সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বে প্রায় সাড়ে চার হাজার ভাষা বিদ্যমান তাদেরকে বিভিন্ন বর্গে বিভাজিত করলে মূল বারােটি ভাষাবংশ বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে মূল আর্যভাষা বা ইন্দো ইউরােপীয় ভাষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পৃথিবীর বহু অঞ্চলে যে সমস্ত আধুনিক ভাষার প্রচলন আছে তা মূলতঃ এই ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আর সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে এর অবদান অপরিসীম। সংস্কৃত, গ্রীক, লাতিন, জার্মান, ফরাসী, ইংরাজী, ইতালীয়, এমনকি বাংলা ভাষাও এই ইন্দো ইউরােপীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই ভাষাতত্ত্ববিদ পরেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন “সম্প্রতি হয়তাে বাঙলা ভাষা হাজার বছরে পা দিয়েছে কিন্তু বংশ কৌলীন্যে বা পৃথিবীর এক মহান ভাষা পরিবারের অধিকার অর্জন করেছে। এই ইন্দো ইউরােপীয় অর্থাৎ আদি উৎস থেকে বাংলার জন্ম হলেও বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেকগুলি স্তর পেরিয়ে তবেই সম্ভব হয়েছে।” আলােচনার মধ্য দিয়ে তার সত্যতা ধরা যাবে।

দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে ইন্দো ইউরােপীয় মূল আর্যভাষা-ভাষী জনগােষ্ঠীর আদি বাসস্থান ছিল। আনুমানিক ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই ইন্দো ইউরােপীয় ভাষার মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে তা থেকে দশটি প্রাচীন ভাষার বা শাখার জন্ম হয়। যথা- ১। ইন্দো-ইরানীয় ২। বালতাে-স্লাভিক ৩। আলবাণীয় ৪। আর্মেনীয় ৫। গ্রীক ৬। ইতালিক/লাতিন ৭। টিউটনিক/জার্মানিক ৮। কেলতিক ৯। তােমারীয় ১০। হি্তীয়।

এদের মধ্যে আর্যরা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাকে নিজেদের ভাষা বলে দাবী করতাে। এই সূত্রে ইন্দো ইরানীয় ভাষা গােষ্ঠীর উপর গুরুত্ব আরােপ করাই সমীচীন। ইন্দো ইরানীয় ভাষা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য। ইরানীয় শাখাটি ইরান পারস্য বিস্তার লাভ করে। এর প্রাচীনতম সাহিত্য কীর্তি হােল আবেস্তা নামক ধর্মগ্রন্থ (৮০০খ্রীঃপূঃ)। আর ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ভারতীয় আর্যশাখাটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। এই ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তার ক্ষেত্র হােল ১৫০০ খ্রীঃ পূঃ- ২০০০খ্রীঃ পর্যন্ত অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার বছর পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে যে কোন ভাষার অসংখ্য বিবর্তন সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। তাই ঐতিহাসিক বিবর্তনের ভেদে ভারতীয় আর্য ভাষাকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়। যথা-

  • প্রাচীন ভারতীয় আর্য (OIA) আনুমানিক ১৫০০-৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত। এ যুগের ভাষার নাম বৈদিক/সংস্কৃত ভাষা। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ঋগ্বেদ সংহিতা।

  • মধ্য ভারতীয় আর্য (MIA) আনুমানিক ৬০০ খ্রীঃ পূঃ- ৯০০ খ্রীষ্টাব্দ, এ যুগের ভাষার নাম পালি প্রাকৃত অপভ্রংশ অশােকের শিলালিপি সংস্কৃত নাটক জৈন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। এ যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি

  • নব্যভারতীয় আর্য (NIA) আনুমানিক ৯০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এর সময় সীমা। এ যুগের ভাষার নাম বাংলা হিন্দী মারাঠী পাঞ্জাবী ইত্যাদি সাম্প্রতিক কালের সাহিত্যই এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার দুটি রূপ ছিল এক সাহিত্যিক (বৈদিক/ছান্দ ভাষা) দুই কথ্য ভাষা) সাহিত্যিক ভাষাটি সাহিত্য কীর্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কথ্য ভাষার মধ্যে বিবর্তন সংঘটিত হওয়ার চারটি আঞ্চলিক উপভাষার সৃষ্টি হয় ১। প্রাচ্য ২। উদীচ্য ৩। মধ্য দেশীয় দাক্ষিণাত্য লােক যুগ। এই উপভাষাগুলি স্বাভাবিক ভাবে পরিবর্তিত হলে প্রাকৃতিক ভাষার সৃষ্টি হয় যাকে মধ্যভারতীয় আর্যহিসাবে চিহ্নিত করা যায়। আবার প্রাকৃত ভাষার মধ্যে বিবর্তন সাধিত হলে পাঁচটি উপভাষার সৃষ্টি হয়- (ক) পৈশাচী (খ) মহারাষ্ট্রী (গ) শেীরসেনী (ঘ) অর্ধমাগধী (ঙ) মাগধী এটাই প্রাকৃত ভাষার বিবর্তনের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে এসে পাই অপভ্রংশ আর শেষ স্তরে পাই ‘অবহ’-টঠ ভাষা। যাই হােক, অপভ্রংশ অবহটঠর পরে ভারতীয় আর্য ভাষা তৃতীয় যুগে পদার্পন করলাে অর্থাৎ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষায় যার শুভ সূচনা ৯০০ খ্রীষ্টাব্দ।

এই প্রসঙ্গে আলােচ্য বিষয়টি আরাে সহজ করার জন্য বলা ভালাে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে দুটি রূপ বেরিয়ে এসেছিল সাহিত্যিক রূপ ও কথ্য রূপ। এই কথ্যরূপ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে চারটি উপশাখায় বিভক্ত হয়েছিল তার মধ্যে প্রাচ্য রূপটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। এক প্রাচ্যমধ্যা আর একটি প্রাচ্য। এই প্রাচ্য অংশ থেকে সৃষ্টি প্রাকৃত ভাষার যে পাঁচটি উপভাষা আছে তার মধ্যে মাগধী প্রাকৃত উপভাষাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মাগধী প্রাকৃত অপভ্রংশ অবহটঠর মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হওয়ার পর তা দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়- ১। পশ্চিম ২। পূর্বমাগধী অপভ্রংশ অবহটঠর- এর পূর্বী অংশকে আরাে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায় ১। বঙ্গ অসমীয়া ২। ওড়িয়া। ওড়িয়া ভাষাটি সাম্প্রতিক কালে উড়িষ্যার ভাষা, আর বঙ্গ অসমীয়া পরে দুটি ভাষাতে বিভক্ত হয়ে যায় এক অসমীয়া, দুই বাংলা। এই ভাবেই বৈদিক আর্য ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে।