আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যে তত্ত্বগতভাবে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
(১) শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশসাধন ও চরিত্রগঠন: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদর্শে শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশসাধন এবং চরিত্রগঠনকে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক শিক্ষাতেও এগুলিকে শিক্ষার বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(২) আকর্ষণীয় শিক্ষা-পরিবেশ ও ক্থাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক স্থাপন: রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার পরিবেশকে সর্বদাই শিক্ষার্থীর কাছে আকর্ষণীয় করে তােলায় যত্নবান ছিলেন। এ ছাড়া ছাত্রশিক্ষকের মধুর সম্পর্কের কথাও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। আমাদের দেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও বিদ্যালয়-পরিবেশকে ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় করে তােলার কথা বলা হয়েছে। ছাত্রশিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।
(৩) মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয় ঘটানাের কথাও বলেছেন তিনি। এই বিষয়গুলিকে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করার কথা বিভিন্ন শিক্ষাকমিশনের সুপারিশে রয়েছে।
(৪) শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় সংহতি সথাপন: রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় সংহতি স্থাপন করা এবং আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্য গড়ে তােলার ব্যাপারে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় সংহতি এবং আন্তর্জাতিক বােঝাপড়ার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের অন্যতম প্রতিফলন।
(৫) প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদর্শে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, শিক্ষায় আনন্দ এবং প্রকৃত মানুষ সৃষ্টির বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় শিক্ষানীতিতে এইসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এইভাবে আধুনিককালে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ, প্রয়ােগবাদ প্রভৃতি নানান দার্শনিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তাঁর শিক্ষাচিন্তা বিশ্বভারতী ও শ্রীনিকেতনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল। তাঁর শিক্ষাদর্শনের পাঁচটি প্রধান দিক হল-
(১) প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশে শিক্ষা: রবীন্দ্রনাথ চার দেয়ালের মধ্যে অর্থাৎ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিক্ষা পছন্দ করতেন না। তিনি মুক্ত আকাশের নীচে প্রাকৃতিক পরিবেশে পাঠদানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত প্রান্তরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
(২) শিক্ষায় আনন্দ: রবীন্দ্রনাথের মতে, আনন্দের মধ্যে দিয়েই প্রকৃত শিক্ষা হয়। কেবল পুথিগত শিক্ষা শিক্ষার্থীকে আনন্দ দিতে পারে না। এর জন্য চাই হৃদয়বৃত্তির চর্চা। এই কারণে আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের আনন্দদানের জন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজকে পাঠক্রমে স্থান দিয়েছিলেন।
(৩) শিক্ষায় স্বাধীনতা: রবীন্দ্রনাথ শিক্ষায় এবং কর্মে মানুষকে স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা দিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবােধ গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে তিনি সচেতন ছিলেন যাতে স্বাধীনতা কখনােই স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত না হয়।
(৪) বিকাশরুপে শিক্ষা: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের আর-একটি দিক হল বিকাশ। বিকাশ বলতে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার বিকাশকে বুঝিয়েছেন। শিক্ষা যেমন মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তাকে উন্মােচিত করে, তেমনি তা শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশেও সহায়ক হয়।
(৫) সক্রিয়তার মাধ্যমে শিক্ষা: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনে সক্রিয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থায় খেলা এবং কাজ উভয়কে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি শ্রীনিকেতনে কর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
এইভাবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিফলন দেখা যায়।
Leave a comment