কিন্তু সে যাই হােক, ওই লেকিটি কি! মানুষ? দেবতা? পিশাচ? কে ও?

উদ্ধৃতাংশটি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের অন্তর্গত।

মাছ চুরির অভিযানে গিয়ে ইন্দ্র ও শ্রীকান্ত যখন জেলেদের তাড়া খেয়ে হােগলা বনের মধ্যে প্রবেশ করেছিল আত্মরক্ষার তাগিদে। সেইখানে কাছাকাছি কোথাও জনার, ভুট্টাগাছের ডগা ভয়ানক আন্দোলিত হয়ে ‘ছপাৎ’ ‘ছপাৎ’ শব্দ হয়েছিল। তখন শ্রীকান্ত ভয় পেয়ে ইন্দ্রের মনােযােগ আকৃষ্ট করলে প্রতুত্তরে ইন্দ্র বলেছিল, “ও কিছু না-সাপ জড়িয়ে আছে। টোড়া, বােড়া, গােখরাে, করেত কামড়ালেই বা কি করব। মরতে একদিন ত হবেই ভাই!” এই মৃত্যুভয়হীন সাহসী স্বার্থত্যাগী মানুষটির কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্য শুনে দার্শনিক শ্রীকান্ত এইরূপ মন্তব্য পােষণ করেছেন।


“মড়ার আবার জাত কী? এই যেমন আমাদের ডিঙিটা—এর কি জাত আছে?”

নিশীথ অভিযান থেকে ফেরার সময় ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তকে অন্য একটি ঘাটে নৌকা বাঁধতে হয়েছিল। গভীর নিশীথে প্রকৃতির নিবিড় স্তন্ধতায় পরিপূর্ণ সেখানে গৌরবর্ণ ছয়-সাত বছরের একটি হৃষ্টপুষ্ট বালকের সদ্য মৃতদেহ তাদের চোখে পড়ল। শৃগালেরা মৃত দেহটিকে জল থেকে ডাঙায় তুলেছিল, ইন্দ্র শ্রীকান্তের আকস্মিক আগমনে তারা পাছে। কোথাও অপেক্ষা করছিল। চিরনিদ্রায় মগ্ন এই বালকটিকে দেখে ইন্দ্র ব্যথিত হয়ে নৌকায় তুলে নিল কবর দেওয়ার জন্য। কুন্ঠিত শ্রীকান্ত সঙ্কুচিত হয়ে ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করল কি জাতের মড়া- তুমি ছোঁবে ? প্রত্যুত্তরে পরােপকারী ইন্দ্রনাথ এই উক্তিটি করেছিল।


“সেদিন অখণ্ড স্বার্থপরতার যে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখিতে পাইয়াছিলাম ; তাহা সহজে ভুলিতে পারি নাই?”

ইন্দ্রের মাসতুতাে ভাই- নতুনদা কলকাতার তথাকথিত বাবু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। আত্মকেন্দ্রিক ভােগ, বিলাসিতার জীবনে অভ্যস্ত। অপরের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর রাখার প্রয়ােজন নেই। থিয়েটার যাত্রায় যাওয়ার জন্য শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যাতে না লাগতে পারে সেদিকে তাঁর সতর্কতা অপর্যাপ্ত। অর্থাৎ তীব্র শীতে ইন্দ্র শ্রীকান্তকে দিয়ে দাঁড় টানতে তার বাধে না। হাড় কাঁপানাে শীতে শ্রীকান্তের র্যপারখানি তাঁর প্রয়ােজন অথচ তার প্রতি ঘৃণা কটুক্তির শেষ নেই। উজানে দাঁড় টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় জেনে সে ক্ষিপ্ত হয়। সেই সময় শ্রীকান্ত এই উক্তিটি করেছিল।


“যেন ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি! যেন যুগ-যুগান্তরব্যাপী কঠোর তপস্যা সাঙ্গ করিয়া তিনি এই মাত্র আসন হইতে উঠিয়া আসিলেন।”

সাপুড়ে শাহজীর গৃহে ইন্দ্র বাঁশি বাজিয়ে সাপের ডালা খুলে ফেলতেই সাপটি ইন্দ্রের হাতের ডালায় এবং বাঁশির লাউয়ের উপরে তীব্র ছােবল মেরে যারে ঢুকে পড়ল। ঠিক এই সময়ে অন্নদাদিদি গৃহেতে প্রবেশ করা মাত্র শ্রীকান্তের মনে হল তিনি ছিলেন ভস্মাচ্ছাদিত অগি, যুগ-যুগান্তর ব্যাপী কঠোর সাধনা সমাপ্ত করে তিনি যেন এইমাত্র তপস্যার আসন ছেড়ে তাদের সামনে উপস্থিত হলেন। জীবন যাত্রায় নগ্ন বীভৎস আবেষ্টনীতে অন্নদাদিদিকে তিনি বৈরাগ্যের প্রতীক বলেছেন এবং অভিভূত হল পরম বিস্ময়ে, সংসারে থেকেও তিনি তপস্বিনী।


“নারীর কলঙ্ক আমি সহজে প্রত্যয় করিতে পারি না।”

অন্নদা-দিদি চলে গেছেন। তাঁর কথা স্মরণ হলে শ্রীকান্ত ভেবেছেন যে, যে স্বামীর জন্য কূলত্যাগীনী অপবাদ শিরধার্য করে এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করিলেন অথচ সেই পতিব্রত্যা অন্নদাদিদির সতীত্বের আদর্শে অকতরে গভীর কলঙ্ক লেপন হয়ে চিহ্নিত হল। দিদির সংস্পর্শে এসে শ্রীকান্তের দৃষ্টিতে নারী নতুনরূপে সৃষ্ট হল। তিনি নারীর কলঙ্ক সহজে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে “তাই ভাবি, না জেনে নারীর কলঙ্কে অবিশ্বাস করে সংসারে বরঞ্চ ঠকা ভাল, কিছু বিশ্বাস করে পাপের ভাগী হওয়া লাভ নেই।” সমাজের দৃষ্টিতে তিনি কূলত্যাগীনী, অসতী, কিন্তু প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অন্তরালে যে সত্যটি নিহিত আছে, তা হল তিনি সতী সাবিত্রী। তাই শ্রীকান্ত সহজেই নারীর কলঙ্কে বিশ্বাস করতে চান না।


“যে কলম দিয়ে সারা জীবনে শুধু জালখত তৈরি করেছি, সেই কলমটা দিয়েই আজ আর দানপত্র লিখতে হাত সরচে না।”

এটি শ্রীকান্তের প্রথম পর্বের দশম পরিচ্ছেদে নিহিত রয়েছে। রাজলক্ষ্মীর জীবনটা ছিল বিষময়। সে একটা অশােভনীয় কাজ নিয়ে বাস্তবের সাথে লড়াই করে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়েছে। তাঁর কাজ রূপের লালসায় দৈহিক অঙ্গভঙ্গির দ্বারা নাচ গানে মত্ত হয়ে রাজ-রাজাদের মন মুগ্ধ করা। এই অশ্লীল সমাজ বর্জিত কাজ রাজলক্ষ্মী কিন্তু মন থেকে মেনে নিয়ে করছে না। সমাজে বেঁচে থাকার জন্য সে বাধ্য হয়েছে। রাজকুমারের সাথে শ্রীকান্ত শিকার করতে গেলে গ্রামের এক হিন্দুস্থানী লােকের সাথে বাজি রেখে শশ্মানে গিয়েছিল, শ্রীকান্তের সাথে দেখা হলে পিয়ারী বাঈ তাকে তাঁবুতে ফিরে যেতে বারণ করে এবং তাকে টিকিট কিনে দেবে যাতে অন্য কোথায় সে চলে যায়।


‘যে সমাজ এই দুইটি নিরুপায় ক্ষুদ্র বালিকার জন্য স্থান করিয়া দিতে পারে নাই, সে সমাজ আপনাকে এতটুকু প্রসারিত করিবার শক্তি রাখে না, সে পঙ্গু আড়ষ্ট সমাজের জন্য মনের মধ্যে কিছুমাত্র গৌরব অনুভব করিতে পারিলাম না।’

বর্ধমান জেলার গৌরী তেওয়ারী দুই মেয়ের বিবাহের জন্য নিজের দেশে তাঁর সমাজ উপযুক্ত ছেলে না পাওয়া বিহারের বঠোরী গ্রামে হিন্দু স্থানীয় ঘরে বিয়ে দিয়েছিল। মেয়ে দুটি বাঙালি হওয়ায় হিন্দুস্থানীদের আচার-আচরণ, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি। বড় মেয়েটি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে এবং ছােট মেয়েটি অনুরূপ সেই কাজ করবে বলে সন্ন্যাসী বেশী শ্রীকান্তকে জানিয়ে দিয়েছে। ছােট মেয়েটি তার বাবার চিঠির আশায় ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছে। শ্রীকান্তকে তার কাছে চিঠি লেখার জন্য অনুরােধ করে। শ্রীকান্ত তখন ভাবছে আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজের সামাজিক অন্ধশাসনের কথা। যে সমাজে প্রথা ও কুসংস্কার নীতি বজায় রেখে কল্যাণের জন্য কিছু করতে পারে না, যে সমাজ নিরুপায় দুটি জীবনের স্থান করে দিতে পারে না, সেই নিপ্রাণ, কঠোর সমাজের জন্য শ্রীকান্ত কিছুমাত্র গৌরব করতে পারে না বরং সমাজের প্রতি তাঁর বিতৃয়া, ঘৃণা, অপরিসীম লজ্জা জেগেছে।


“মাতৃত্বের এই একটা ছবি আজ চোখে পড়ায় যেন একটা নতুন জ্ঞান লাভ করিলাম।”

শ্রীকান্ত অসুস্থ হলে রাজলক্ষ্মী তাঁর পাটনার বাড়িতে তাকে সেবা শুশ্রষা করে কিছুটা সুস্থ করে তুললল। একদিন রাজলক্ষ্মী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাে তিনি কবে বাড়ী যাচ্ছে। শ্রীকান্ত এই উক্তিটি বুঝতে না পেরে বলল কিছুদিন এখানে থাকবে। এই শুনে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে বললাে যে, প্রায় তার ছেলে বঙ্কু বাঁকিপুর থেকে আসা যাওয়া করছে। তাকে এখানে বেশিদিন থাকতে দেখলে সে সন্দেহ করতে পারে। পরের দিন বিকালে বন্ধু এসে শ্রীকান্তের সাথে ঘরােয়া কথা বলতে বলতে শ্রীকান্ত চলে যাবে শুনে বঙ্কু তাঁকে আরও কটা দিন থাকতে বললাে। শ্রীকান্ত বন্ধুর কাছে কারণ জানতে চাইলে উত্তরে সে বলে তিনি থাকলে তাঁর মা বড় আনন্দ পাবে। এই কথার মধ্য দিয়ে শ্রীকান্তের চোখের সামনে বাঈজী রাজলক্ষ্মীর একটি নতুন রূপ উদ্ভাসিত হল। সেটা হল মাতৃত্বের রূপ। রাজলক্ষ্মীর সাথে শ্রীকান্তের গােপন সম্পর্কটা সে চাপা দিয়ে রাখতে চায়। তাই রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে সুস্থ হওয়ার আগে চলে যেতে বলে। এটা শ্রীকান্তের একটা নতুন অভিজ্ঞতা।


“দেখিলাম, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না-ইহা দুরেও ঠেলিয়া ফেলে।”

শ্রীকান্ত এবং রাজলক্ষ্মীর প্রেম, বাসনা, কামনা পূর্ণতা পাবার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু তাদের সংযােগস্থলে বঙ্কুর মা অভ্রভেদী হিমালয়ের মতাে দাঁড়িয়ে, কর্তব্য পরায়ণা অফুরন্ত মাতৃত্বের অধিষ্ঠাত্রী রাজলক্ষ্মীকে শ্রীকান্ত প্রথমে ভুল বুঝেছিল কারণ পাটনার বাড়ী থেকে শ্রীকান্তকে চলে যেতে বলেছে। সে সতীনের ছেলে বন্ধুকে নিজ পুত্রের মতাে পালন করেছে। সে গৃহে এসেছে, যদি সে সন্দেহ করে রাজলক্ষ্মী এবং শ্রীকান্তকে। রাজলক্ষ্মীর নিশূতি রাতে আগমন রাত জেগে তার শুশ্রুষা করা এরই মধ্যে দিয়েই হৃদয়ের গভীর ভালােবাসা ব্যক্ত হয়, বলতে অত্যুক্তি হয় না। যে প্রেম ভােগ, কামনা, মােহমত্ত নয়, ত্যাগের গৌরবে উজ্জ্বল তা শুধু প্রেমিক প্রেমিকাকে কাছে আনে না আবার দুরে ঠেলে দেয়। একথা শ্রীকান্ত উপলব্ধি করেছিল। যে প্রেম কল্যাণের মেলবন্ধন ঘটায় সেই প্রেমের জন্য দুঃখ, কষ্ট, হৃদয় গতঅভিব্যক্তি ত্যাগ সবকিছুই করতে পারে। তাই রাজলক্ষ্মীর হৃদয়ে যত দুঃখ কষ্ট আসুক তার গােপন প্রেম, পরস্পরের ভালােবাসার মর্যাদা যাতে অক্ষুন্ন হয় সেজন্য শ্রীকান্তকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছিল।


“জীবন মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়াইয়া এই স্বার্থত্যাগ এই বয়সে কয়টা লােক করিয়াছে।”

নিশীথ রাত্রিতে মাছ চুরির অভিযানে গিয়ে ইন্দ্র ও শ্রীকান্ত জেলেদের কাছে ধরা পড়ে গেলে একটা ভূট্টা জনারের বনের ভিতর ডিঙি নিয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে এক হাঁটু কাদার মধ্যে ডিঙির লগি পুঁতে যায়, সেই জলের ভিতর, গােখরাে, কেউটো, করেত প্রভৃতি সাপ থাকা সত্ত্বেও ইন্দ্রের মধ্যে এতটুকু ভয় জন্মায় নি। শ্রীকান্তের প্রচন্ড ভয় হলেও সে নৌকা থেকে নামেনি। শ্রীকান্ত তাকে জিজ্ঞাসা করছে তােমার ভয় করে না। উত্তরে বলে ‘ভয় কীসের মরতে তাে একদিন হবেই ভাই’। এমনকি নৌকার দড়ি কোমরে বেঁধে এক হাঁটু কাদার মধ্যে থেকে নৌকা বার করার জন্য প্রচন্ড কষ্ট হলেও একবারও শ্রীকান্তকে নামতে বলেনি। তাই শ্রীকান্ত বলছে সমস্ত বিপদের বার্তা তন্নতন্ন করে জেনে শুনে নিঃশব্দে অকুণ্ঠিত মনে অতি ভীষণ মৃত্যুর মুখে নেমে দাঁড়াল অথচ একবার বলল না শ্রীকান্ত তুই নেমে যা। এর ফলে বােঝা যাচ্ছে ইন্দ্রের মধ্যে কোন স্বার্থপরতা ছিল না, ছিল শুধু ত্যাগ মৃত্যুভয় হীনতার উজ্জ্বল দ্বিপ্তী।


“কিন্তু এত বড় একটা মহাপ্রাণ আজ পর্যন্ত তুমিই বা কয়টা দিতে পারিলে?”

শ্রীকান্ত জীবনের পড়ন্ত বেলায় কৈশােরের বন্ধু ইন্দ্রনাথের স্মৃতি রােমন্থন করতে করতে তার দুটো চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। তার হৃদয়ের মধ্যে একটা নিম্ফল অভিমান যেন বের হয়ে আসছে। স্বার্থপরহীনতা, মৃত্যু ভয় হীনতা মহানুভবতা, মহত্তের পূজারী ইন্দ্রনাথকে সে গভীর সহমর্মিতার সহিত অনুভব করার চেষ্টা করে। তার প্রতি শ্রীকান্তের গভীর শ্রদ্ধা ও বিস্ময় প্রকাশ পায়। শ্রীকান্ত এক নিষ্ফল অভিমান নিয়ে ভগবানকে বলছে এই অপার্থিব বস্তু কেনই বা সৃষ্টি করলে আবার কেনইবা তা এখন ব্যর্থ করে প্রত্যাহার করলে। টাকাকড়ির, ধন দৌলত, ঐশ্বর্য বিদ্যাবুদ্ধি তােমার অফুরান্ত ভান্ডার হতে সব দিচ্ছ কিন্তু সহৃদয়ে পরােপকারী এমন মহান মানুষ তুমি পৃথিবীতে কয়টা দিতে পারলে।


“সংসারে সে যত ভলােবাসিয়াছে পরের হৃদয়ের ভাষা তাহার কাছে তত ব্য্ত হইয়া উঠিয়াছে।”

নৈশ অভিযানের কিছুদিন পর ইন্দ্রের সাথে শ্রীকান্তের দেখা হলে ইন্দ্র যে শ্রীকান্তকে কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু বলতে পারল না, মনের ভিতর একটা চাপা অস্বস্তি বােধ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই কিশাের বয়সে মনস্তত্ত্ব আবিস্কার করার বয়স নয় তা হলেও শ্রীকান্ত যে ইন্দ্রকে ভালােবাসতাে বয়স ও বুদ্ধি দিয়ে নয়, এবং তার মন বুঝবে সেটা সম্পূর্ণ ভালােবাসা এবং সহানুভূতি দিয়ে। সংসারে সে যত ভালােবাসতে পেরেছে তা সহজে অপরের হৃদয়ের ভাষা তার কাছে তত ব্যক্ত হয়ে উঠেছে। এই কঠিন অন্তদৃষ্টি শুধু ভালােবাসার জোরে পাওয়া যায় অন্যের মনকে।


“এমনি একদিন উদ্দেশ্যবিহীন থাকিয়া যাওয়ার মুখে তাহার সহিত আমার একান্ত ব্যঞ্ছিত মিলনের গ্রন্থি সুদৃঢ় হইবার অবকাশ ঘটিয়াছিল।”

শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় কিন্তু ভয়েতে পিছিয়ে আসে। একদিন খেলার মাঠে শ্রীকান্তকে কয়েকজন দুষ্ট ব্যক্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, এর ফলে শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের সঙ্গে মেশার সুযােগ পায়, তাঁর গভীর নিশীথে অন্ধকারে বনের ভিতর অভাবনীয় মধুর বংশী ধ্বনির রামপ্রসাদী সুর শ্রীকান্তকে মুগ্ধ করেছিল। ইন্দ্রনাথের একটি ছােট ডিঙি ছিল, সেই ডিঙিতে কোনও একদিন পশ্চিমের গঙ্গায় ধার ধরে স্রোতে পানাসী ভাসিয়ে হাল ধরে চুপ করে বসে রইল ; দশ পনের দিন কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। কোনও একদিনে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে ডেকে নিয়ে গেল নিশিথ অভিযানে। ইন্দ্রনাথের জন্য শ্রীকান্তের যে মনের ব্যাকুলতা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটা সেই অভিযানের দ্বারা পূর্ণ হয়। শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের মধ্যে প্রাণের দোষর খুঁজে পেল।


“সম্মুখের ওই পূর্ব আকাশটার সঙ্গে এই পতিতার মুখের কি যেন নিগুঢ় সাদৃশ্য রহিয়াছে।”

শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পর্বে রাজলক্ষ্মী রাজকুমারের তাঁবু থেকে বাড়ীর দিকে রওনা হবার সময় শ্রীকান্তের সাথে দেখা হয়। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে তাঁবুতে ফিরে যেতে নিষেধ করে, প্রাণ নাশের আশঙ্কায় পিয়ারীর গাড়ি এই সময় মােড় ফিরতেই পিছনটা শ্রীকান্তের সম্মুখে পড়তেই পূব আকাশের রক্তিম আভার সাথে এই পতিতা বাঈজীর মুখে একটা অন্যরকম দৃশ্য পরিলক্ষিত হল। সে ভাবল সামান্য পতিতা বলে অবহেলা করা যাবে না। তার মধ্যে চিরন্তন নারী সত্তা প্রত্যক্ষ করে শ্রীকান্তের বিস্ময়ের অবধি রইল না।