শ্রীকান্তের ভাষা মূলত সাধু গদ্যের কাঠামােয় চলিতের প্রাণ প্রতিষ্ঠিত। বর্ণনা অংশে লেখক সাধু গদ্যের ব্যবহার করেছেন ঠিকই তবে তাও চলিতের প্রায় কাছাকাছি। আর সংলাপ অংশে একেবারে প্রাত্যাহিক জীবনের মুখের ভাষা। এই সংলাপ রচনায় লেখক প্রায়শই সংলাপের সঙ্গে চরিত্রের অভিব্যক্তিকে জুড়ে দিয়েছেন। যেমন—
“তাের নাম কি রে?
শ্রী-কা-ন্ত
শ্রীকান্ত ? আচ্ছা, বলিয়া সে তাহার জামার পকেট হইতে এক মুঠো শুকনাে পাতা বাহির করিয়া কতকটা নিজের মুখে পুরে দিয়া কতকটা আমার হাতে পুরে দিয়া বলিল, বেটাদের খুব ঠকিয়েছি-চিবাে।
কি এ?
সিদ্ধি।
আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলাম, সিন্ধি? এ আমি খাই না। সে ততােধিক বিস্মিত হইয়া কহিল, খাসনে? কোথাকার গাধারে… ”
এখানে ‘বিস্মিত হইয়া কহিলাম’, ‘ততােধিক বিস্মিত হইয়া কহিল’ প্রভৃতি অভিব্যক্তি যেমন আছে তেমনি আবার ‘শ্রী-কা-স্ত-র উচ্চারণে’ এর ব্যবহার আর এক অভিব্যক্তিকে বুঝিয়ে দেয়।
শুধু চলিত ভাষাই নয়,এ উপন্যাসের সংলাপ রচনার এমন কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার লক্ষিত হয়, যা একেবারে মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে। যেমন-
ক) ছোঁড়াটাকে দেনা দাঁড় টানুক
খ) কারুর সাধ্যি নেই, এই রেত ঠেলে উজোন বেয়ে যায়।
গ) ব্যবসা বার করে দিচ্ছি—বললে শ্রীকান্ত।
প্রভৃতি সংলাপগুলি একেবারে মুখের ভাষা করে তুলেছে। এমন কিছু সংলাপ রচিত হয়েছে যার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নাটকীয়তা, সৃষ্টি করেছে ঘটনার গতিবেগ। যেমন-
“তােমার কটি ভাই বােন?
ভাই আর নেই, চারটি বােন।
তাদের বিয়ে হয়ে গেছে ?
আজ্ঞে হ্যা। মা-ই বিয়ে দিয়েছেন।”
অন্যদিকে চরিত্রের স্বাভাবিকতা রক্ষার্থে লেখক হিন্দি বাংলা মেশানো এমনকিছু বাক্য ব্যবহার করেছেন যা কিছুটা হাস্যরসাত্মক হয়ে উঠেছে কিন্তু চরিত্রটিকে করে তুলেছে জীবন্ত। যেমন-
ক) খােটার শালার বেটারা আমাকে যেন কিলাকে কাঁঠাল পাকা দিয়া।
খ) কহিল বাবাজী আয়না টায়না হ্যায়?
গ) কেয়া বাবুসাব, আব যায়েগা? যায়েগা বৈকি?
এসকল সংলাপে বিশেষ হাসির উদ্রেক করে বৈকি।
শরৎচন্দ্রের সংলাপ রচনায় একটা বিশেষ প্রবণতা লক্ষিত হয়.. তাহল বাক্যমধ্যে বাক্যালংকার অব্যয়ের সৃষ্টি। যেমন-
ক) আজ ত তার তলা দিয়ে যাওয়া যাবে না।
খ) আর ত পথ নেই।
গ) সতুয়ার চড়া ত ঘাের নালার সুমুখে। ইত্যাদি সংলাপের মধ্য দিয়ে লেখক চলিত ভাষাকে অলংকারে বিভূষিত করে বেশ শ্রুতি মাধুর্য ঘটিয়েছেন।
এতাে গেল সংলাপের কথা। কিন্তু বর্ণনা অংশে তিনি কম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেননি। স্থান বিশেষে তিনি কিছু কিছু কথার মার প্যাচ এমনভাবে তৈরি করেছেন যা হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাধর্মী এবং ব্যজস্তুতি অলংকারের দ্বারা সম্পৃক্ত। যেমন— “প্রত্যহ এই দেড় ঘন্টাকাল অতিশয় বিদ্যাভ্যাস করিয়া রাত্রি নয়টার সময় আমরা যখন বাড়ির ভিতরে শুইতে আসিতাম তখন মা সরস্বতী নিশ্চয়ই ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত আমাদিগকে আগাইয়া দিয়া যাইতেন।” অথবা, “মেজদার দুর্ভাগ্য, তাহার নির্বোধ পরীক্ষকগুলাে তাঁহাকে কোনােদিন চিনিতেই পারিল না।” ইত্যাদি বর্ণনায় কেমন একটা ব্যঙ্গ অনুরণিত হয়েছে। আবার ‘প্রকৃতির স্বরূপকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি এমন এমন ভাষা ও বর্ণনার আশ্রয় নিয়েছেন যেন পাঠক তা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছে দর্শকের মতাে- “বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তত্ত্ব, নিঃসঙ্গ নিশীথিনী সে যেন এক বিরাট কালীমূর্তি। নিবিড় কালােচুলে দ্যুলােক ভূলােক আচ্ছন্ন হইয়া গেছে এবং সেই সূচীভেদ্য অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া করাল দংস্টরারেখার ন্যায় দিগন্ত বিস্তৃত এই তীব্র জলধারা হইতে কি এক প্রকারের অপরূপ স্তিমিত দ্যুতি নিষ্ঠুর চাপা হাসির মতাে বিচ্ছুরিত হইতেছে।”
এধরনের বর্ণনা বােধকরি একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোথাও লক্ষিত হয় না। এমন অপরূপ কাব্যময় ভাষাতাে রবীন্দ্রনাথের হাতে স্ফুরিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্র বােধকরি তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এমন স্পষ্ট বর্ণনার দ্বারস্থ হয়েছেন। বিশেষত, শ্রীকান্তের মুখ দিয়ে তিনি যখন বলিয়েছিলেন— “অন্তগামী সূর্যের তির্যক রশ্মিচ্ছটা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিয়া দীঘির কালাে জলে সােনা মাখাইয়া দিল। আমি চাহিয়া বসিয়া রহিলাম।” তখন পাঠকবর্গ আশা করি অবাক নেত্রে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এ কোন চিত্রকল্প ? এ কেমন বর্ণনা? এই ভাষার কত না মাধুর্য। এই কাব্যময় গদ্য সুখপাঠ্য। এ থেকে প্রমাণিত, এ দিক থেকে বিচার করলে মনে হয় উপন্যাসের শুরুতেই লেখক কবিত্ব শক্তি না থাকায় যে আক্ষেপ করেছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। তবে ভবঘুরে প্রবৃত্তির মানুষের যে স্বাভাবিক অনুভূতি প্রবণতা থাকে তা অবশ্য ধরা পড়েছে এই ধরনের ভাষা ব্যবহারে।
সর্বোপরি, উপন্যাস মধ্যে যে দু’ধরনের গদ্য লক্ষ্য করে গেল তার একটি হল- শিল্পীত গদ্য, অন্যটি দৈনন্দিন জীবনের বাগভঙ্গীর সাথে ঘনিষ্ঠ। প্রথমটি রবীন্দ্রপ্রবর্তিত এবং পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসু অন্নদাশংকর রায় প্রমুখের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় রীতি। শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র দ্বিতীয় ধারাটি সর্বাধিকভাবে গ্রহণ করেছেন। এ ভাষার শিল্প গৌরব ততটা না থাকলেও বাস্তব জীবনের সঙ্গে যে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত সেকথা মানতে কোনাে দ্বিধা নেই। তবে রাবীন্দ্রিক ভাবের ভাষা মনকে যেন কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়।
Leave a comment