গ্রাম-অধ্যুষিত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধিজি তাঁর নঈ তালিম শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা করেন। যে ব্যাবহারিক শিক্ষার অভাবে আজও আমাদের শিক্ষা পুথিসর্বস্ব, তার পরিবর্তনে বুনিয়াদি শিক্ষাই উপযুক্ত। এই শিক্ষার‌ ইতিবাচক দিকগুলি হল一

(১) সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা: গান্ধিজির নঈ তালিম শিক্ষাব্যবস্থাটি সক্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।

(২) সামাজিক গুণের বিকাশ: এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে অংশ নেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সহযােগিতা, সহমর্মিতা, সমবেদনা প্রভৃতি সামাজিক গুণের বিকাশ ঘটে, যা শিক্ষার্থীকে ভাবী জীবনে আরও বেশি সামাজিক হতে সাহায্য করে।

(৩) শ্রমের প্রতি মর্যাদা: এই শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা নিজেরা কায়িক শ্রমে অংশ নেয়। ফলে তাদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবােধ গড়ে ওঠে।

(৪) নৈতিক গুণাবলির বিকাশ: নঈ তালিম শিক্ষা ব্যবস্থায় গান্ধিজি পাঠক্রমকে সত্য এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষার্থীরা সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কর্মভিত্তিক শিক্ষায় অংশ নেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটে।

(৫) চাহিদা ও আগ্রহভিত্তিক শিক্ষা: নঈ তালিম শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হত। এখানে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব চাহিদা, প্রবণতা, ক্ষমতা এবং আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণের সুযােগ পেত।

(৬) বৃত্তিমূখী শিক্ষা: এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বৃত্তিকে কেন্দ্র করে সেই বিষয়ে শিক্ষালাভ করায় তাদের মধ্যে বৃত্তি সম্বন্ধে ধারণা গড়ে উঠত।

(৭) শরীরচর্চা: এই শিক্ষায় দৈহিক শ্রমের সাথে সাথে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে পাঠক্রমে শরীরচর্চাকেও স্থান দেওয়া হত।

(৮) সৃজনশীলতার বিকাশ: উৎপাদনভিত্তিক এবং শিল্পকেন্দ্রিক বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করতে করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটত।

(৯) বাস্তব অভিজ্ঞতা: বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষার্থী নিজের মাথা (Head), হাত (Hand) এবং হৃদয় (Heart) এই তিনটিকে একসঙ্গে কাজে লাগানাের সুযােগ পেত। ফলে তাদের মধ্যে খুব সহজেই বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হত।

(১০) কর্মজগতে প্রবেশ: নঈ তালিমে শিক্ষালাভের পর শিক্ষার্থীরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করত তাকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের কর্মজগতে অনেক সহজে প্রবেশ করতে পারত।

(১১) অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: এই শিক্ষা গ্রামভিত্তিক কোনাে শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায় গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হত এবং স্বনির্ভরতা অর্জনে সহায়ক হত।

(১২) নিজস্ব সাংস্কৃতিজাত শিক্ষা: ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভিত্তি করেই এই শিক্ষা পরিকল্পিত হয়। ফলে নিজ সংস্কৃতির প্রতি মর্যাদা এবং জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই শিক্ষা ছিল আদর্শ।

ভারতবর্ষের পক্ষে উপযােগী এবং সম্ভাবনাময় দেশীয় সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হলেও গান্ধিজির নঈ তালিম শিক্ষাব্যবস্থা সফল হয়নি। নীচে এই শিক্ষার জুটিগুলি আলােচনা করা হল一

(১) অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব: বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা পরিচালনার জন্য যে ধরনের অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়ােজন হত, তার যথেষ্ট অভাব ছিল। শিক্ষকের অভাবে এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি।

(২) সাংগঠনিক ক্রুটি: বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষালাভের পর উচ্চতর শিক্ষার পর্যায় কেমন হবে তার সঠিক নির্দেশ না পাওয়ায় বসু শিক্ষার্থী এই শিক্ষায় অনীহা প্রকাশ করে।

(৩) শিল্পের প্রতি অতিসক্রিয়তা: এই শিক্ষা যেহেতু একটি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত, তাই ওই বিষয়ে অধিক সক্রিয় হয়ে কাজ করতে করতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ে খুব একটা নজর দিতে পারত না। ফলে অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন অবহেলিত হত।

(৪) উৎপাদনমুখিতা: এই‌ প্রকার শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা উৎপাদনের দিকে নজর দিয়ে অর্থ উপার্জনের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে পড়ত। ফলে অভিজ্ঞতা অর্জন ও অন্যান্য গুণের বিকাশ ব্যাহত হত।

(৫) অনুবন্ধ নীতি প্রয়ােগে অসুবিধা: বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষাব্যবস্থায় অনুবন্ধ নীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা সঠিকভাবে প্রয়ােগ করা সম্ভব হত না।

(৬) গ্রামভিত্তিক শিক্ষা: বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা মূলত একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে তােলা হয়েছিল। শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কোনাে শিল্প নির্বাচনের বিষয় না থাকায় শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষায় অনীহা প্রকাশ করে।

(৭) আর্থিক স্বনির্ভরতা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে বিক্রি করে উপার্জিত অর্থের দ্বারা শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করা বাস্তবসম্মত নয়। অনেকে সমালােচনা করে বলেন যে, এই শিক্ষাব্যবস্থায় আর্থিক দিকের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক দিকটি অবহেলিত হয়েছে।

(৮) জনসমর্থনের অভাব: এই শিক্ষায় সমস্ত জনগণের সমর্থনের অভাব ছিল। শিক্ষিত এবং অর্থশালী ব্যক্তিগণ তাদের পুত্রকন্যাদের এই বিদ্যালয়ে ভরতি করাতেন না।