‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে নারী চরিত্রের বৈচিত্র্য আনার প্রয়ােজনেই হয়তাে বাসিনী বৌ বা নয়ানের মা চরিত্রের পরিকল্পনা করেছেন লেখক। এই নারীর প্রতি বাঁশবাদী গ্রামের কাহার পল্লির কোনা সহানুভূতিই ছিল না বলে তারাশংকর উল্লেখ করেছেন— “নয়ানের মা এককালে ছিল মাতব্বরের পরিবার, ঘর ভাঙানাে ঘরে গিন্নি, তার অহঙ্কার ছিল বেশি, সে অহঙ্কার ভেঙে গেল যখন তখন থেকে সে অত্যন্ত কটুভাষিণী। তাই তার প্রতি কারু সহানুভূতি নাই”। ঔপন্যাসিকেরই কি ছিল, না হলে এই বিশাল মহাকাব্যিক উপন্যাসে বাঁশবাদী গ্রামের কাহার অধ্যুষিত অঞ্চলের যে ‘কলহ সংস্কৃতির’ ধারা প্রবাহিত সে প্রসঙ্গ যতবারই এসেছে বাসিনী বৌ (নয়ানের মা-ই) তার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। এবং তাকে আমরা দেখি শুধুই সে অভিশাপ দিয়ে চলেছে করালীকে, পাখিকে, মাতব্বর বনওয়ারীকে। নয়ানের বিয়ে করা বৌ পাখিকে সাঙ করার অনুমতি দেওয়ায় সে মাতব্বর বনওয়ারীর ওপর ক্রুদ্ধ। ক্রোধের আর একটা কারণ মাতব্বর বনওয়ারীর ও সে প্রাক্তন প্রণয়িনী। তার স্বামী কুঞ্জর ভালােবাসা সে পায়নি।
চৌধুরী কর্তার কাছে কাহার পাড়ার মেয়েদের যােগান দিতে দিতে এবং তাদের উচ্ছিষ্টের আস্বাদ নিতে নিতে তার স্বামী কবে ফুরিয়ে গেছে। রেখে গেছে সমর্থ বিধবা বাসিনী আর তার কুড়ি বছরের ছেলে হেঁপাে রুগী নয়ানকে কিন্তু বাসিনীর মনে তখন ও তাে জ্বলছিল কামনার আগুন, সেই আগুনের ঘি তাে বনওয়ারী স্বয়ং। সুচাঁদ কথায় কথায় বনওয়ারীকে স্মরণ করায় “নয়নের মায়ের সঙ্গে তার গুজুগুজু আর কেউ না জানুক আমি জানি। নদীর ধারে একদিন উয়াের পায়ে ধরেছিলি, আমি দেখেছিলাম।”
নয়ানের মাও সে কথা স্মরণ করায় বনওয়ারীকে।
“মনে আছে? পায়ে ধরেছিলে নদীর ধারে সুঁচাদ পিসি বলে গেল। -লয়াল রয়েছে ঘরে, বাসিনী বউ।
-সে ঘুমিয়েছে। জান, তখনও মাতব্বরি ঘরভাঙাদের। আমি তখন ঘর ভাঙাদের বউ।
-বাসিনী বউ, আমি তােমার অসম্মান করি নাই ভাই। বাসিনী বউ তার হাত চেপে ধরেছে। চোখ জ্বলছে। ভয় পেলে বনওয়ারী। বাসিনী বউ ভয়ঙ্করী হয় উঠেছে।”
উপন্যাসে আর একবার নয়ানের মার ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন ঔপন্যাসিক- “নয়ান যেদিন করালীর হাতে মার খেয়ে হাঁফাচ্ছিল, সেদিন ওসে বনওয়ারীর হাত ধরে টেনেছিল বাঁশবনের আঁধার রাজ্যের দিকে”। আসলে অপরিপূর্ণ এবং অচরিতার্থ কামনাই নয়ানের মাকে এত Sasdist করে তুলেছে। আর ঔপন্যাসিক আঞ্চলিক সত্তার আরােপে মানুষটিকেও অমানবিক করে তুলেছিল। লেখকের সহানুভূতির স্পর্শ যে আগাগােড়া পেল না তাঁর মৃত্যু ও তাই কদর্যভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘নয়নের মা মরেছে। সে মরণ তার ভীষণ। অনন্ত নসু তাই বললে নবান্নের দিন, অগ্রহায়ণের শেষ মাসে গিয়েছে নবান্ন। নয়ানের মা জাঙালে সদগােপ মহাশয়দের চার বাড়িতে আকণ্ঠ এটো কাঁটার প্রসাদ খেয়ে দম বন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করে মারা গিয়েছে।’ হিংসাপরায়ণা, কটু ভাষিণী বাসিনী বউ চরিত্রটি বিবর্তনধর্মী নয়। যদিও আধিদৈবিক, আধিভৌতিক সংস্কারে সে বেশি আস্থাশীল, কিন্তু তার ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হিসাবে সে কিন্তু ‘কপাল নকল কেই মেনে নিয়েছে। কালরুদ্রের শাস্তি বিধান বলে মনে করেনি।
উজ্জ্বলকুমার মজুমদার মন্তব্য করেছেন— “হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় আঞ্চলিকসত্তা ও মানবসত্তা একান্ত ঠিকই, তার মাঝে মাঝে আঞ্চলিক সত্তার দীর্ঘ ছায়া তার ভেতরকার মানুষগুলিকে লুকিয়ে ফেলে”। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার নয়নের মার প্রসঙ্গে কি একথা প্রযােজ্য হবে? গালিগালাজ, শাপ-শাপান্ত যেহেতু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলাের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আঞ্চলিক উপন্যাসের এটাও একটা ছাচ, সেই ছাঁচে এই নিষ্ঠুর চরিত্রটি সুন্দরভাবে ধাপ খেয়ে গেছে। উপন্যাসে অনেকগুলি নারী চরিত্রের ভিড়ে নয়ানের মা হারিয়ে যায়নি। নয়ানের মার চরিত্রে যদি কোনাে দ্বন্দ্ব থেকে থাকে তবে তাও বনওয়ারীকে ঘিরে হৃদয়াবেগ ঘটিত রং-এর খেলার কারণেই। এই দ্বন্দ্বকে আড়াল করতেই তার শাপ-শাপাত্ত গালি- গালাজ কটুভাষণ, করালী-পাখির ধ্বংসের চেয়ে ও বনওয়ারীর বিপর্যয়ই তার সব চেয়ে বেশি প্রার্থিত ছিল। মানবচরিত্রে তাে সাধারণত দোষে গুণে মিলিয়ে হয়, কিন্তু নয়ানের মা বাসিনী বৌ-এর কোনাে গুণের পরিচয় নেই এ উপন্যাসে। এ একেবারেই এক typical character.
Leave a comment