মূলত সাধারণ জীবনে মানুষ তার সুখ, দুঃখ, আশা, আনন্দ কামনাবাসনা প্রকাশ করে থাকে গানের মাধ্যমে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে ব্যবহৃত সঙ্গীতগুলিও এই ধারায় অভিষিক্ত। কাহার সমাজের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, বিষাদ নৈরাশ্য এ সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে। এই সঙ্গীত সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন হাঁসুলী বাঁকের মানুষ বিশেষতঃ ছেলে ছােকরার দল ধর্মরাজের বােলান গায়, গায় মন মনসার ভাসান, ভাদ্রমাসে গায় ভাদু ভাজোর গান, আশ্বিনে গায় পাঁচালী, চৈত্রে গায় ঘেটুর গান, সংক্রান্তিতে বােলান গাজন উপলক্ষে জমে ওঠে। এক এক উৎসবের অভিনায় এক এক ধরনের লােকসঙ্গীত। বারাে মাসের তেরাে পার্বণের সমহার আর সেই উপলক্ষ্যে কত বিচিত্র সব লােক সঙ্গীতের পরিবেশন ; কারণ, উৎসব মানেই তাে সঙ্গীতের মহাআয়ােজন।

অষ্টপৌরে পাড়ার যে ঘেঁটুগানের আসর বসেছে, বনওয়ারী তা কান পেতে শােনে

“হায় কলিকালে কত দেখালে

দেবতার বাহন পুড়ে মল অকালে,

তাও মারলে, রাখালে। 

ও তার বিচার হল না বাবা, তুমি বিচার করাে।

অতি বড়াে বাড়িল যারা তাদের ভেঙে পাড়াে।”

এটি মূলত করালী কর্তৃক কত্তাবাবার থানে আশ্রিত সর্পকে নিধনার্থে রচিত। সাধারণ মানুষ করালীর এই কাজকে কোনাে মতেই মেনে নিতে পারেনি। তাদের ধারণা, বাবার বাহনকে করালী হত্যা করেছে, গভীর পাপে নিমজ্জিত হয়েছে, অথচ বাবা তাকে শাস্তি দানে বিরত

“বিচার নাহিক বাবা পুরিল পাপের ভারা

সাজের পিদীম বলে ফু দিয়ে নিভালাে কারা

ও বটতলাতে বাবা বটতলাতে। 

সাধুজন এ কী লীলা সনজে বেলাতে ।….”

একটা পাগল ঘেঁটুগান রচনা করেছিল চন্ননপুরে প্রথম রেললাইন স্থাপন উপলক্ষে। এ গান কাহারদের খুবই মনে ধরেছিল। ঘােষ মহাশয়ের অনুরােধক্রমে পাগল সেই গান গেয়ে উঠেছে

ও সাহেব আস্তা বাঁধালাে।

হায় কলিকালে,

কালে কালে সায়েব আস্তা বাঁধালে-

পাগলের এই গানের পর ছােকরারা ধুয়াে ধরেছে

ছ’মাসের পথ কলের গাড়ি দণ্ডে চালালে

ও সায়েব আস্তা 

এরপরও পাগল গাইতে ভােলাে না—

ও সাহেব আস্তা বাঁধালেকাহার কুলের অন্ন ঘুচালে

পাল্কী ছেড়ে, র্যালে চলে যত বাবুলােক।

অর্থাৎ, কথায় বলে কারাে পৌষমাস, কারাে সর্বনাশ। বাবুরা রেল চড়ে দ্রুত গন্তব্য স্থলে যাবার সুযােগ পেলেও কাহাররা পান্কী বহন করে যে দুপয়সা উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতাে, রেল চালানােয় তাদের সেই রুজি রােজগার বন্ধ হবার আতিই এখানে উচ্চারিত হয়েছে।

শুধু এই নয়, হাঁসুলী বাঁকের উপকথন কালাে বৌয়ের কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। লেখক নিজেই জানিয়ে দেন- “সেই কবে থেকে রচনা করেছে, কেউ তাে জানে না।” এ মন্তব্য থেকে স্পষ্ট অনুভূতি হয় এ গান ইতিহাসাশ্রিত।

আমার মনের অঙের ছটা

তােমার ছিটে দিলাে না-

পদ্মাপাতায় কাঁদিলাম হে-

সে জল পাতা নিলে না।

টলােমলাে টলােমলাে-

হায় বঁধু হে পড়ে গেল

ও হায় চোখের জলের মুক্তাছটা

মাটির বুকে মরে না।

আবার লেখক উপন্যাস মধ্যে ভজো গানের ও উল্লেখ করেছেন

“কোনাে ঘাটেতে লাগায়েছে লা ও আমার ভাজো সখি হে!

আমি তােমায় দেখতে পেছি না। 

তাইতাে তােমায় খুঁজতে এলাম হাঁসুলীরই বাঁকে

বাঁশ বনে কাশ বনে লুকাহছ কোন ফাঁকে

তােমার আভা পায়ে লুটিয়ে পড়ি গা

ও আমার ভাজো সখি হে।”

সব মিলিয়ে বলতে হয়ে, যেহেতু তারাশংকরের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস খানি আঞ্চলিক অভিধানে বিভূষিত সেইহেতু এর অবয়ব জুড়ে যে লােক সঙ্গীতের সুরের ছোঁয়া লেগে থাকবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, আঞ্চলিকতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হল—লােকসঙ্গীতের ব্যবহার। তাই এ উপন্যাসে ব্যবহৃত লােক সঙ্গীতগুলাে যে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে সে বিষয়ে কোনাে সংশয় থাকতে পারে না।