বঙ্কিম সাহিত্যে শৈবালিনী নারী চরিত্র অপূর্ব সৃষ্টি। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে উপন্যাসের কাহিনি বয়ন, সেই ‘চন্দ্রশেখর’-এর একজন সামাজিক পারিবারিক নারীচরিত্র রূপে শৈবালিনী যেভাবে আপনাতে আপনি বিকশিত হয়ে উঠেছেন তাতে সতঃতই বিস্ময়ের উদ্রেক করে৷ প্রবাদে আছে– “স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, মনুষ্য কতঃ।” শৈবালিনী সেই বৈশিষ্ট্যে সমাসীন। বাল্য হতেই প্রতাপকে সে ভালোবাসতো। একসাথে ভাগীরথীর তীরে খেলতে খেলতে ভালোবাসতে বাসতে তারা বাল্য-কৈশোর অবশেষে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। শৈবালিনী মনেপ্রাণেই জানতেন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে। কিন্তু প্রতাপ অন্তকরণে জানতেন এ বিবাহ কখনই সম্ভব নয়, কারণ শৈবালিনী তাঁর জ্ঞাতীকন্যা, তার ওপর পিতৃহারা দরিদ্র। উভয়ই যখন সম্পূর্ণরূপে জানলেন তাঁরা একে অপরকে যতই ভালোবাসুক না কেন বিবাহের পথে তাঁদের বিস্তর বাধা উভয়ের সম্মতিক্রমেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ভালোবাসা যদি সার্থক না হোল বেঁচে লাভ কি? একসাথে গঙ্গাবক্ষে ডুবে আত্মবিসর্জন দেবেন।

ব্যর্থ ভালোবাসাকে অমর করতে এমনভাবে আত্মবিসর্জন ছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ নেই। তাঁরা একসাথে সাঁতার দিয়ে নদীর মধ্যস্থলে গেলেন, পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো প্রতাপ ডুবলেন, কিন্তু শৈবালিনী ডুবলেন না। তিনি ভাবলেন- “কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না—ফিরিল। সন্তরণ করিয়া কূলে ফিরিয়া আসিল।” প্রেমাস্পদকে এমনভাবে একাকী বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসার মধ্যে নিহিত ছিল শৈবালিনীর মানসিক দুর্বলতা। প্রতাপ জলে ডুবে প্রমাণ করলেন শৈবালিনীকে তিনি প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসেন, আর শৈবালিনী না ডুবে ফিরে এসে জানিয়ে দিলেন প্রতাপের প্রতি তাঁর প্রেম ছিল কৃত্রিম। বিশেষতঃ তিনি যখন বলেন– ‘কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে?’ তখন বুঝতে বিলম্ব হয় না প্রতাপের চেয়ে শৈবালিনী নিজেকেই বেশি ভালোবাসতেন। লোকমুখে জেনেছিলেন তিনি অনন্ত রূপের অধিকারিণী। সেই মোহনীয় রূপকে এমনভাবে বিসর্জন দিতে তাঁর মন চাইলো না, তাই তিনি ফিরে এলেন। শৈবালিনীর এই কর্মে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিচারিতার স্বরূপ।

শৈবালিনী এমনই রূপের অধিকারিণী ছিলেন, মাতৃবিয়োগের পর ব্রহ্মাচর্য ব্রত ধর্ম ত্যাগ করে চন্দ্রশেখর তাঁর রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শৈবালিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। চন্দ্রশেখর শৈবালিনীর রূপে মোহমুগ্ধ হলেও কেমন করে যুবতী সুন্দরী স্ত্রীকে পরিচর্যা করতে হয়, তিনি জানতেন না। সর্বদাই স্ত্রীর নিকট নিরাসক্ত চিত্তে বিরাজ করতেন, কামনা-বাসনাময়ী নারী শৈবালিনী। জীবন ও যৌবনের মোহেই তিনি জলে ডুবে মরতে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন। আজ চন্দ্রশেখর-এর মতো সুপুরুষকে স্বামীরূপে পেয়েও তাঁর যৌবনধর্মে যখন কোনো আলোড়ন উঠল না, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই চন্দ্রশেখরের প্রতি তিনি বিমুখ হতে থাকলেন। মনে পড়ে যায় প্রতাপের কথা। তাঁর সুতীব্র ভালোবাসায় তিনি লালায়িত হয়ে ওঠেন। এইসময় ভীমা পুষ্করিণীতে স্নানকালে তিনি কুঠিয়াল লরেন্স কষ্টরের দৃষ্টিগোচর হয়েছিলেন। ফক্টর শৈবালিনীকে পেতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। রাতের অন্ধকারে লাঠিয়ালাদের দ্বারা ফষ্টর শৈবালিনীকে তুলে নিয়ে যেতে এলে তিনি বিনা দ্বিধায়ই বিনা প্রতিবাদে ফক্টরের সঙ্গে স্বামীগৃহ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। ফষ্টর যে তাঁকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়নি, তিনি যে স্বেচ্ছায় ফষ্টরের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে বেদগ্রামে ফিরে স্বপ্নেঘোরে তিনি চন্দ্রশেখরের নিকট শিকার করেছিলেন।

বিস্ময়ের কিছু নেই। যে প্রতাপকে শৈবালিনী বাল্য হতে গভীরভাবে ভালোবেসে এসেছেন, তাঁকে মনেপ্রাণে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়েছেন, সামাজিক কারণে যখন তাঁদের বিবাহ সম্ভব হলো না, তখন জীবনযন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে জলে ডুবে আত্মহননের পথ উভয়ে বেছে নিয়েছিলেন। প্রতাপ প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন, কিন্তু শৈবালিনী না ডুবে ফিরে এসেছিলেন কূলে। পরবর্তীকালে কামনার আতিশয্যে প্রতাপের ভালোবাসাকে ভুলে চন্দ্রশেখরকে বিবাহ করে মনের বাসনাকে পরিতুষ্টি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্রশেখরের নিরাসক্ত স্বভাবে বিনোদিনীর কোনো সাধই পূরণ হয় না। শেষে বিধর্মী ফক্টরের লোলুপ দৃষ্টিপথে নিপতিত হয়ে তাঁর গভীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে শৈবালিনীর উপায় ছিল না। তিনি যে ক্ষুধিত হৃদয়া, অতৃপ্ত যৌবনা, প্রবল বীর্যধারী পুরুষের সঙ্গলাভই যে তাঁর একমাত্র কাম্য।

সাময়িকের চিত্তবিভ্রমে তিনি ফষ্টরের সঙ্গ নিলেও তিনি নৌকামধ্যে বাঙালি সতী নারীর আদর্শকে মেনে চলেছিলেন। কখনো কোনো অসতর্ক মুহূর্ত নিজেকে কলঙ্কিত করেননি। তবে তিনি দৈহিক দিক থেকে শুচিতা রক্ষা করে চললেও মানসিক দিক থেকে তিনি ছিলেন বড়োই দুর্বল। একাধিক পুরুষে আসক্তা। ফক্টরের নৌকাতে অবস্থান কালীন শৈবালিনী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন ঘর ছেড়ে বাইরে পা দিয়ে কী মহা ভুল করেছেন। তারপর ঘটনার ক্রমিক বিবর্তনে প্রতাপ কর্তৃক উদ্ধার হওয়া, আবার বন্দি প্রতাপকে উদ্ধার করতে নবাব মীরকাসেমের সহায়তায় তাঁর দুঃসাহসিক অভিযান একের পর এক সংঘটিত হতে থাকে উপন্যাসে কাহিনি রচনার তাগিদে। ইংরাজ নৌকা থেকে প্রতাপসহ শৈবালিনীর গঙ্গাবক্ষে ঝাপ দেওয়া এবং দীর্ঘক্ষণ সত্তরণকালে উভয়ের কথোপকথনে এটুকুই স্পষ্ট– শৈবালিনীর বিবাহ হলেও তিনি প্রতাপকে ভুলতে পারেননি এবং প্রতাপ ভিন্ন তাঁর ইহজীবনে সুখ নেই। তবে শৈবালিনীর এই দ্বিচারিতাকে রোধ করতে প্রতাপ তৎপর হয়ে উঠলে শৈবালিনী প্রতাপকে সন্তুষ্ট করতে শপথ নিলেন– “আজি হইতে তোমাকে ভুলিব। আজি হইতে আমার সর্বসুখে জলাঞ্জলি! আজি হইতে মনকে আমি দমন করিব। আজি হইতে শৈবালিনী মরিল।”

তীরে উঠে শৈবালিনী প্রতাপকে ভুলতে প্রতাপের অজান্তেই অরণ্যমধ্যে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতাপকে তিনি কি ভুলতে পেরেছিলেন। ক্ষণিকের তরে তিনি মন থেকে প্রতাপকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। তাঁর কৃতকর্মে মুগ্ধ হয়ে রমানন্দ স্বামী মন্তব্য করতে ভোলেননি– “আমি এতকাল সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করিলাম, সর্বপ্রকার মনুষ্যের সহিত আলাপ করিলাম। কিন্তু সকলই বৃথা। এই বালিকার মনের কথা বুঝিতে পারিলাম না। এ সমুদ্রের কী তল নাই?” শৈবালিনীকে সহজেই বোঝা সম্ভব নয়। প্রতাপকে তিনি মন থেকে মুছে -ফেলতে তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করে বনমধ্যে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। অবশেষে কঠোর তপশ্রয়ার পর তিনি শুচিশুদ্ধা হয়ে স্বামী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে বেদগ্রামে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ঘুমের মধ্য দিয়ে স্বপ্নাভিদ্রতা হয়ে তিনি চন্দ্রশেখরকে জানিয়েছিলেন ফষ্টরের সঙ্গে তিনি যে চলে গিয়েছিলেন তা একমাত্র প্রতাপের জন্য। প্রতাপকে ভুলতে না পেরে তিনি অহরহ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। ভেবেছিলেন ফক্টরের সহায়তায় তিনি প্রতাপের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবেন, অথবা বিপরীতভাবে বলা যায় প্রতাপকে তিনি একেবারেই ভুলতে চেয়েছিলেন। প্রতাপ শৈবালিনীর জার কিনা চন্দ্রশেখর জানতে চাইলে, শৈবালিনী ঘৃণায় শিউয়ে ওঠেন এবং সোচ্চার কণ্ঠে বলেন– “এক বোঁটায় আমরা দুইটি ফুল, এক বনমধ্যে ফুটিয়াছিলাম– ছিঁড়িয়া পৃথক করিয়া দিলেন কেন?” এই বক্তব্যে শৈবালিনীর মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও, তবে তা সংশয়ের উদ্রেক করে। প্রথম যৌবনে তো তিনি বিবাহ অনিশ্চিত জেনে প্রতাপের সঙ্গে ডুবে মরতে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন, মনে প্রশ্ন নিয়ে– প্রতাপ তাঁর কে? কেন তাঁর জন্য তিনি মরতে যাবেন? এই বিপরীত ধর্মা বক্তব্যে দ্বিধার সঞ্চার করে।

নবাবের বিচারশালা থেকে প্রতাপের অসীম বিক্রমে ইংরাজ সৈন্যদের হাত থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে একান্তে শৈবালিনী প্রতাপকে বলেছিলেন– “আমি সুখী হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই।” এ বক্তব্য যথার্থ সত্য ও স্বাভাবিক। প্রতাপের সঙ্গে ডুবতে গিয়ে ফিরে এলেও পরবর্তী জীবনে প্রতাপকে ভোলা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। নিরাসক্ত পুরুষ চন্দ্রশেখরকে স্বামীরূপে পেয়ে তিনি তৃপ্ত-সুখী হননি। এই মুহূর্তে প্রতাপকে তাঁর স্মরণ হওয়া স্বাভাবিক। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, প্রতাপের জন্যই ফষ্টরের সঙ্গে তিনি ঘর ছেড়েছেন। সমুদ্রে সন্তরণকালে প্রতাপকে তিনি ভুলে যাবেন কথা দিলেও প্রতাপকে ভোলা তাঁর পক্ষে সহজ হয়নি। আজ বহু বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে পুঃন স্বামী সংসার ফিরে পেলেও প্রতাপ পূর্বের সেই অসীম বীর্য সৌর্য ও তেজ নিয়ে তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান, যে সৌর্যে বীর্যে নারীচিত্ত সহজেই উন্মোথিত হয়। শৈবালিনীর চিত্তও উন্মোথিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আর নয়, এবার তিনি দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে সংসারী হতে চান। কিন্তু সংসারী হওয়ার মুখে প্রতাপ হলেন চরমতম বাধা। তাই তিনি প্রথিনীর মতো অকাতর চিত্তে ঘোষণা করেছেন- “স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার; কতদিন বশে থাকিবে জানিনা। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” উপায়ন্তর না দেখে প্রেমাম্পদ সুখী করতে তাই ছুটে গিয়েছিলেন রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিতে।

অতএব সব মিলিয়ে বলতেই হয়, ফষ্টর কর্তৃক শৈবালিনী তাঁর শান্ত নিরাসক্ত গৃহকোণ থেকে বহির্জগতে পদার্পণ করে কলঙ্কিনী রূপে পরিগণিত হলেও, তাঁর অশান্ত চঞ্চল স্বভাবের মধ্যেই নিহিত ছিল এই সর্বনাশের বীজ। তিনি যদি একটু দৃঢ়চেতা ও সঠিক কর্মে অচঞ্চল থাকতেন, তাহলে তাঁর জীবনকে ঘিরে এমন কলঙ্কিত অধ্যায় সৃষ্টি হতো না। শৈবালিনী নিজেই নিজের পদস্খলনকে ত্বরান্বিত করেছেন।