জ্ঞান তপস্বী অবনীশ দত্ত সরলরৈখিক চরিত্র, তাঁকে দুরূহ বা দুর্বোধ্য বলা চলে না। সংসারে তাঁর ভালােবাসার ক্ষেত্র ছিল দুটি-মাতৃহীন কন্যা লাবণ্য এবং নিজের বিশাল লাইব্রেরি। তাঁকে বলা হয়েছে ‘এক পশ্চিমী কলেজের অধ্যক্ষ’। তাঁর বয়স তখন সাতচল্লিশ। অবনীশের চরিত্রটি অবশ্য বেশ কিছুটা অসঙ্গতিতে ভরা। তবে সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি বাদ দিলে সামগ্রিক পর্যালােচনায় তাঁকে উপন্যাসের উপেক্ষিত চরিত্ররূপে আখ্যাত করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’, প্রবন্ধে লক্ষ্মণের স্ত্রী উর্মিলাকে কাব্যের উপক্ষিতা চরিত্ররূপে নিরূপণ করেছিলেন। তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে অবনীশ চরিত্রটিকে উপন্যাসের উপেক্ষিত চরিত্ররূপে স্বীকৃতি জানাতে কোনাে রকম দ্বিধা জাগে না। তবে বিষয়টি একটু পর্যালােচনা সাপেক্ষ।

চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্য তাঁকে আকর্ষণীয় করে তােলে, তা হল যুগপৎ মেয়ের প্রতি ভালােবাসা এবং মানবচরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব। মেয়ের প্রতি ভালােবাসার পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন- “নিজের লাইব্রেরির চেয়েও তাকে ভালবাসতেন।” কিন্তু এইসঙ্গে একথা বলা হয়েছে যে, তার ধারণা ছিল লেখাপড়ার জগৎ নিয়েই একটা মানুষ অনায়াসেই দিন কাটিয়ে দিতে পারে, সে যদি নারীও হয় তবুও। হৃদয় দৌর্বল্যের অশান্তি রােধ করবারও একমাত্র উপায় পড়াশুনার মধ্যে ডুবে থাকা। তার মনােভাব বার্ষিত হয়েছে এইভাবে- “তার বিশ্বাস ছিল, জ্ঞানের চর্চায় যার মনটা নিরেট হয়ে ওঠে সেখানে উড়াে ভাবনার গ্যাস নীচে থেকে ঠেলে উঠবার মতাে সমস্ত ফাটল মরে যায়, সে মানুষের পক্ষে বিয়ে করবার দরকার হয় না .. লাবণ্যের নাইবা হল বিয়ে, পাণ্ডিত্যের সঙ্গেই না হয় গাঁঠ বাঁধা হয়ে থাকল।”

অবনীশ জ্ঞানের সত্য জানতে পারেন ভালাে করে কিন্তু হৃদয়ের সত্য সম্বন্ধে তাঁর ধারণা যে ভ্রান্তিমূলক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল অচিরেই। মেয়ের ওপর নয়, প্রকৃতির প্রতিশােধ নেমে এলাে তাঁরই ওপর। “তখন অবনীশ সান্চল্লিশ, সেই নিরতিশয় দুর্বল নিরুপায় বয়সে একটি বিধবা তার হৃদয়ে প্রবেশ করল, একেবারে তাঁর লাইব্রেরির গ্রহ্থব্যুহ ভেদ করে, তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রাকার ডিঙিয়ে।”

এই প্রথম অবনীশ বুঝতে পারেন শােভনলালের প্রেমকে। বিধবাকে বিবাহের ব্যাপারেও বাধা দিল লাবণ্য। শােভনলাল লাবণ্যর মিলন প্রয়াস যখন ব্যর্থ হল তখন বাবাকে ভুলবুঝে লাবণ্য তাদের বিবাহ ঘটালাে। লাবণ্যর প্রতিক্রিয়া এমনই তীব্র ছিল যে পিতার বাসস্থান ও সমস্ত সম্পত্তি ত্যাগ করে সে স্বাধীন উপার্জনের পথ ধরলাে।

প্রসঙ্গক্রমে যদিও স্বীকার করতে হয়, লাবণ্য-অমিত ইতিবৃত্তে অবনীশের আর কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু কাব্যে উপেক্ষিতা প্রবন্ধে একটি মহাকাব্যের নারীচরিত্র অনাদৃতা হয়েছে বলে যিনি অভিযােগ করেন, উপন্যাসে একটি রক্তমাংসের সজীব চরিত্রকে প্রয়ােজন ফুরিয়েছে বলেই তিনি বর্জন করবেন—এমনটা আশা করা যায় না। লাবণ্য স্বাবলম্বী হয়েছে, ভালােকথা। অবনীশ কি একবারও তার সন্ধান করতে পারেন না ! যে লাবণ্য পিতার হাতে তৈরি, পড়াশুনার জগতে ডুবে থেকেও পিতাকে কি তার প্রয়ােজন হয় না একবারও! অবনীশের ব্যক্তিগত জীবনের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল যদিও সে জীবনে উৎসাহের অনেক কিছু ঔপন্যাসিক খুঁজে পেতেন, তবু লাবণ্যের খোঁজ যে তিনি রাখতেন এবং শােভনলালের সঙ্গে যে তাঁর যােগাযােগ ছিল, এমনটি অনুমান করা যায়। আক্ষেপের বিষয় এই তিনি নেপথ্যে ছিলেন নেপথ্যেই থাকলেন—উপন্যাসের কোনাে প্রয়ােজনেই লেখক তাঁকে লাগিয়েছেন বলে মনে হয় না। অন্ততঃ উপন্যাস পর্যালােচনায় তেমনটি মনে হয়।

অবনীশ চরিত্রের অসঙ্গতির কথা বলতে গেলে বলা যায়, লেখক তাঁকে ‘এক পশ্চিমী কলেজের অধ্যক্ষ’ পদে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ আছে তা পশ্চিমে ঘটেছে বলে মনে হয় না—অন্ততঃ পশ্চিম ভারতে শােভনলালের পিতা ননীগােপালের দাপট ততটা বিশ্বাসযােগ্য মনে হবে না। অথচ ঘটনাটা বঙ্গদেশে ঘটাও প্রায় অসম্ভব, কারণ অবনীশের বয়স তখন সাতচল্লিশ। তাঁকে অধ্যক্ষ হিসাবে না দেখিয়ে অধ্যাপক হিসাবে বর্ণনা করলেই ভালাে হতাে বলে আমাদের মনে হয়, কারণ তিনি বিদ্যার্জনেই বেশি উৎসাহী বলে আমাদের মনে হয়েছে, কলেজ পরিচালনায় নয়। অবনীশের বিদ্যার আগ্রহের বিশেষ ক্ষেত্রেরও উল্লেখ করা হয়নি- উপন্যাস পাঠকালে তা ইতিহাস বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাই সবকিছু মিলিয়ে বলতে হয় অবনীশ উপন্যাস মধ্যে যেমন একটি উপেক্ষিত চরিত্র তদ্রুপ তার চরিত্রটি কেমন অসংলগ্নভাবে রূপায়িত।