পথের দাবি:
শরৎচন্দ্র-রচিত গ্রন্থ ‘পথের দাবি’। ‘পথের দাবি’ একটি রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লবের উপন্যাস। অপূর্ব চাকরিসূত্রে ব্রহ্মদেশে যায় এবং সেখানে ভারতীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সেখানে সব্যসাচী তলােয়ারকর, সুমিত্রা প্রভৃতি অনেকের সঙ্গে যুক্তভাবে একটা সমিতি গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য, বিপ্লবের সহায়তায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ। এই মূল কাহিনীটি অবলম্বন যার বিচিত্র চরিত্রের টানাপােড়েনে দুটি মতবাদের সংঘর্ষ এতে গতি সঞ্চার করেছে। বিপ্লবাত্মক উপন্যাস রূপে শরৎচন্দ্রের এই গ্রন্থখানি সর্বাধিক পরিচিত—ব্রিটিশ সরকার এটিকে বাজেয়াপ্ত করেছিল বলেই অবশ্য এর প্রচারও অধিক গুরুত্ব লাভ করে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই বইটি, গােপন আদান-প্রদানের মাধ্যমে যুব-সমাজে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বইটিতে ভিন্ন মতবাদমূলক প্রচুর তর্ক-বিতর্ক স্থান পেয়েছে।
পল্লীসমাজ:
গ্রন্থটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত হয়েছে। ‘পল্লীসমাজ’ একটি সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাস। রমেশ ও বিধবা রমার পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপােড়েনে কাহিনীটি গড়ে উঠলেও পল্লীসমাজ ও একটা নির্দেশক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসটি শরৎচন্দ্রের বহুপঠিত উপন্যাসগুলির অন্যতম। রমা ও রমেশের পরস্পরের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ এবং বাইরে শত্রুতা—এই বৈপরীত্যের সমাবেশ উপন্যাসে গতি সঞ্চার করেছে। তবে গ্রন্থে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য এর গ্রাম্য সমাজ-চিত্র। এই কারণেই প্রধানতঃ গ্রন্থটি বাঙলা সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হয়।
চরিত্রহীন:
শরৎচন্দ্র ‘চরিত্রহীন’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি একটি মনস্তত্ত্বমূলক সামাজিক উপন্যাস। শিক্ষিত ভদ্র যুবক সতীশ ও মেসের ঝি সাবিত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য হলেও উপন্যাসে সাবিত্রীর বিপরীতধর্মী চরিত্রের কিরণময়ী একটা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। গ্রন্থের নামকরণের মধ্যে সমকালীন সমাজব্যবস্থার প্রতি যে ব্যঙ্গপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে, তার প্রতি কৌতূহলবশতঃই পাঠককে আগ্রহের সঙ্গে গ্রন্থটি পড়ে যেতে হয়। এতে কয়েকটি চরিত্র-লক্ষণযুক্ত পাত্র-পাত্রী থাকলেও, যাকে আপাতদৃষ্টিতে চরিত্রহীন বলে মনে করা হয়, সে যে চরিত্রহীন নয়, সেই পর্যন্ত তা দেখতে পেয়ে পাঠক সম্ভবতঃ খুশিই হয়ে উঠেন।
শ্রীকান্ত:
‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্র-রচিত চারিখণ্ডে বিভক্ত একখানি গ্রন্থ। শ্রীকান্তকে সাধারণভাবে একটি ‘আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস’ বলে উল্লেখ করা হলেও একে কোন একটি নির্দিষ্ট ফর্মে বা রূপকল্পে পরিচিত করা সম্ভব নয়। শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী কাহিনীকে এর কেন্দ্রীয় কাহিনী বলে গ্রহণ করলেও এর মধ্যে যেমন নিটোলতা নেই, তেমনি এই কাহিনীটির আগে এবং পরে শ্রীকান্তের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। বাঙলা সাহিত্যে শ্রীকান্ত এক অভিনব রচনা। একে যতটা উপন্যাস বলা যায়, ততটাই যেন ভ্রমণকাহিনী এবং ততােধিক যেন অসংখ্য ছােটগল্পের সমষ্টি। বস্তুতঃ গ্রন্থটিকে শ্রীকান্ত-নামক সুতােয় গাঁথায় অসংখ্য চিত্র-পুষ্পের মালা বলে গ্রহণ করতে পারি। ‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ রচনা বলেই সাধারণতঃ স্বীকৃত হয়ে থাকে।
মহেশ:
‘মহেশে’র রচয়িতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মহেশ’ বাঙলা সাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ ছােটগল্প। মুসলমান চাষী গফুর অভাবের তাড়নায় ক্ষিধের জ্বালায় একদিন ক্রদ্ধ হয়ে তার হালের বলদ মহেশকে আঘাত করে, ফলে মহেশের মৃত্যু হয়। সেই অপরাধে হিন্দু জমিদার তাকে ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে সর্বস্বান্ত করলে গফুর একমাত্র কন্যার হাত ধরে চটকলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অদৃষ্টের পরিহাস গফুর যখন মহেশের খাবারের জন্য জমিদারের নিকট ধর্না দিয়েছিল, তখন হিন্দু জমিদার গাে-মাতার জন্য বিন্দুমাত্র দরদ অনুভব করেন নি। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানবিকতার স্বপক্ষে শরৎচন্দ্রের মর্মবেদনা এইভাবেই ‘মহেশ’ নামক ছােটগল্পের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘মহেশ’ মানবিকতার স্বপক্ষে একটি সাধারণ দলিল বলেই আপন মাহাত্ম্য স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
আলালের ঘরের দুলাল:
প্যারীচাদ মিত্র ‘টেকচাদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থটিই প্রথম উপন্যাস জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে, লেখক নিজেও একে বাঙলার প্রথম উপন্যাস বলে দাবি করেন। যারা এ বিষয়ে ভিন্ন মত পােষণ করেন, তারাও এটিকে সমাজ-জীবনের ব্যঙ্গধর্মী নক্সার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে স্বীকার করেন। সমকালীন কলকাতার বিভিন্ন শ্রেণীর নরনারীর চিত্র নিয়ে প্যারীচাদ যে কাহিনী রচনা করেছেন, তাতে কাহিনী অপেক্ষাও চিত্রগুলিই প্রধান হয়ে উঠেছে। আলােচ্য গ্রন্থটিতেই বাঙলা কথাসাহিত্যে প্রথম উপন্যাসের আদর্শ ফুটে উঠেছে এবং ভাষা ব্যবহারে লেখক সাধুরীতি মেনেও মৌখিক ভাষার যে শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেই ধারা অনুসৃত হলে বাঙলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রয়ােগ এত বিলম্বিত হতাে না। এ সমস্ত ছাড়াও সমকালীন কলকাতার এমন বাস্তব সমাজচিত্র অন্যত্র দুর্লভ।
দুর্গেশনন্দিনী:
গ্রন্থটি বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রচিত। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ একটি যথার্থ রােমান্সধর্মী উপন্যাস। আকবরের সেনাপতি মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহের সঙ্গে গড়মান্দারণ দুর্গাধিপতির কন্যা তিলােত্তমা এবং উড়িষ্যাধিপতি কতলু খাঁর কন্যার প্রণয়কাহিনীর ত্রিকোণ দ্বন্দ্বই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিমলা-চরিত্র, যার প্রতি জগৎসিংহ স্বয়ং আকৃষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত এটি প্রথম উপন্যাস এবং বাঙলা সাহিত্যেও এটিই প্রথম যথার্থ উপন্যাস। এতে কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী এবং চরিত্র থাকা সত্ত্বেও কল্পনা ও রােমান্সের আতিশয্য এর গুণ অনেকটা খর্ব করেছে, কিন্তু সমকালে এর যথেষ্ট সমাদর ছিল। বাংলার প্রথম উপন্যাসরূপেই এর মর্যাদা চিরকাল থাকবে।
মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত টি রচনা করেন। গ্রন্থটি কথাসাহিত্যের আঙ্গিকে রচিত একটি ব্যঙ্গাত্মক রসরচনা। এক অশিক্ষিত হা ঘরের ছেলে মুচিরাম গুড় শাসকদের পদলেহনের জোরে কীভাবে ডেপুটি ও রাজাবাহাদুর হলাে, এই কাহিনীটিই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। আলােচ্য গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র শুধু হাস্যরস ও ব্যঙ্গই পরিবেষণ করেন নি, তার অন্তরালে অপমান, লাঞ্ছনা ও বেদনার জ্বালাও বিদ্যমান ছিল। গ্রন্থটি এই কারণেই উল্লেখযােগ্য।
বিষবৃক্ষ:
‘বিষবৃক্ষ’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিষবৃক্ষ একটি পা বারিক সামাজিক বিষাদান্তক উপন্যাস। নায়ক নগেন্দ্রনাথ দত্ত পত্নী সূর্যমুখীকে নিয়ে সুখে ঘর সংসার করলেও এক সময় আশ্রিতা কুন্দনন্দিনী নাম্নী এক বিধবার রূপমােহে পড়লে সূর্যমুখী নিজেই উদ্যোগী হয়ে নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর বিবাহ দেন এবং স্বয়ং গৃহত্যাগ করেন। সূর্যমুখীকে আবার ফিরিয়ে আনলেও ভাঙা মন আর জোড়া লাগেনি এবং কুন্দনন্দিনীর আত্মহত্যায় সমস্যার সমাধান ঘটে-এইটিই কাহিনীর মূল বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম পারিবারিক-সামাজিক উপন্যাসের কারণেই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
কৃষ্ণকান্তের উইল:
গ্রন্থটি বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রচিত। এটি একটি পারিবারিক সামাজিক বিষাদান্তক উপন্যাস। জমিদার কৃষ্ণকান্তের উত্তরাধিকারী গােবিন্দলাল সাধ্বী স্ত্রী ভ্রমরকে নিয়ে সুখে দিন কাটালেও অন্যাক্তা বালবিধবা রােহিণীর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং শেষ পর্যন্ত রােহিণীকে হত্যা করে ভ্রমরের কাছে ফিরে এসে আর তাকেও ফিরে পায় নিএই ট্র্যাজেডিই গ্রন্থের বিষয়। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ এবং সর্বার্থে প্রথম সার্থক উপন্যাস, এটি পরবর্তী কালের যাবতীয় পারিবারিক উপন্যাসের আদর্শরূপে গৃহীত হয়। বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই সমস্ত কারণেই এর চিরস্থায়ী আসন।
আনন্দমঠ:
গ্রন্থটি বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রচিত। এটি একটি ইতিহাসাশ্রিত দেশাত্মবােধক উপন্যাস। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কালে উত্তরবঙ্গে যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, তারই স্থানকালােপযােগী কিছু পরিবর্তন সাধন ও স্বীয় কল্পনা যােগ করে বঙ্কিমচন্দ্র এর কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র এতে কিছু তত্ত্বও যােগ করেছেন। দেশাত্মবােধের জাগরণ এবং বন্দেমাতরম সঙ্গীতটিই প্রধানতঃ আনন্দমঠকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে।
রাজসিংহ:
বঙ্কিমচন্দ্র ‘রাজসিংহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। রাজসিংহ একটি ঐতিহাসিক মিলনান্তক উপন্যাস। রাজপুত কন্যা চঞ্চলকুমারীকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মােগল সম্রাট ঔরঙ্গজীব এবং রাজপুত বীর রাজসিংহের মধ্যে বিরােধ ও যুদ্ধ, ফলে রাজসিংহের জয়লাভ ও চঞ্চলকুমারীকে বধূরূপে প্রাপ্তি-এই ঐতিহাসিক বিষয়টিই উপন্যাসের উপজীব্য। ‘রাজসিংহ’ বঙ্কিমচন্দ্রের সার্থক এবং যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস। এতে ঐতিহাসিকতা এবং উপন্যাস ধর্ম উভয়ই যথাযথভাবে উপস্থিত থাকায় বাঙলা সাহিত্যে এটি আদর্শ ঐতিহাসিক উপন্যাস-বুপে সমাদৃত হয়।
নীলদর্পণ:
আলােচ্য নীলদর্পণ নাটকটির রচয়িতা প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। তবে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ কালে গ্রন্থকারের কোন নাম দেওয়া হয়নি, লেখা ছিল ‘নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর প্রজানিকর ক্ষেমকরেণ কেনচিৎ পথিকেনাভিরচিতম। পরে গ্রন্থকারের নাম জানা যায়।
গ্রন্থটি রাজনীতি অর্থনীতি-নির্ভর একটি সামাজিক পারিবারিক নাটক। সমসাময়িক কালে নীলচাষের জন্য নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং ফলে কয়েকটি সৎ গৃহস্থ পরিবারের চিত্র রূপায়ণের দ্বারা সমাজের বিশেষতঃ শাসকদের এই অত্যাচারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ও তার প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যেই নাটকটি রচিত হয়। বাংলা সাহিত্যে নীলদর্পণ নাটকেই সর্বপ্রথম রূঢ় বাস্তবতার রূপায়ণ দেখা যায় এবং পরবর্তী বাস্তবধর্মী নাটকের পথ প্রদর্শকও এটিই। ইংরেজি সাহিত্যে Uncle Tom’s Cabin-এর যে স্থান, বাঙলা সাহিত্যে ‘নীলদর্পণেরও সেই স্থান প্রাপ্য। এই নাটক রচনা এবং অভিনয়ের ফলে নীলকরদের বিরােধিতায় দেশময় যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত বিলেতে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে নীলকরদের অত্যাচার অনেকাংশে প্রশমিত করা হয়, তার কৃতিত্বও অনেকাংশে নাটকটিরই প্রাপ্য।
সধবার একাদশী:
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র সধবার একাদশী’ নাটকটির রচয়িতা। ‘সধবার একাদশী’ তিন অঙ্ক যুক্ত একটি প্রহসন জাতীয় নাটক। উনিশ শতকীয় কিছু ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত উচ্ছল প্রকৃতির, মদ্যাসক্ত, কদাচারী কিছু যুবক কীভাবে সমাজ-জীবনকে কলুষিত করেছিল, এজাতীয় সামাজিক বিষয় ও সমস্যা নিয়ে নাটকটি রচিত হয়েছে। আলােচ্য নাটকটির বাস্তবতা-ভিত্তিক চিত্রাঙ্কনে, কয়েকটি অসাধারণ চরিত্রসৃষ্টিতে এবং শিল্পগুণে নাট্যকার নাটকটিতে তার নাট্যপ্রতিভার চরম উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন। নাটকে কিছুটা উদ্দেশ্যমূলকতা থাকা সত্ত্বেও এটিকেই দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তিরূপে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
প্রফুল্ল:
‘প্রফুল্ল’ গ্রন্থটি নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘােষ-কর্তৃক রচিত। এটি একটি পারিবারিক সামাজিক বিষাদান্তক নাটক। নাটকটির বিষয়বস্তু তৎকালীন সমাজ-জীবন থেকে গৃহীত হয়েছে। এক স্নেহান্ধ অথচ দুর্বলচরিত্র সম্পন্ন গৃহস্বামী কীভাবে ভাগ্য, কর্ম এবং বুদ্ধির দোষে সর্বহারা হলেন, ‘তার সাজানাে বাগান শুকিয়ে গেল’—তারই একটি আবেগঘন বিষাদময় চিত্র গ্রন্থটিতে অঙ্কিত হয়েছে। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র স্বয়ং অভিনেতা এবং নাট্যশিক্ষকও ছিলেন। তিনি অসংখ্য নাটক রচনা করেন, তবে তার অভিনয়গুণে এখানিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেকে এটিকে ‘ট্র্যাজেড়ি’ বলে মনে করলেও এটি আসলে ‘বিষাদান্তক’ এবং অতিনাটকীয়তায় পূর্ণ। তবু মঞ্চসাফল্যের জন্য এটি আজও বাঙলা সাহিত্যে যথেষ্ট সমাদৃত হয়ে থাকে।
জমিদার-দর্পণ:
মীর মােশাররফ হােসেন ‘জমিদার দৰ্পণ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি একটি সামাজিক নাটক। নাম থেকেই অনুমান করা যায়, তৎকালীন জমিদারদের অত্যাচার কাহিনীই এর মূল বিষয়। গ্রন্থটি যে ‘নীলদর্পণে’র অনুসরণে রচিত হয়েছিল, তা যেমন নাম থেকে তেমনি কাহিনী থেকেও বােঝা যায়। গ্রন্থে হিন্দু-মুসলিম-সম্পর্ক-বিষয়ে গ্রন্থকার যথেষ্ট সতর্ক না থাকায় বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন যে বইটির বিতরণ ও বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়া প্রয়ােজন। তবে নাটকটিকে তিনি ভাল বলে স্বীকার করেছেন। সেকালের মুসলিমদের মধ্যে মীর সাহেবই প্রথম নাট্যকার এবং ‘জমিদার দর্পণ’ তার শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি বলেই বাঙলা সাহিত্যে এটি উল্লেখযােগ্য।
নবান্ন:
‘নবান্ন’ নাটকের রচয়িতা বিজন ভট্টাচার্য। এটি একেবারে খাঁটি বাস্তবধর্মী শ্রমিক-কৃষকদের জীবন সমস্যা অবলম্বনে রচিত সামাজিক নাটক। মেদিনীপুর অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের শ্রমিক কৃষক নরনারীদের নানাবিধ সমস্যাই এই নাটকের বিষয়। বিজন ভট্টাচার্য বাঙলাদেশে নবনাট্য আন্দোলন তথা গণনাট্যের পথিকৃৎ। তার ‘নবান্ন’ নাটকেই সর্বপ্রথম গণজীবনকে নাটকের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেন। এর দলগত অভিনয়রীতি, মঞ্চসজ্জা, গঠন কৌশল, নির্মাণরীতি, চরিত্রসৃষ্টি সবই স্বতন্ত্র যে নবান্ন’র আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই বাঙলা নবনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এই সমস্ত কারণে বাঙলা-সাহিত্যের ইতিহাসে ‘নবান্ন’ চিরভাস্বর রূপেই বিরাজিত থাকবে।
শর্মিষ্ঠা:
‘শর্মিষ্ঠা’ মধুসূদন রচিত প্রথম বাঙলা গ্রন্থ। এটি একটি পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত নাটক। মহাভারতের প্রসিদ্ধ যযাতি-শর্মিষ্ঠা-দেবযানীর পারস্পরিক সম্পর্ক নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয়। শর্মিষ্ঠা মধুসূদন রচিত প্রথম বাঙলা গ্রন্থ, প্রথম নাটক এবং বাঙলা ভাষায় পাশ্চাত্ত্য রীতিতে রচিত প্রথম নাটক। পূর্ববর্তী সব নাটকই সংস্কৃত রীতির অনুবর্তী ছিল। মধুসূদনই প্রথম সম্পূর্ণ পাশ্চাত্ত্য রীতি প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তী বাঙলা নাট্যধারা ঐ রীতিতেই প্রবাহিত হয়। এই কারণেই মধুসূদনের এই প্রথম প্রচেষ্টাটি সাহিত্যিক উৎকর্ষে কিছু উণ হওয়া সত্ত্বেও বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
কৃষ্ণকুমারী:
গ্রন্থটি মধুসূদন কর্তৃক রচিত হয়। কৃষ্ণকুমারীকে একটি ঐতিহাসিক এবং বিষাদান্তক অর্থাৎ ট্র্যাজিডি বলে অভিহিত করা চলে। কর্ণেল টডের Annals and Antiquities of Rajasthan অবলম্বনে মূল কাহিনীটি গ্রহণ করা হলেও নাট্যকার প্রয়ােজনমতাে কিছু কল্পনাও মিশ্রিত করে কাহিনীটি গড়ে তুলেছেন। রাজা ভীমসিংহের কন্যা কৃষ্ণকুমারীর পাণিপ্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন দুই রাজপুত রাজা মানসিংহ ও জয়সিংহ। যে কোন একজনকে প্রত্যাখ্যান করলেই তার ফল হবে বিষময়। এই সমস্যা সমাধানের ভার নিলেন স্বয়ং কৃষ্ণকুমারী, আত্মহত্যা করে সব সমাধান করে দিলেন। যথার্থ পাশ্চাত্ত্য রীতিতে রচিত সার্থক প্রথম ট্র্যাজেডি নাটক এই ‘কৃষ্ণকুমারী’, মধুসূদনের নাটকসমূহের মধ্যেও এটিই শ্রেষ্ঠ এই কারণেই বাঙলা সাহিত্যে এর আসন।
জনা:
‘জনা’ গ্রন্থটি গিরিশচন্দ্র ঘােষ কর্তৃক রচিত। ‘জনা’ একটি পৌরাণিক ভক্তিরসাশ্রিত নাটক। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে স্বামী নীলধ্বজকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে জনার প্রবর্তনা ও পরবর্তী ঘটনা, শেষ পর্যন্ত জনার মৃত্যু মােটামুটি এই বিষয় অবলম্বনে নাটকটি রচিত হয়েছে। ‘জনা’ নাটকের বিষয়বস্তু কাশীরাম দাসের মহাভারত’ এবং মধুসূদন-রচিত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রটি; তবে লেখক কল্পনার সহায়তা নিয়েছেন যথেষ্ট। গিরিশচন্দ্রের নাটকসমূহের মধ্যে এটি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপেই পরিচিত।
পদ্মিনী উপাখ্যান:
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। এই কাব্যটি একটি আখ্যায়িকা কাব্য অথবা শিথিলভাবে বলা চলে, আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য-জাতীয় কাব্যধারার এইটিই প্রথম কাব্য। গ্রন্থের বিষয়, পাঠান সুলতান আলাউদ্দিন ও চিতা রাজমহিষী পদ্মিনীর কাহিনী। টডের রাজস্থানের ইতিহাস থেকে কাহিনীটি গ্রহণ করা হলেও কাহিনীটি সর্বাংশে ইতিহাস অনুসরণ করে নি। এই গ্রন্থেই সর্বপ্রথম দেব-মাহাত্ম্যের পরিবর্তে এক ঐতিহাসিক কাহিনী গ্রহণ করে আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের মুক্ত অঙ্গনে আধুনিকতার দ্বার খুলে দিলেন। এটিই আধুনিক যুগের প্রথম কাব্য—এই কারণেই গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ।
বীরাঙ্গনা কাব্য:
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ গ্রন্থটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক রচিত। গ্রন্থটি বাঙলা ভাষায় একান্ত অভিনব পত্রকাব্য জাতীয় রচনা। এটি একটি প্রাচীন রােমক কাব্যরীতি অনুসরণে রচিত। গ্রন্থে এগারােটি পত্র, এগারােজন নায়িকা কর্তৃক তাদের স্ব স্ব নায়ককে লেখা। তাদের মধ্যে আছে ‘সােমের প্রতি তারা’, ‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী’, ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ প্রভৃতি। গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে শুধু অভিনবই নয়, পুর্বে অথবা পরে আর কখনাে এ জাতীয় সার্থক প্রচেষ্টা বাঙলায় দেখা যায় নি। এছাড়াও এই পত্রগুলিতে অমিত্রাহ্ষর ছন্দেরও সর্বোত্তম বিকাশ দেখা যায়। এই সমস্ত কারণেই বাঙলা সাহিত্যে বীরাঙ্গনা কাব্য একটা চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
বৃত্রসংহার কাব্য:
গ্রন্থটি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত। এটি একটি আখ্যায়িকা তথা মহাকাব্য জাতীয় কাব্য। কাহিনীটির বিষয়বস্তু বিভিন্ন পুরাণ থেকে গৃহীত হলেও মূল কাহিনীটি বৈদিক, এমন কি ইন্দো-ঈরানীয় যুগেও বর্তমান ছিল। শিবের বলে বলীয়ান হয়ে অসুর-রাজ বৃত্ৰ ইন্দ্রকে পরাজিত করে স্বর্গ অধিকার করে এবং ইন্দ্রপত্নী শচীকে অপহরণের জন্য সচেষ্ট হয়। অবশেষে দধিচি মুনির অস্থির দ্বারা তৈরি বজ্রের আঘাতে বৃত্রাসুরকে হত্যা করে ইন্দ্র স্বর্গ পুনরুদ্ধার করেন। বৃত্রসংহার কাব্যটি রচিত হয়েছিল মেঘনাদবধ কাব্যের অনুকরণে। কিন্তু বিষয়বস্তুর বিচারে, বাঙলা ভাষায় রচিত যাবতীয় মহাকাব্যের মধ্যে ‘বৃত্রসংহার’ ই সর্বোত্তম। এতে অমিত্রাক্ষর ছন্দও ব্যবহৃত হয়েছিল।
পলাশীর যুদ্ধ:
আলােচ্য কাব্যটি নবীনচন্দ্র সেন কর্তৃক রচিত হয়েছে। এটি সাধারণতঃ ‘গাথাকাব্য’ নামেই পরিচিত হলেও এটি একটি শতাধিক বর্ষ পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে কল্পনা-রঞ্জিত আখ্যায়িকা কাব্য। রচনার বিষয়বস্তু, ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ হলেও এতে সিরাজের চরিত্র ও কাহিনী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকা যথেষ্ট বিশ্বাসযােগ্যভাবে উপস্থাপিত হয় নি, বরং সিরাজ-সেনাপতি বীর মােহনলালই নায়কের মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ দেশবাসী এই গ্রন্থের বিশেষতঃ মােহনলালের বক্তৃতায় দেশপ্রেমের যথেষ্ট উন্মাদনা লাভ করে এবং দীর্ঘকাল গ্রন্থটি ছাত্র-পাঠ্যেরূপে নির্দেশিত হওয়ায় বাঙলা সাহিত্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
সারদামঙ্গল:
‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের লেখক আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে গীতিকাব্যধারার উদ্গাতা বিহারীলাল চক্রবর্তী। ‘সারদামঙ্গল’ একটি গীতিকাব্য জাতীয় রচনা, এতে একক কাহিনীসূত্র থাকলেও অবিচ্ছিন্নভাবে গ্রথিত নয়, বরং কতকগুলি বিচ্ছিন্ন কবিতা-সমষ্টিরূপে গ্রহণ করলেও এর পরিপূর্ণ রসগ্রহণে আর কোন বাধার সৃষ্টি হয় না। কাব্যের বিষয় ‘সারদা’ বা ‘সরস্বতী’ হলেও অনেকের মতে ইনিই কবির কাব্যলক্ষ্মীইনি কখনাে কন্যা, কখনাে জায়া, কখনাে জননীরূপে কবির কল্পনায় ধৃত হয়েছেন, আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে গীতিপ্রাণতা ও রােম্যান্টিকতার পরিপূর্ণ সমন্বয় ঘটেছে সর্বপ্রথম বিহারীলালের এই কাব্যটিতেই এবং এই কারণেই কাব্যটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে গৃহীত হয়ে থাকে।
তিলােত্তমা সম্ভব কাব্য:
মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত প্রথম বাঙলা কাব্যগ্রন্থ এই ‘তিলােত্তমা কাব্য’। এটি চারি সর্গে বিভক্ত একটি ‘মহাকাব্যিকা’ (Epicling) বা আখ্যায়িকা কাব্য, মধুসূদনের সদ্যঃ-উদ্ভাবিত অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়ােগক্ষেত্র রূপে ব্যবহৃত। গ্রন্থের কাহিনী পুরাণ থেকে গৃহীত। সুন্দ উপসুন্দ নামে দুই দৈত্য ভ্রাতা স্বর্গ অধিকার করলে সমস্ত দেবতােমণ্ডলীর তেজে সৃষ্ট তিলােত্তমার প্রাপ্তি কামনায় দুই দৈত্যভ্রাতার পারস্পরিক যুদ্ধ ও মৃত্যুএইটিই গ্রন্থের বিষয়। মধুসূদন নাটকে বীররস সৃষ্টির প্রয়ােজনে অমিত্রাক্ষর ছন্দ উদ্ভাবন করলেও কাব্যে তার প্রয়ােগ ঘটান তিলােত্তমায়। তা ছাড়া তিলােত্তমাই মধুসূদনের কাব্য রচনার প্রথম প্রচেষ্টা বলে বাঙলা সাহিত্যে বইটি আদৃত হয়ে থাকে।
ব্রজাঙ্গনা কাব্য:
ব্রজাঙ্গনা কাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ একটি ওড (Ode) জাতীয় গীতিকাব্য এবং পরস্পর-বিচ্ছিন্ন কতকগুলি পদের সমষ্টি। ব্রজাঙ্গনা কাব্যের বিষয় রাধাকৃষ্ণের বিরহ, আঙ্গিকের দিক থেকে বৈষ্ণব কবিতার সমধর্মী হ’লেও এদের মধ্যে বৈষ্ণব প্রাণের সেই আকৃতি অনুপস্থিত। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামক মহাকাব্যটি রচনার সঙ্গে সঙ্গে মধুসূদন এই গীতিকাব্যটি রচনা করেন। মধুসূদনের মনে রােম্যান্টিকতা এবং গীতিপ্রাণতাও বর্তমান ছিল, আলােচ্য গ্রন্থে তার পরিচয় পাওয়া যায় বলেই গ্রন্থটির খ্যাতি।
ত্রয়ী কাব্য (রৈবতক কুরুক্ষেত্র-প্রভাস):
‘রৈবতক, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস’ এই ত্রয়ী কাব্যের রচয়িতা কবি নবীনচন্দ্র সেন। এই ত্রয়ী কাব্য একত্রে মহাকাব্য রূপে পরিচিত। রচনার বিষয় কৃষ্ণকাহিনী রৈবতক কাব্যে কৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্র কাব্যে মধ্যলীলা ও প্রভাস কাব্যে অন্ত্যলীলা বর্ণিত হয়েছে। রৈবতকে কাব্যের উন্মেষ, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ এবং প্রভাসে শেষ। নবীনচন্দ্র একালের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাচীন যুগের মহাভারত-কাহিনীকে বিশ্লেষণ করে আর্য-অনার্য-সংস্কৃতি সমন্বয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন বলেই তার এই ত্রয়ী মহাকাব্যটি ‘উনিশ শতকীয় মহাভারত’ নামে খ্যাত হয়ে থাকে।
বঙ্গসুন্দরী:
‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যের লেখক বিহারীলাল চক্রবর্তী—এটি একটি খাঁটি গীতিকাব্য জাতীয় গ্রন্থ। কাব্যের বিষয়বস্তু, গৃহচারিণী নারীর বিচিত্র রূপ-কল্পনা; কবির রােম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর যে সকল রূপ ধরা পড়েছে, তারই চিত্ৰকাব্যরূপ এখানে দেওয়া হয়েছে। বিহারীলাল তার কাব্য রচনার সূত্রপাতেই গীতিপ্রাণতার পরিচয় দিলেও এই ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে সর্বপ্রথম মনের কথাটি নিজের মতাে করে বলবার সুযােগ গ্রহণ করেছেন, এর ‘উপহার’ অংশেই কবি-কল্পনা মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত আপনাকে প্রকাশ করেছে। ভাষায় এবং প্রকাশভঙ্গিতেও এই কাব্যেই কবি সর্বপ্রথম আপনার পূর্ণশক্তি প্রকাশের সুযােগ পেলেন।
কুহু ও কেকা:
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘কুহু ও কেকা’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ‘কুহু ও কেকা’ একটি কাব্যগ্রন্থ, কতকগুলি গীতিকবিতার সঙ্কলন। নানাবিষয়ক কবিতাই গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে, বিশেষতঃ তাঁর প্রথম দিকের লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলিই রয়েছে এই গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকেও সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে এসে কবিতার ভাবে, আঙ্গিকে, ছন্দে এত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। তিনি তার কাব্যটিতে চলিত ও কথ্যভাষা, হাল্কা সুর, অপরিচিত বিদেশি শব্দ প্রয়ােগে যেমন নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, তেমনি ভাবগভীরতার পরিবর্তে কৌতূহলপ্রবণতা, কাব্যানুরঞ্জনের পরিবর্তে জীবনরসের আস্বাদন বৈচিত্র্য, প্রথাগত কাব্যকীর্তির পরিবর্তে সংলাপভঙ্গির দ্রুতসঞ্চারী ভাবানুগামিতা সৃষ্টিতে অনুপম কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাব্যটির উল্লেখ অনিবার্য।
অগ্নিবীণা:
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’। ‘অগ্নিবীণা’ গ্রন্থ কয়েকটি দেশাত্মবােধক এবং বিদ্রোহী-মনােভাবাত্মক গীতিকবিতার সঙ্কলন। এই গ্রন্থে মােট ১২টি কবিতা আছে, প্রত্যেকটির মধ্যেই রয়েছে বিদ্রোাহাত্মক মনােভাব ও প্রলয়ােল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আগমনী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আলােয়ার, বনভেরী, শাত্-ইল আরব, খেয়া পারাবারের তরুণী, কোরবাণী, মােহররম। ‘অগ্নিবীণা’ নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এক সময় বাংলার স্বাধীনতাকামী যুবসম্প্রদায়ের মনে এই গ্রন্থখানি যে কী তুমুল ভাববিপ্লবের সৃষ্টি করেছিল,তার ইতিকাহিনী সমকালের ইতিহাসে রয়ে গেছে। ঐ সময়কার বাংলার শ্রেষ্ঠ সাময়িক পত্রিকা প্রবাসীতে ‘অগ্নিবীণা’র প্রথম সংস্করণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ঃ “এই বইখানির নাম অগ্নিবীণা সার্থক হইয়াছে, এর কবিতাগুলি আগুনের শিখার মতন প্রােজ্জ্বল লেলিহান অথচ তাতে বীণার মতন বিচিত্র ছন্দ মধুর সুর বাজিয়াছে।” অত্বএব বইটির প্রসিদ্ধির কারণ বুঝতে অসুবিধে হয় না।
হুতােম প্যাঁচার নক্সা:
গ্রন্থটির রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ ওরফে ‘হুতােম প্যাঁচা’। এটি একটি নক্সা বা চিত্রধর্মী রচনা। এতে নক্সা বা টুকরাে টুকরাে ঘটনার চিত্র একে লেখক রসাত্মক মন্তব্য জুড়ে তাকে আস্বাদ্য করে তুলেছেন। গ্রন্থে কলকাতার তৎকালীন ধনী ও মধ্যবিত্ত বাবু সমাজের উচ্ছলতাকে লক্ষ্য করে লেখক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বাণ নিক্ষেপ করেছেন। এতে শিক্ষিত যুবক, কট্টর ব্রাহ্ম, স্থলােদর বৈষ্ণব, কেরানী, পুরুত ঠাকুররা যেমন ব্যঙ্গের লক্ষ্য, তেমনি মাহেশের রথ, দুর্গোৎসব, গাজন, চড়ক প্রভৃতি নিয়েও যথেষ্ট রঙ্গরস করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ‘হুতােম পাঁচার নক্সা’র উল্লেখযােগ্যতার প্রধান কারণ এর ভাষা। এমন অবিমিশ্র কথ্যভাষার সার্থকতম ব্যবহার এর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে কখনাে দেখা যায়নি। অবশ্য বিষয়বস্তু এবং ব্যঙ্গরসও কম উপভােগ্য নয়।
কথােপকথন:
গ্রন্থটির রচয়িতা, সঙ্কলক ও সম্পাদক ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সংস্কৃত, বাংলা ও মারাঠী ভাষার শিক্ষক উইলিয়ম কেরী। এটি ‘কথােপকথন’ বা Dialogues নামে একটি দ্বিভাষিক গ্রন্থ, এতে কলকাতা অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণীর নারীপুরুষের মৌখিক ভাষা-রীতির নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। এই কাজে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অপর কোন শিক্ষকও সহায়তা করেছিলেন। সমসাময়িক যুগের কলকাতা অঞ্চলের মৌখিক ভাষাকে আদর্শরূপে গ্রহণ করে যে ভাযারীতির নিদর্শন আলােচ্য গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে, পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে এটিই আদর্শরূপে গৃহীত হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যে এটিই আদি নিদর্শন—এই কারণে গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
বত্রিশ সিংহাসন:
গ্রন্থটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলার শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার দ্বারা রচিত হয়। এটি একটি সংস্কৃত কাহিনী সঙ্কলনের অনুবাদ রূপে রচিত হয়। এতে মূল সংস্কৃত গ্রন্থের কাহিনীগুলিই সাধুভাষায় রচিত হয়েছে। গ্রন্থটি সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ বলেই এতে তৎসম শব্দের আধিক্য রয়েছে, তৎসত্ত্বেও অর্থবােধে অসুবিধা হয় না। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রথম প্রচেষ্টায় বাক্যগঠনে কিছু ত্রুটি লক্ষিত হলেও ভাষা মােটামুটিভাবে ভাবের বাহন হয়ে উঠতে পেরেছে। বাংলা সাধু গদ্যরীতির প্রাথমিক পর্যায়ের এটি একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত।
সীতার বনবাস:
‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থটি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-কর্তৃক রচিত। এটি একটি কাহিনীমূলক অনুবাদ জাতীয় গ্রন্থ হলেও যথার্থ অনুবাদ নহে। ভবভূতির ‘উত্তররামচরিতে’র তিনটি অধ্যায় এবং রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে গ্রন্থটি কল্পিত হলেও এতে লেখকের মৌলিকতাও অনেকাংশে বর্তমান। গ্রন্থের বর্ণনীয় বিষয়, লঙ্কা থেকে প্রত্যাগমনের পরবর্তী রামসীতা কাহিনী এবং সর্বশেষে সীতার বনবাস-কাহিনী। বাংলা গদ্যের শিল্পসম্মত আদি পর্বের নিদর্শন-রূপে এবং বিদ্যাসাগরের কলানৈপুণ্যের নিদর্শনরূপেই গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য।
শকুন্তলা:
আলােচ্য গ্রন্থটির লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ‘শকুন্তলা’ একটি অনুবাদ-জাতীয় কাহিনীমূলক রচনা হলেও এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটককে তিনি গল্পের কাঠামােয় দাঁড় করিয়েছেন। এর বিষয়বস্তু, দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রেম ও পরিণয়, দুষ্মন্তের প্রত্যাখ্যান ও পরবর্তীকালে পুত্রের মাধ্যমে উভয়ের মিলন। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রধানতঃ শিক্ষার্থীদের প্রয়ােজনের উদ্দেশ্যেই এ জাতীয় কিছু গ্রন্থ রচনা করলেও যাতে সাধারণ পাঠকও এ থেকে তাদের রসপিপাসা নিবৃত্ত করতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিয়েছিলেন। ফলে গ্রন্থটিও শিল্পীমনের স্পর্শে মৌলিক সাহিত্যের আস্বাদ্যমানতা লাভ করেছে এই কারণেই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযােগ্য।
সংবাদ প্রভাকর:
‘সংবাদ প্রভাকরে’র সম্পাদক ছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এটি একটি সাময়িক পত্রিকা। প্রথমে ছিল সাপ্তাহিক, ক্রমে বারত্রয়িক ও দৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ লাভ করে। এক সময় এর একটা মাসিক সংস্করণও প্রকাশিত হতাে। এটি সাময়িকপত্র বলেই প্রধানতঃ সাময়িক সমস্যাদিই প্রধান স্থান লাভ করলেও ঈশ্বর গুপ্তের এই পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের মহৎ উপকার সাধন করেছে। এতে সমকালীন সাহিত্যিকদের কৃতিত্ব বিচার করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী অনেক লুপ্তপ্রায় সাহিত্যও উদ্ধার করা হয়েছে। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের তিনপ্রধান ধারার উদগাতাদের প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল সংবাদ প্রভাকরের পৃষ্ঠাতেই—উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র, কাব্যে রঙ্গলাল এবং নাটকে দীনবন্ধু মিত্র। এই সমস্ত কারণেই সাময়িকপত্র হয়েও সংবাদ প্রভাকর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
বিষাদসিন্ধু:
মীর মশাররফ হােসেন ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থটির রচয়িতা। গ্রন্থটি ‘মােহরুরম পর্ব’, ‘এজিদ পর্ব’ ও ‘উদ্ধার পর্ব’ নামক তিনটি পর্বে বিভক্ত একটি কাহিনী জাতীয় রচনা। হজরত মহম্মদের প্রিয় দৌহিত্র হাসান ও হােসেনের মৃত্যু ও কারবালার শােকাবহ ঘটনাই গ্রন্থের বর্ণিত বিষয়। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু, কাহিনীর বিষাদাত্মক পরিণতি, এর কাব্যসৌন্দর্যময় ভাষা এবং ভাবের বিশুদ্ধি সমস্ত মিলিয়ে গ্রন্থটিকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। বাঙলার মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে মীরসাহেবই এ জাতীয় কৃতিত্বের প্রথম অধিকারী।
বেনের মেয়ে:
‘বেনের মেয়ে’ গ্রন্থের রচয়িতা মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত একটি উপন্যাস জাতীয় রচনা। এর বিষয় খ্রীঃ দশম-একাদশ শতাব্দীর সপ্তগ্রামের এক বৌদ্ধপরিবারের কাহিনী। এতে বিস্মৃত যুগের চিত্র এমন নিখুঁতভাবে এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে এবং এর ভাষা এত সরল ও মনােহারী যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপেই বর্তমান থাকার যােগ্য।
পদ্মাবতী:
রােসাঙ রাজসভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল তার পৃষ্ঠপােষক মাগন ঠাকুরের নির্দেশে সপ্তদশ শতকে ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেন। গ্রন্থটি একটি ইতিহাসভিত্তিক কাহিনীকাব্যের ভাবানুবাদরূপে রচিত হয়েছিল, মূল কাব্যটি মালিক মহম্মদ জায়সী-রচিত হিন্দী ‘পদুমাবৎ’। কাহিনীর বিষয়, সম্রাট আলাউদ্দিন-এর সঙ্গে চিতাের-রাজ রত্নসেনের যুদ্ধ, উপলক্ষ্য রত্নসেন-পত্নী পদ্মাবতীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ আলাউদ্দিনের লােভ ও প্রাপ্তি কামনা এবং পরিণামে পদ্মাবতীর স্বামীর চিতায় সহমরণ। বলা চলে, বাংলা ভাষায় রচিত এটিই প্রথম ইতিহাস-আশ্রিত কাব্য। মূল কাব্যটি ছিল অনেকটা রূপক-জাতীয় এবং আধ্যাত্মিকতামণ্ডিত কিন্তু আলাউদ্দিনের কাব্যটি প্রেমকাব্যরূপেই রচিত। আলাওল-এর মনােভাব যে একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ, তা বােঝা যায়, সম্রাট আলাউদ্দিনের নৈতিক পরাজয়ে। কাব্যটিতে একদিকে যেমন সৌন্দর্যের চিত্র পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি এইটিকে প্রথম বাংলা ঐতিহাসিক রােমান্সরূপে গ্রহণ করতেও বাধা নেই।
সতী ময়নামতী:
রােসাঙ রাজসভার বিশিষ্ট কবি দৌলত কাজী ‘সতী ময়নামতী’ বা ‘লাের চন্দ্রানী’ কাব্যটির রচয়িতা।—কাব্যটি অনুবাদ-জাতীয় কাব্য, সাধন কবি-রচিত হিন্দী ‘মৈনা সত’ নামক একটি কাব্য অবলম্বনে এই ‘সতী ময়নামতী’ নামক কাহিনী কাব্যটি রচিত হয়। কাব্যের বিষয়বস্তু লাের-রাজার সঙ্গে তার স্ত্রী ময়নামতী এবং বামনবীরের স্ত্রী চন্দ্রানীর সম্পর্ক অবলম্বন করে জটিল কাহিনী বিস্তার এবং পরিশেষে সকলের মিলন। দৌলত কাজী লৌকিক সাহিত্যেরই শুধু প্রথম কবি নন, তিনি প্রাচীনতম এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী মুসলমান কবিও। তাঁর কাব্যে অসাম্প্রদায়িক মনােভাব সুস্পষ্ট। তাঁর কাব্যে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কবিত্বের সমন্বয় ঘটেছে। তিনি গ্রন্থটি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি। দ্বিতীয় খণ্ডের কতকাংশ এবং তৃতীয় খণ্ড আলাওল রচনা করেন। তবে কবিত্বে দৌলত কাজীই সমুজ্জ্বল।
বাইশ কবির মনসামঙ্গল:
প্রধানত এর রচয়িতা কবি নারায়ণদেব। তবে আরও কিছু কবির রচনা সংক্ষিপ্ত হয়ে প্রবেশ করায় নারায়ণদেবের গ্রন্থকে অনেক সময় ‘বাইশ কবির মনসা মঙ্গল’ বলা হয়। এটি একটি মঙ্গলকাব্য জাতীয় অর্থাৎ দেবী মনসার মাহাত্ময প্রকাশক কাব্য। গ্রন্থের বিষয়, দেবী মনসার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপে বণিক চন্দ্রধর তথা চাঁদসদাগর ও বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী। অনুমান করা হয় গ্রন্থটি চৈতন্য-পূর্বযুগে রচিত এবং যাবতীয় মনসামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে বিচারে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
অভয়ামঙ্গল:
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ-রচিত কাব্যটির প্রকৃত নাম ‘অভয়ামঙ্গল’ বা ‘নৌতুন- মঙ্গল’, যদিও এটি ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। গ্রন্থটি মঙ্গলকাব্য-জাতীয়, এতে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে। গ্রন্থের বিষয়বস্তু দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্যখ্যাপন প্রসঙ্গে দুটি পৃথক কাহিনী এতে বর্ণিত হয়েছে, একটি ‘আখেটিক ঋণ্ড’ বা ব্যাধ-সন্তান কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী অপরটি ‘বণিক খণ্ড’ বা ধনপতি শ্ৰীমন্ত কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হবার কারণ এই সমগ্র গ্রাগাধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সামগ্রিক বিচারে এটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সমাজবাস্তবতা, চরিত্রসৃষ্টি, কাব্য-ভাবনা প্রভৃতি দিক্ দিয়ে এটি শ্রেষ্ঠ।
শিবায়ন:
‘শিবায়ন’ কাব্য-রচয়িতারূপে রামেশ্বর ভট্টাচার্য যথেষ্ট খ্যাতিমান্ হলেও রামেশ্বর-রচিত কাব্যটির প্রকৃত নাম ‘শিব-সংকীর্তন’। ‘শিবায়ন’ নামটি যথার্থতঃ শিবমঙ্গল কাব্যের সাধারণ নাম। আলােচ্য ‘শিবায়ন’ কাব্যটি মঙ্গলকাব্য জাতীয়, এতে শিবের মাহাত্ম্য খ্যাপন করা হয়েছে। ‘শিবায়ন’ কাব্যের বিষয় শিবের মাহাত্ম্য জ্ঞাপন। তবে অপর সকল মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এর পার্থক্য এই যে কাব্যে স্বয়ং শিবই কাব্যের মনুষ্যদেহধারী নায়ক। কাব্যটির প্রসিদ্ধি এই কারণে, এটি এ জাতীয় কাব্যসমূহের মধ্যেই যে শুধু শ্রেষ্ঠ তা নয়, রামেশ্বর অষ্টাদশ শতকের একজন বিশেষ শক্তিমান কবি ছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণবিজয়:
কুলীনগ্রাম-নিবাসী মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনা করেন ১৪৯১শকাব্দে। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ একটি ভাবানুবাদ জাতীয় গ্রন্থ এটি শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ অবলম্বনে রচিত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের বিষয়বস্তু ‘শ্ৰীকৃষ্ণজীবন’। ভাগবতপুরাণের দশম-দ্বাদশ খণ্ডে শ্রীকৃষ্ণকাহিনী যতটুকু আছে, তার সঙ্গে রাধা কাহিনী যােগ করে এই গ্রন্থটি রচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটির গুরুত্ব এই কারণে এটি চৈতন্য-পূর্ব যুগে রচিত এবং ভাগবতপুরাণের সর্বপ্রথম অনুবাদ। এটি প্রথম বাংলা গ্রন্থ যাতে গ্রন্থ রচনা তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া সম্ভবতঃ চৈতন্য মহাপ্রভু গ্রন্থটি পাঠ করে থাকবেন কারণ তিনি সশ্রদ্ধভাবে মালাধর বসুর নাম উল্লেখ করেছেন।
চর্যাপদ:
কাহ্নপা, ভুসুকুপা, সরহপা, কুকুরীপা, শবরীপা প্রভৃতি তেইশজন সিদ্ধাচার্য কবি-রচিত সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ-সমন্বিত ‘চর্যাগীতিকোষ’ নামক গ্রন্থই ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এটি সাধন-সঙ্গীত জাতীয় গ্রন্থ। এর বিষয় সহজিয়াপস্থী বৌদ্ধ সাধকদের সাধনার কিছু সাংকেতিক পন্থা। বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদের স্থান অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাচীন যুগের বাঙলা সাহিত্যে এটিই একমাত্র গ্রন্থ। কাজেই ঐ যুগের ভাষা এবং সমাজতাত্ত্বিক বিবরণ সম্বন্ধে কিছু জানতে গেলে চর্যাপদ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন:
বড়ু চণ্ডীদাস তথা অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস এই কাব্যটিই রচনা করেন। তিনি এই কাব্যটির কী নামকরণ করেছিলেন, জানা যায়নি, সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ এর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণ করেছেন। গ্রন্থটির অপর সম্ভাব্য নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। সুধী সমালােচকগণ এটিকে ‘নাটকাব্য’ জাতীয় গ্রন্থরূপে অভিহিত করে থাকেন। এটি কাব্যাকারে রচিত গীতবহুল এবং তিন পাত্র-পাত্রীর কথােপকথন-সূত্রে বিধৃত। ‘শ্রীকৃষ্ণচকীর্তন’ গ্রন্থের বিষয় কংসনিধন-প্রয়ােজনে কৃষ্ণজন্ম থেকে তার মথুরাগমন পর্যন্ত হলেও প্রধানতঃ রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলাই গ্রন্থের মুখ্য বর্ণনীয় বিষয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের সর্বাধিক গুরুত্ব বিবেচিত হয় এই কারণে যে, সমগ্র আদি মধ্যযুগে রচিত মাত্র এই একটি কাব্যেই সমকালীন ভাষার যথার্থ রূপটি অবিকৃত রয়েছে। কাজেই এর ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্বই সমধিক। এছাড়া বাংলা ভাষায় রাধাকৃষ্ণ সম্বন্ধে রচিত এটিই প্রথম গ্রন্থ।
Leave a comment