প্রবেশ। আঠাশ বছর বয়সে লিখলেন বড়দের জন্য প্রথম গল্প। আনন্দবাজার শারদীয়া সংখ্যায় বেরিয়েছিল ‘প্রেম ও প্রেয়সী’ নামে সেই প্রথম গল্প। রক্ষণশীল পরিবারে বিবাহ হলেও বিবাহিত জীবন তার সাহিত্যচর্চার পথে কখনাে বাধা হয়ে ওঠেনি। সারা জীবনে অবিশ্রাম কথাসাহিত্যের সেবা করে গেছেন তিনি। আশাপূর্ণা স্বয়ং লিখেছেন,- “উপন্যাস লিখেছি দেড়শাের বেশী আর ছােটগল্প হাজার দেড়েকের ওপর। … বাল্য থেকে বার্ধক্যে দীর্ঘকাল ধরে লিখে চলেছি। … যা দেখেছি আর দেখে যা মনে হয়েছে সেটাই লিখে চলেছি।” স্বামী এবং আশাপূর্ণার প্রায় সমবয়স্ক দেওরটি লেখার ব্যাপারে তাঁকে সব সময়ে উৎসাহ দিয়েছেন। আশাপূর্ণা দেবী নিজেও ছিলেন একজন আদর্শ পত্নী এবং আদর্শ গৃহিণী। সংসার-ধর্মে এবং সাহিত্য-কর্মে কোন বিরােধ ঘটেনি তাঁর জীবনে। সাহিত্যের প্রতি যতখানি তার আনুগত্য, সংসারের প্রতিও ততখানি। আলােচক আশাপূর্ণার ব্যক্তিজীবন তথা সাহিত্যজীবনকে তুলনা করেছেন নদীর সঙ্গে ; বলেছেন,— “নিজের সংসার, প্রতিবেশীর সংসার, নিত্য দিনের জীবন, চোখের সমুখে চলমান জীবনের যে ছবি, সাহিত্যে তারই প্রতিচ্ছবি। নদীর এক নাম চিত্রবহা, সে তার দুই তীরের চিত্র বহন করে চলে। …… আশাপূর্ণা দেবী কখনাে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে যান নি। এত যে গল্প উপন্যাস লিখেছেন, কত সব মানুষের কথা বলেছেন তারা সবাই চেনা মানুষ শুধু তার নয়, আমার আপনারও চেনা।”

আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য কর্মে একটি সহজের সাধনা আছে ; এজন্যে তার সমস্ত গল্পে কাহিনিতে একটি নিঃসংশয় সততার ছাপ পড়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র এবং বিবৃত ঘটনাকে অকৃত্রিম সত্য বলে গ্রহণ করতে একটুও বাধে না। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনের এমন অন্তরঙ্গ ছবি সে কারণেই বাঙালী জীবনের দিবারাত্রির কাব্য হয়ে উঠতে পেরেছে। তিনি নিজেই তার সাহিত্যের এই প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই এ ব্যাপারে লিখেছেন,- “আমি কখনাে আমার জানা জগতের বাইরে কোথাও পা ফেলতে যাই না এবং আমার সেই জগৎটি একেবারে চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবু তার মধ্যে দেখে চলেছি কি অফুরন্ত জীবন বৈচিত্র্য। কী বিচিত্র সব চরিত্র।”

আশাপূর্ণা ছােটোগল্প রচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ। তিনি নিজেই বলেছেন যে, ছােটোগল্পই তাঁর ‘প্রথম প্রেম’। কিন্তু যেহেতু নিজের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকেই তিনি নিজ সাহিত্যের উপকরণ সংগ্রহ করেন, সেহেতু উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও তার উপাদান-উপকরণের অভাব কিছুই নেই। যার দেখার চোখটি সর্বদা সজাগ, প্রতিদিনের জগৎ থেকেই তাঁর অভিজ্ঞতার অর্জন অফুরন্ত। ছছাটোগল্পে আশাপূর্ণা দেখান আমাদের চারপাশের চেনা জীবনে কি ঘটে, আর উপন্যাসে তিনি যা ঘটে তা দেখানাের পাশাপাশি দেখান কী কারণে ঘটে। ছােটোগল্পে যা অঙ্কিত হয় সংক্ষিপ্ত রেখায়, সূক্ষ্ম কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে, উপন্যাসে সেটিই আসে বিস্তৃত বিবরণে, অনুপুজ্খসহ। স্বভাবতই পট হয় ব্যাপক, কালসীমা হয় বিস্তৃত এবং চরিত্র আসে অবিরল ধারায় অসংখ্য।

আশাপূর্ণার উপন্যাসের সংখ্যা কম নয়। তার নিজের হিসাবে প্রায় দেড়শাে। সম্ভবত আসল হিসাবটা আরাে বেশি। সেকারণে তার সব উপন্যাসের আলােচনা সডব না হলেও কয়েকটি উপন্যাসের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। যেমন—’প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’, ‘যে যার দৰ্পণে’, ‘যােগ বিয়ােগ’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শেষ রায়’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘সিড়ি ভাঙা অঙ্ক’, ‘দূরের জানালা, ‘নকশাকাটা ঘর’, ‘এই তাে সেদিন’, ‘চার দেওয়ালের বাইরে’, ‘এক সমুদ্র অনেক ঢেউ’, ‘অচল পয়সা’, ‘কখনাে কাছে কখনাে দূরে’, ‘অনমনীয়’, ‘পঞ্সখী’, ‘অন্য মাটি অন্য রঙ’, ‘পয়সা দিয়ে কেনা’, ‘অবিনশ্বর’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘স্থান কাল পাত্র’ ইত্যাদি।

‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’ এই তিনটি উপন্যাসের মধ্যে সার্থক পরিচয় মিলবে আশাপূর্ণার সাহিত্যপ্রতিভা ও জীবনদৃষ্টির। তিনটি পৃথক উপন্যাস হলেও আসলে এই তিনটি মিলে এটি আশাপূর্ণার ট্রিলজি উপন্যাস। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’ তিনে মিলে আশাপূর্ণা দেবী এক বিরাট ক্যানভাসে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্রটিকে ধরেছেন। বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের তিনটি জেনারেশানের ইতিহাস এখানে বিবৃত। তিন জেনারেশানের তিনটি রমণী—মা, মেয়ে ও নাতনিকে ঘিরে এই কাহিনি। তিনজনেরই জীবন ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি নারীই আসলে ট্র্যাজেডির নায়িকা।

‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র কেন্দ্রিয় চরিত্র সত্যবতী। এক রক্ষণশীল এবং প্রাচীনপন্থী পরিবারে বধু হিসাবে এসেছে সত্যবতী। সত্যবতী নিজে সুশিক্ষিতা, সাধ ছিল কন্যা সুবর্ণলতাকে শিক্ষায় দীক্ষায় মনের মতাে করে গড়ে তুলবেন। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের প্রাচীনপন্থী ঠাকুরমায়ের পরামর্শে, বাপের সম্মতিতে সে কন্যার নবছরে গৌরীদান হয়ে গেল, মাকে না জানিয়ে। সত্যবতী তেজস্বিনী মহিলা ; নিদারুণ অভিমানে আপন সংসার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। স্বামী কন্যা কারাে সঙ্গেই আর সম্পর্ক রাখেন নি।

দ্বিতীয় খণ্ড তথা ‘সুবর্ণলতা’ উপন্যাসের আশ্রয় সত্যবতী কন্যা সুবর্ণলতা। সুবর্ণলতাকে সংসারে কেউ বােঝেনি—মাতা পিতা স্বামী পুত্রকন্যা সকলের দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা। সুবর্ণলতা বালিকা বয়সেই মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিতা, ব্যক্তিত্বহীন পিতা থেকেও নেই, স্বামীটি অত্যন্ত স্থূল প্রকৃতির সন্দিগ্ধ-চিত্ত একটি পুরুষ, সুবর্ণলতার স্বামী হবার সম্পূর্ণ অযােগ্য। সুবর্ণলতা উচ্চ শিক্ষার সুযােগ পায়নি। কিন্তু মায়ের মার্জিত রুচি এবং চিত্ত বৃত্তির কিছু সে নিঃসংশয়ে পেয়েছিল। ফলে স্বামীগৃহে অর্ধশিক্ষিত গেঁয়াে পরিবারটির সঙ্গে নিজেকে সে একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারেনি। স্বামীর রুচিহীনতার কারণে সুবর্ণলতাকে বহু সন্তানবতী হতে হয়েছে। কিন্তু ছােট দুই কন্যাকে বাদ দিলে ছেলেমেয়ে সব কটিই বংশগত স্থূল স্বভাবের যােগ্য উত্তরাধিকারটি পেয়েছে পুরাে মাত্রায়। মনের কথাটি বলার মানুষটি পায়নি সুবর্ণলতা। একাকীত্বের এই নিদারুণ অভাব সে মিটিয়েছিল মনের কথাগুলি হৃদয়ের তীব্র যন্ত্রণাগুলি খাতার পাতায় কলমের অক্ষরে প্রকাশ করে। অবসর মুহূর্তে বসে বসে নীরবে নিভৃতে তার মনের ভাবনাকে সে মেলে ধরেছিল একটি খাতার পাতায়। সুবর্ণকে কেউ বােঝেনি। আশাপূর্ণাদেবীই সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে একটি নিখুঁত ট্র্যাজিক চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন না চেনার, না জানার, না বােঝার ট্র্যাজেডি। তাই অভিমানে বস্তা ভর্তি সমস্ত বই ছাতে নিয়ে গিয়ে সুবর্ণলতা নিজ হাতে একদিন তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। কনিষ্ঠা কন্যা বকুল সেই আগুনের ঝলকে বিদ্যুৎ চমকে মুহূর্তের জন্যে দেখতে পেয়েছিল মায়ের মুখে অসীম ক্লান্তি আর অপরিসীম অন্তর্বেদনার ছাপ—এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে বইগুলাের দিকে।

এই বকুলকে নিয়ে গ্রন্থের তৃতীয় খন্ড- যা একটি পৃথক উপন্যাস ‘বকুলকথা’। মা-দিদিমার মতাে বকুলের জীবনও ব্যর্থই বলতে হবে। কিশােরী বকুল মনে-প্রাণে ভালােবেসেছিল একটি ছেলেকে। ছেলেটিও তাকে ভালােবাসত। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে যেমনটা হয়—ছেলেটি লক্ষ্মী ছেলের মতাে অভিভাবকের আজ্ঞায় অপর একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করেছে। বকুলের বিবাহের সাধ এখানেই মিটে গিয়েছে। বিয়ের চিন্তা বকুল আর মনে স্থান দেয়নি। মায়ের মতােই নিঃসঙ্গ তারও জীবন, তারও কেবল মনােজগতে বিচরণ। পিতৃগৃহেই বাস কিন্তু সুবর্ণলতার মতাে সেও নিজ বাসভূমে পরবাসী। শৈশবে মায়ের কাছে পেয়েছিল শােভন রুচিবােধ, কিন্তু সারা জীবন কাটাতে হল স্থুলতার সংস্পর্শে, ক্লেদ পঙ্কের মধ্যে। কিন্তু এরই মধ্যে সে হয়েছে লেখিকা। জীবনের এই অভিজ্ঞতা ও অনুভবগুলি সে প্রকাশ করে তার লেখায়।

অনেকে বলেন, আশাপূর্ণা দেবী আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজে নিপীড়িত নারীজাতির মুখপাত্রী। তিনি একস্থানে বলেছেন- “যখন আমার খুব কম বয়েস তখন থেকেই দেখতাম পারিবারিক জীবনে … ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে মূল্যবােধের বড় বেশী তফাৎ।… এটা আমাকে খুব বিদ্ধ করত। … আমার সেই নিরুচ্চার প্রতিবাদগুলােই যেন এক একটি প্রতিবাদের প্রতিমুর্তি হয়ে আমার কাহিনীর নায়িকা হয়ে দেখা দিয়েছে।” তবে আশাপূর্ণা দেবী খুব ভালাে করেই জানেন যে নারী নির্যাতনে পুরুষের হাত যতখানি নারীর হাতও ততখানি। সুবর্ণলতার জীবন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল, সে কি শুধু তার পিতা আর স্বামীর দোষে? তার ঠাকুরমা আর শাশুড়ির দোষ কি কিছু কম? যে অর্থে আজ বহু লেখিকাকে নারীবাদী আখ্যা দেওয়া হয়, আশাপূর্ণাকে সে অর্থে নারীবাদী বলা যাবে না। কেননা তিনি প্রায় নিরপেক্ষভাবে অঙ্কন করেছেন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাধিকে এবং মহত্ত্বকেও। পুরুষের আধিপত্য, অত্যাচার, অবিচার, অনাচার যেমন এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন তার উদারতা ও মহত্ত্বকেও। একইভাবে তাঁর কথাসাহিত্যে রূপায়িত অসংখ্য নারীর মধ্যে শুধু সর্বংসহা মহৎ মূর্তিই অঙ্কিত হয়নি, অঙ্কিত হয়েছে তার স্বার্থপরতার ভয়ংকরতাও। নারীর প্রতি স্বভাবতই একটি সহানুভূতি থাকলেও আশাপূর্ণা দেবীর নিজ জীবনের অভিজ্ঞতায় নারীর ভিন্ন স্বার্থপরতার ও অত্যাচারী মূর্তিও আছে। নিজের মা-কেই দেখেছেন ঠাকুরমায়ের কাছে অত্যাচারিত হতে। বলেছেন— “ঠাকুরমা কোন কালেই মাকে সুনজরে দেখেননি, হেনস্তা করেছেন।” মনে হয় মায়ের এই শাশুড়ীটিই পরে তাঁর উপন্যাসে সত্যবতীর শাশুড়ি বা সুবর্ণলতার শাশুড়ী হয়ে দেখা দিয়েছেন। স্বার্থসর্বস্ব আধুনিকাদের সম্পর্কেও তিনি সহানুভূতিশীল হতে পারেন না- “অধিকারহীন অবলাদের দুঃখের কথা বলেছি বৈকি কিন্তু আজকের স্বাধিকারমত্তা সবলাদের দেখেও খুব একটা আনন্দ পাচ্ছিনা!”

আশাপূর্ণা দেবী তার ‘শশীবাবুর সংসার’ (১৯৫৬), ‘যােগ বিয়ােগ’ (১৯৬০) ইত্যাদি একাধিক উপন্যাসে শহরে মধ্যবিত্ত জীবনকে গ্রহণ করলেও প্রধানত শরৎচন্দ্রীয় ভাবনার একান্নবর্তী পরিবারকেই নতুন কালের পরিবেশে উপস্থিত করেছেন। তাঁর উপন্যাসের শহুরে মানুষগুলি—কি পুরুষ, কি মহিলা—সকলেই গার্হস্থ্য জীবন-ভাবনায় একনিষ্ঠ, এবং তারই সূত্রে তাদের স্বার্থ-নিঃস্বার্থ ভাবনা, লােভ, ঈর্ষা, নীচতা, উদারতা, মানবিক বােধবুদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। শহুরে জীবনের যে জটিলতা, যে নিষ্করুণ অবক্ষয়, যে নৈতিক অবধারিত অধঃপতন, অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে যে স্বাভাবিক রেষারেষি, তার পরিচয় আশাপূর্ণার সাহিত্যে প্রায় অনুপস্থিত। আশাপূর্ণা বলেছেন— “যা লিখেছি আমার দেখা মধ্যবিত্ত জীবনের গণ্ডি থেকেই দেখা।”

সমাজ সম্পর্কিত দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও আশাপূর্ণার একটি স্পষ্ট মতামত আছে। তিনি বলেন,- “তার (সাহিত্যিকের) দায়বদ্ধতা আছে সমাজের কাছে। সাহিত্যিকের কাজ উত্তরণের পথ দেখানাে। শুধু বানিয়ে লেখা নয়। আসলে সাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা। প্রতিকারের চিন্তা করাও সাহিত্যিকের কাজ নয়। সে কাজ সমাজ সংস্কারকের।… আমি কখনও ‘এইটা হওয়া উচিত একথা মনে করে কিছু লিখিনি। কী উচিত বলবার আমি কে?”

আশাপূর্ণার ভালােবাসার জগৎ তাঁর ছােটোগল্পের জগৎ। আশাপূর্ণার ছােটোগল্পের প্রাণ নিহিত আছে তার তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে সেইসঙ্গে ঈর্ষণীয় তার গল্প বলার ভঙ্তগি। তাঁর গল্পগুলিতে কাহিনি সহজ হলেও নিটোল। কিন্তু গল্পের মধ্যেই তার আবেদন সমাপ্ত হয় না। পাঠকের বােধের মধ্যে তার একটি অনুরণন চলতে থাকে। আশাপূর্ণা বলেন,- “উপন্যাস আমাকে অনেকটা প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তবু ছােটগল্পের ওপরেই আমার পক্ষপাত। … হয় তাে ছােটগল্পই আমার ‘প্রথম প্রেম’ বলে। এবং এখনও ছােট গল্প লিখতেই বেশি ভাল লাগে।” ক্ষুদ্র পাত্রস্থিত জলের মধ্যে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখার মতাে তাঁর ছােটোগল্পে প্রতিবিস্বিত হয় আমাদের চিরচেনা সমাজ-সংসার এবং মানুষ। ছােটোগল্পেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ এবং এই প্রকরণেই তার মনন ও মেধার উজ্জ্বলতম ও বৈচিত্র্যময় প্রতিফলন।

আশাপূর্ণা তাঁর ছােটোগল্পে চরিত্র এবং চরিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্ন নির্মমতম সত্যকে উদঘাটিত করে দেন। ‘ভয়’ গল্পে সাত-সন্তান মারা যাবার পর বৃদ্ধা জননী সাহেব ডাক্তার দেখাতে চান। মৃত্যুভয়ের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় তার সন্তান হারাবার দুঃখ। ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষকে ঘিরে তার মাতা ও বধূর অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হয় মানুষটির মৃত্যুতে। কিন্তু পুত্রশােকের ভাবালুতায় গল্প শেষ হয় না ; শেষ হয় পুত্রবধূর ওপর মায়ের জয়ােল্লাসের অস্ফুট ভয়াবহতায়। ‘আয়ােজন’ গল্পে নাতির প্রতি দাদুর স্নেহ এবং শিশুটির মায়ের মনােযােগ এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। এখানেও নাতির মৃত্যুকামনার মধ্যে দিয়ে দাদুর মনের তীব্র অহংতৃপ্তির বাসনার নগ্ন রূপ দেখা গেছে। বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতির চাপে আশাপূর্ণার গল্পে আমরা মানবিক সম্পর্কগুলিকে নির্মমভাবে ভেঙে যেতে দেখি। ‘স্মৃতিমন্দির’, ‘কসাই’, ‘স্থিরচিত্র’ প্রভৃতি গল্পেও তার প্রমাণ আছে। আবার তার ছােটোগল্পের অনেক নারীচরিত্রকে আমরা দেখি আত্মবিলােপের মধ্যে দিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করতে।

আশাপূর্ণার ছােটোগল্পে সমাজই মুখ্য। সামাজিক নানা সংস্কারের অনর্থক অত্যাচারের দিকটি তিনি তুলে ধরেন তার গল্পে। যে নারীরা অত্যাচারিত হয়, তারা সংস্কার-মুক্ত নয়। সমাজশৃঙ্খলিত অবস্থাই তাদের বিনষ্টির কারণ হয়ে ওঠে। যেমন দেখি ‘একটি মৃত্যু ও আরেকটি’, ‘পরাজিত হুদয়’, ‘কার্বন কপি’ প্রভৃতি গল্পে। ‘কার্বন কপি’, গল্পে নির্জন প্রবাসগৃহে পুরােনাে প্রণয়ীর উপস্থিতিতে রাত্রিবাস অর্ণব হয় আধুনিকা উত্তর-ত্রিশ ডিভাের্সীর পক্ষে। ‘পরাজিত হুদয়’ গল্পে ধর্ষিতা সন্তানকে কোল নিতে সাহস পান না আধুনিক বাবা-মা। কিংবা ‘বঞ্চক’ গল্পে জামাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও মা তরুণী কন্যাকে সংবাদ না দিয়ে তাকে উপহার দেন বিয়েবাড়ির একটি সন্ধ্যা। বাহ্যিক দিক থেকে আধুনিক হয়েও আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ যে এখনও পুরােনাে সংস্কারের সীমানা পেরােতে পারেনি, তার নানা দৃষ্টান্ত আশাপূর্ণা তুলে ধরেন কখনাে কৌতুকে, কখনাে নির্মমতার সঙ্গে ‘সবদিক বজায় রেখে’, ‘বে-আ’, ‘স্বর্গের টিকিট’, ‘বড় রাস্তা হারিয়ে’, ‘ঘূর্ণমান পৃথিবী’ প্রভৃতি গল্পে। আশাপূর্ণা দেবীর ছোট গল্প সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালের কথাসাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন মন্তব্য করেছেন— “বড়াে কথা ছােটো করে বলায় তিনি ওস্তাদ, মনুষ্যজীবনের বড় বড়াে ধাক্কাগুলিকে ছােটোগল্পের ছােটো পরিসরের মধ্যে ধরে ফেলায় তার অনায়াস নৈপুণ্য।”