মূল ইন্দো ইউরােপীয় বা মূল আর্যভাষার স্পৃষ্ঠ ধ্বনির পরবর্তী রূপান্তরের উপর ভিত্তি করে এই বংশের ভাষা গুলিকে দুটিগুচ্ছে ভাগ করা হয়েছে যথা- সতম (Satam) ও কেন্তুম (Centum) এই সতম শাখা গুলির মধ্যে প্রাচীন সাহিত্য বিশেষ সমৃদ্ধ হল ইন্দো ইরানীয় শাখা। মূল ইন্দো ইউরােপীয় ভাষার যে শাখাটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষও ইরানে প্রবেশ করে সেই শাখাটিকে ইন্দো ইরানীয় শাখা বলে।
ইন্দো ইরানীয় শাখার লােকেরা নিজেদের আর্য বলে গর্ব করতেন। আর্য শব্দটি সঙ্কীর্ণ অর্থে এই শাখাটিকে বােঝাবার জন্যে কখনাে কখনাে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ব্যাপক অর্থে আর্য শব্দে ইন্দো ইউরােপীয় ভাষাও ইন্দো ইউরােপীয় জাতিকেই বােঝায়। ডঃ সুকুমার সেনের মতে- “ইন্দো ইরানীয় শাখাভাষীরা নিজেদের অর্য বা আর্য বলিয়া গৌরব বােধ করিত। তাই ইহার নামান্তর আর্য শাখা। আর্য আসিয়াছে অর্য হইতে। মানে বিদেশীয় আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যাটি গ্রহণীয় হতে পারে কারণ আর্যরাও ভারতের বা ইরানের আদি বাসিন্দা নয়। তাঁরাও বিদেশী।”
তবে বিদেশীরা নিজেদের বিদেশীয় বলবেন এটা স্বাভাবিক নয় এদেশের আর্য পূর্ব অধিবাসী দ্রাবিড় অস্ট্রিকরা যদি আর্যদের বিদেশীয় বলতেন তাহলে সেটাই বেশী স্বাভাবিক হত। কিন্তু আর্য শব্দটি দ্রাবিড় বা অস্ট্রিক শব্দ নয়। আর্য শব্দটি এসেছে ঋ (অব) ধাত থেকে (√ঋ + ন্যৎ = আর্য। √ঋ গমন করা to go)। আর্য গমনশীলতা, গতিশীলতা। যে গমনশীল সে গতিশীল।
ভারতবর্ষে আসার আগে আর্যরা যাযাবর ছিলেন, বনের পশু প্রাণী শিকার করে, অরণ্যের ফলমূল খেয়ে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখনাে কৃষি নির্ভর জীবন যাত্রা গড়ে ওঠেনি। কৃষি নির্ভর না হলে জীবন স্থিতিশীল হয় না, বনের পশু প্রাণী ফলমূলের সন্ধানে তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। জীবন ছিল স্থিতিহীন গতিশীল। এই গতিশীলতা তাঁদের জীবন চলার অঙ্গ- জীবনধর্মের মূলবৈশিষ্ট্য। তাই গতিশীল গােষ্ঠী অর্থে আর্য নামটি গভীর তাৎপর্যবাহী।
আবার সংস্কৃত গ্রীক লাতিন ভাষাবিদ মনীষী শ্রীঅরবিন্দ আর্যদের জীবন ধারার সঙ্গে যুক্ত আরাে একটি তাৎপর্য আবিষ্কার করেছেন। আর্য নামের মধ্যে ‘আর্য’ নামটি এসেছে ‘অব’ থেকে। ‘অব’ এর অর্থ সংগ্রাম করা সংগ্রামী শক্তি। সেই আদি কালে প্রকৃতির নানা বিরােধী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবন ধারণ করতে হত। সুতরাং ‘অব’ থেকে নিষ্পন্ন ‘আর্য’ শব্দের অর্থ সংগ্রামী শক্তি। সংগ্রামী জনগােষ্ঠী অর্থাৎ জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে শ্রী অরবিন্দ ‘আর্য’ নামের এই গভীরতম তাৎপর্য উদঘাটন করেছেন।
আবেস্তা: যাই হােক, ইন্দো ইরানীয় শাখার যে উপশাখাটি ইরানে চলে যায় তা থেকে ক্রমে দুটি প্রাচীন ভাষার জন্ম হয় ‘আবেস্তীয়’ (Avestan) ও প্রাচীন পারসীক (Old per Sim)। আবেস্তীয় ভাষা হল ধর্মাকার্য জরথুশত্র পন্থী পারসীকদের মূলধর্মগ্রন্থ আবেস্তা’র ভাষা। আবেস্তার প্রাচীন তম অংশ হল গাথা (Ghata) (খ্রীঃপূঃ অষ্টম শতাব্দী)। ইরানীয় উপশাখায় অন্য ভাষাতে প্রাচীন পারসীকের নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন পারস্যের দুয়ামেমীয় রাজবংশের সম্রাট দারমরহুশ (খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ ৫ম শতাব্দী) এবং তাঁর পুত্র খশয়শারি (Xerxes) শিলালিপি ও ধাতু লিপিতে। এই প্রাচীন পারশিক থেকেই মধ্যযুগে পহবী ভাষায় এবং তা থেকে আধুনিক যুগে ইরানের ভাষা ফারসীর জন্ম। ইরানীয় বংশের অন্য দুটি আধুনিক ভাষা হােল আফগানিস্থানের ভাষা পশতাে বা পখতাে এবং বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুকী।
পারসিক: ইন্দো ইরানীয় শাখার যে উপশাখাটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তাকেই আমরা ভারতীয় আর্যভাষা বলে থাকি। এই শাখাটি প্রাচীনতম রচনা বেদ (আনুমানিক খ্রীঃপূঃ ১২০০) বেদের মধ্যে আবার সবচেয়ে প্রাচীন অংশ হলাে ‘ঋগেদ সংহিতা’ এই ঋগেদ সংহিতার ভাষা ও দেব দেবীর সঙ্গে আবেস্তার গাথা অংশের ভাষা ও দেবদেবীর সাদৃশ্য ভারতীয় ও ইরাণীয় আর্য শাখার ঘনিষ্ট সম্পর্ক প্রমাণ করে। বৈদিক ভাষা থেকে ক্রমে সংস্কৃত প্রাকৃত ও পালি ভাষার জন্ম হয়। এবং প্রাকৃতের শেষ স্তর অপভ্রংশ অবহট্র হয়ে আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা বাংলা, হিন্দী, মারাঠী, পাঞ্জাবী ইত্যাদির জন্ম হয়।
Leave a comment