শব্দমাত্রেরই অর্থ আছে এবং সেই অর্থ যে দেশ-কাল-পাত্রের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়েই চলছে, যে কোন ভাষায় তার নিদর্শনের অভাব নেই। আচার্য সুকুমার সেন বলেন, “শব্দের অর্থ পরিবর্তন কাহিনী বিচিত্র এবং মনােরম। ইহা হইতে মানবমনের চিন্তাধারার বিবিধ ও বিচিত্র বিবর্তনের নির্দেশ পাওয়া যায়।”
মানব-মনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শব্দের অর্থ যে কত কী কারণে এবং কতরকমভাবে পরিবর্তিত হয়, তার ইয়ত্তা নেই। যে সমস্ত কারণে শব্দের অর্থ পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাদের মধ্যে ইতিহাস উপাদান একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলে গণ্য হাতে পারে। এ বিষয়ে আচার্য সুকুমার সেন যে অমূল্য মন্তব্য করেছেন, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
তিনি বলেন, “শব্দের অর্থ পরিবর্তনের মধ্যে ভাষাসম্প্রদায়ের অতীত ইতিহাসের ও চিন্তাধারার আভাস ইঙ্গিত লুকানাে থাকে। তাই শব্দের অর্থ-পরিবর্তনের ইতিহাস আলােচনা করিয়া আমরা প্রাচীন সামাজিক রীতিনীতি বস্তুব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে এমন অনেক কিছু জানিতে পারি যাহা অন্যত্র মিলে না।”
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস আলােচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন শব্দ বিশ্লেষণ করলেই তত্তৎ জাতির প্রাচীন ইতিহাসের বহু বিষয় আমাদের গােচরীভূত হয়ে থাকে এবং তা থেকেই আমরা তাদের আচার-ব্যবহার কিংবা রীতিনীতি বিষয়ে যেমন অনেক বিষয় জানতে পারি তেমনি তাদের সমকালীন চিন্তাধারারও পরিচয় পাই; আবার তারা কোন বস্তু কী উদ্দেশ্যে কেমনভাবে ব্যবহার করেছেন, সে বিষয়েও একটা সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারি। নিম্নে কতকগুলি শব্দের অর্থ-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা উক্তিটির যাথার্থ্য প্রমাণ করতে পারি।
‘কলম’ শব্দের মূল অর্থ ‘শর/খাগ’— এটিই আদিতে লেখনীরূপে ব্যবহৃত হতাে এখন যে কোন বস্তু-নির্মিত লেখনী কলম-নামে অভিহিত হয়। এরূপই ইংরেজি ‘Pen’ শব্দের মূল Penna-র অর্থ ‘পালক’—এটিই ছিল তাদের আদি লেখনী, এখন অর্থ-পরিবর্তনের ফলে যে কোন বস্তু-নির্মিত লেখনীই Pen-রুপে অভিহিত হয়।
ইন্দো-য়ুরােপীয় ভাষায় fekus (ফেকুস) থেকে সংস্কৃতে ‘পশু’ এবং ইংরেজিতে ‘fee’ (ফী) হয়েছে সম্ভবতঃ একসময় বুদ্ধিজীবীর শ্রমের বিনিময় মূল্য ছিল পশুই, এক্ষণে বস্তু ব্যবহার লােপ পেলেও অর্থটি রয়ে গেছে। ‘বিবাহ, পরিণয়, পাণিগ্রহণ, প্রভৃতি শব্দগুলির মধ্যে যে বলপ্রয়ােগের ভাব রয়ে গেছে, তা থেকে অনুমান করা চলে যে এক সময় আমাদের দেশে ‘বলপূর্বক কন্যাগ্রহণ’ বা আসুরবিবাহ রীতিই প্রচলিত ছিল। এখন সেই রীতি পরিত্যক্ত হলেও শব্দগুলি রয়ে গেছে। ‘তুরুক’ বলতে গ্রামাঞ্চলে এখনও সাধারণভাবে মুসলমানকে বুঝিয়ে থাকে, কিন্তু শব্দটি ‘তুর্ক’ বা ‘তুর্কী’ থেকে জাত। এক সময় মুসলমান তুর্কী সৈন্যদের সম্বন্ধে বিভীষিকার স্মৃতি বর্তমান থাকাতেই শব্দটি এখনও চালু রয়েছে। কাচের তৈরি জলপাত্র ‘গ্লাস’ এদেশে ইংরেজ কর্তৃক আনীত হয়েছিল। এখন বাঙলায়ও যে কোন ধাতুনির্মিত জলপাত্রও গ্লাস-রূপে অভিহিত হয়। নামটি থেকেই বােঝা যায়, মুলে এটি কাঁচনির্মিত হতাে। তেমনি ‘কালী’র রং যে আদিতে ছিল শুধু ‘কালাে’, ‘তুলি’ যে শুধু ‘তুলাে দিয়েই তৈরি হতো কিংবা আদিতে ‘তিল’ থেকে উৎপন্ন ‘তৈল’ই ছিল শুধু ব্যবহার্য- এ সব তথ্য আমরা জানতে পারি শব্দার্থের পরিবর্তন থেকেই।
Leave a comment