চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে ক্যারানাস ৮০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। নীচে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা করা হল一

মৌর্য সাম্রাজ্য

  • মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মের আদর্শ অনুসরণ করে অনশনে প্রাণ ত্যাগ করেন। মৌর্য সম্রাট অশােক কলিঙ্গ যুদ্ধের পরবর্তীকালে ধর্মপ্রচারকেই তাঁর প্রধান রাজদায়িত্ব বলে মনে করেছেন।

  • কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মৌর্য সম্রাট অশােক যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি চিরতরে ত্যাগ করে জনকল্যাণের এক সুমহান আদর্শ গ্রহণ করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচার করেন।

  • মৌর্যযুগে যুদ্ধের রথ ও প্রাসাদ নির্মাণ শিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, অলংকারশিল্প, মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প প্রভৃতির অগ্রগতি ঘটেছিল।

  • মৌর্য সাম্রাজ্যে স্থল ও জলপথে বাণিজ্য চলত। তক্ষশিলা, পাটলিপুত্র, চম্পা, বারাণসী, কোশাম্বী প্রভৃতি ছিল এযুগের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এবং ভৃগুচ্ছ, সােপারা, কল্যাণ প্রভৃতি ছিল ব্যস্ত সমুদ্রবন্দর।

  • মৌর্য শাসনকালে স্থাপত্যশিল্পে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। রাজধানী পাটলিপুত্রে মৌর্য রাজপ্রাসাদ, অশােকনির্মিত প্রসাদ, বিভিন্ন স্তুপ প্রভৃতি ছিল মৌর্য স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন।

  • মৌর্য শাসনকালে ভাস্কর্যশিল্পের যথেষ্ট উৎকর্ষ লক্ষ করা যায়। এযুগে বিভিন্ন স্তম্ভ, স্তম্ভের শিখরে সিংহ, ষাঁড় ও অন্যান্য পশুর মূর্তি, অন্যান্য কারুকার্য যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

  • মৌর্যযুগে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে এযুগে কারিগরি শিক্ষা ও চিকিৎসাশাস্ত্রচর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। মনে করা যায় যে, পরবর্তী গুপ্তযুগে ভারতে বিজ্ঞানচর্চায় যে উন্নতি ঘটেছিল, তার পটভূমি রচনায় মৌর্যযুগের বিজ্ঞানচর্চা সহায়তা করেছিল।

  • মৌর্যযুগে সাহিত্যচর্চায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল বলে জানা যায়। ভদ্রবাহু, পতঞ্জলি, পাণিনি প্রমুখ এযুগে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটান।

  • মৌর্যযুগে রচিত সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এছাড়া ভদ্রবাহুর কল্পসূত্র”, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী’, কাত্যায়ন ও পতঞ্জলির রচনা প্রভৃতি মৌর্যযুগে রচিত গ্রন্থ বলে মনে করা হয়।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য

  • ম্যাসিডনীয় সম্রাটগণ প্রাচীন বহুত্ববাদী গ্রিক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সম্রাটই ছিলেন ধর্মের প্রধান। তবে কোনাে ম্যাসিডনীয় সম্রাট ভারতের মৌর্য সম্রাট অশােকের মতাে ধর্মপ্রচারকে প্রধান রাজদায়িত্ব বলে মনে করেননি।

  • শান্তির সুমহান আদর্শের প্রতি অনুরাগ দেখিয়ে কোনাে ম্যাসিডনীয় সম্রাট যুদ্ধ বা সাম্রাজ্যবাদী নীতি ত্যাগ করেননি। মৌর্য সম্রাট অশােকের ব্যাপক জনকল্যাণের আদর্শও কোনাে ম্যাসিডনীয় সম্রাট গ্রহণ করেননি।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। ম্যাসিডনীয় শাসকরা দেশে শিল্পের অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতেন।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যেও অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয়‌ ধরনের বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল। আলেকজান্ডারের পরবর্তীকালে ম্যাসিডনীয় বাণিজ্য আফ্রিকা, ভারত এবং চিন পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। জলপথে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

  • প্রাচীন গ্রিসের স্বর্ণযুগের শিল্পের মতাে উৎকৃষ্ট না হলেও ম্যাসিডনীয় আমলে বহু সুবিশাল প্রাসাদ, অট্টালিকা, সর্বজনীন ভবন, বিলাসবহুল ঘরবাড়ি প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যেও ভাস্কর্যশিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। আফ্রোদিতির মূর্তিটি হল এযুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য। এছাড়া এযুগে বিভিন্ন কারুকার্যময় স্তম্ভ ও সুদর্শন মূর্তি নির্মিত হয়েছিল।

  • ম্যাসিডনীয় আমলে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। উল্লেখযােগ্য জ্যোতির্বিদ অ্যারিস্টারকাস এবং হিপার্কাস, গণিতবিদ ইউক্লিড ও আর্কিমিডিস, চিকিৎসক হিরােফিলাস ও ইরাসিসট্রেটাস প্রমুখ এযুগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

  • আলেকজান্দ্রিয়া শহরে কাব্যচর্চার বিকাশ ঘটেছিল। থিওক্রিটাস, ক্যাল্লিম্যাচুস প্রমুখ ছিলেন এখানকার উল্লেখযােগ্য কবি। তাঁরা নতুন ধারায় ছন্দের উদ্ভাবন করেন।

  • ম্যাসিডনীয় যুগে আলেকজান্দ্রিয়ার এরাটোস্থেনেস জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগােল বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। ইউক্লিডের এলিমেন্টস’ এবং টলেমির ‘আল মাজেস্ট প্রন্থটিও এযুগেই রচিত হয়।